১৯৪৯ সালে চীনের মূল ভূখণ্ডের শাসনভার যখন চীনা কম্যুনিস্ট পার্টি গ্রহণ করে, তখন রাশিয়ার ওপর চীনের বিমান খাত অনেক বেশি নির্ভরশীল ছিল। ১৯৫০ সালে রাশিয়া বেইজিংকে কয়েকটি মিগ-ফিফটিন জেট ফাইটার সরবরাহ করে। একইসঙ্গে রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ বিমানগুলো পরিচালনা করার জন্য পাইলটদের একটি পূর্ণাঙ্গ স্কোয়াড্রনও চীনে পাঠানো হয়।
পরবর্তী সময়ে চীন নিজেরাই সেভিয়েতের মিগ-সেভেনটিন, মিগ-নাইনটিন, মিগ-টোয়েন্টিওয়ান, জে-ফাইভ, জে-সিক্স এবং জে-সেভেনের আদলে ক্লোন সংস্করণ নির্মাণ করতে শুরু করে। এত বিপুল পরিমানে চীন এ ধরনের বিমান নির্মাণে সক্ষম হয় যে, নিজেদের প্রয়োজন পূরণ করে অন্যন্য দেশেও রফতানি করতে সক্ষম হয়।
১৯৯১ সালে সাবেক সেভিয়েতের পতন হওয়ার পর রাশিয়া চীনের কাছে চতুর্থ প্রজন্মের এসইউ-টোয়েন্টি সেভেন এবং এসইউ-থার্টি ফ্ল্যাংকার জেট বিক্রি করে। এসইউ চতুর্থ প্রজন্মের এ বিমানগুলো ছিল দুই ইঞ্জিনবিশিষ্ট এবং আক্রমণ পরিচালনায় পারদর্শিতার জন্য এ বিমানগুলো ব্যাপক সুনামও অর্জনও করেছিল। পরবর্তীতে শেনইয়াং এভিয়েশন কর্পোরেশন ফ্ল্যাংকারের তিনটি ক্লোন সংস্করণ হিসেবে জে-এলিভেন, ক্যারিয়ার ভিত্তিক জে-ফিফটিন ফ্লাইং শার্ক এবং আগ্রাসী জে-সিক্সটিন বিমান নির্মাণ করে।
সম্প্রতি রয়াল ইউনাইটেড সার্ভিস ইন্সটিটিউট একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে যাতে দেখা যাচ্ছে চীনারা প্রথমদিকে রাশিয়ার অনুকরণ করে বিমান নির্মাণ শুরু করলেও এখন তারা রাশিয়ার চেয়েও পারদর্শিতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। চীনের বেশ কিছু বিমান নির্মাণশৈলী ও কার্যকারিতায় এরই মধ্যে রাশিয়ার যুদ্ধবিমানকেও ছাপিয়ে গেছে।
যে চীন একটি সময়ে রাশিয়ার বিমান ও অস্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল, সেই চীন এখন উন্নত প্রযুক্তির এমন সব কমব্যাট এয়ারক্রাফট, সেন্সর এবং সমরাস্ত্র শিল্প নির্মাণ করছে যা রাশিয়ার চেয়েও অগ্রসর। কমব্যাট এয়ারক্রাফট নির্মাণের দিক থেকেও প্রযুক্তিগতভাবে চীন রাশিয়ার চেয়ে এগিয়ে গেছে।
চীন অবশ্য এখনো পর্যন্ত রাশিয়া থেকে টার্বোফ্যান ইঞ্জিনগুলো আমদানি করছে। কারণ চীন এখনো অবধি ডব্লিউ এস-টেনবি বা এর উন্নত সংস্করণ ডব্লিউ এস ফিফটিনের ইঞ্জিনের বিকল্প নিজ দেশে তৈরি করতে পারেনি। তবে চীনের সর্বশেষ নির্মিত বিমানগুলোতে অস্ত্র বহনের সুযোগ অনেক বাড়ানো হয়েছে। সেই সাথে রাশিয়ান যুদ্ধবিমানগুলোর তুলনায় চীনের বিমানগুলোর বৈমানিক সক্ষমতাও অনেক বেশি। রাশিয়া ও চীনের সামরিক বিমান পরিবহন খাতের তুলনামূলক পর্যালোচনা করলেই সাম্প্রতিক সময়ে চীনের এই উত্থানের নেপথ্য কারণগুলো বোঝা যাবে।
বেইজিং এর বার্ষিক সামরিক ব্যয় এরই মধ্যে মস্কোর সামরিক ব্যয়ের দ্বিগুনে পৌঁছে গেছে। রাশিয়া ২০২০ সালে সামরিক খাতে ব্যয় করেছে ৭০ বিলিয়ন ডলার। আর চীন করেছে ১৯০ বিলিয়ন ডলার। চীনের বেসামরিক বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি সংক্রান্ত শিল্পের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাওয়ায় এ শিল্পখাত থেকে তারা বিমান পরিবহনেও উন্নত প্রযুক্তি নিয়ে আসতে পারছে। চীন এরই মধ্যে পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর মতোই কম্পিউটার, সেন্সর এবং ডাটালিংকের ব্যবহার শুরু করেছে।
বিশ্বের যে কোনো জায়গায় যখন কোনো উন্নত সামরিক প্রযুক্তি বা অস্ত্র আবিস্কৃত হয় চীনা সামরিক প্রতিষ্ঠানগুলো তার ক্লোন সংস্করণ তৈরির জন্য বেপরোয়াভাবে চেষ্টা চালায়। বিশেষ করে হ্যাকিং সরঞ্জামের ক্ষেত্রে চীন খুব ভালো পারদর্শিতা দেখিয়েছে।
এছাড়া রাশিয়াার ওপর পশ্চিমা বেশ কিছু দেশের অবরোধ কার্যকর থাকায় উন্নত প্রযুক্তির সেন্সর বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলো রাশিয়া সংগ্রহ করতে পারছে না। তাই এখাতেও তারা পিছিয়ে পড়ছে।
তবে অবস্থা এমনও নয় যে, চীনের সামরিক বাহিনী সবদিক থেকেই সব সুবিধা নিয়ে এগিয়ে আছে। রাশিয়াও কিছু ক্ষেত্রে বেশ অগ্রসর। বিশেষ করে যুদ্ধ অভিজ্ঞতায় রাশিয়া অনেক এগিয়ে। রাশিয়ার অধিকাংশ যুদ্ধবিমান ও বোমারু বিমানগুলোকে অতি সম্প্রতি সিরিয়ায় সফলভাবে ব্যবহারও করা হয়েছে। অন্যদিকে চীনের সেনাবাহিনী মাত্র এক যুগ আগে যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এবং সামরিক খাতের অন্যন্য দিকে মনোযোগ দিতে শুরু করেছে।
রাশিয়ার এরোস্পেস ফোর্সেস বা ভিকেএস এখনো অবধি বেশ কিছু বিশেষায়িত বিমান ব্যবহার করছে। চীনের হাতে এখনো এ জাতীয় বিমান নেই। বিশেষ করে মিগ-থার্টি ওয়ান ইন্টারসেপটর, টিইউ-ওয়ান সিক্সটি এবং টিইউ টোয়েন্টি টু এমের মতো বোমারু বিমান। এসইউ-টোয়েন্টি ফাইভের মতো সমতল ভূমিতে আক্রমন করার মতো বিমান এখনো চীনের কাছে নেই।
এছাড়া চতুর্থ প্রজন্মের বিমান রফতানিতে চীনের তুলনায় রাশিয়ার রেকর্ড অনেক উপরে। বেইজিং চতুর্থ প্রজন্মের বিমান রফতানিতে পিছিয়ে থাকলেও যুদ্ধউপযোগী জেট প্রশিক্ষণ বিমান এবং ড্রোন রফতানিতে ভালো করেছে।
খুব শীঘ্রই এ চিত্রগুলোও পাল্টে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অস্ত্র এবং আকাশপথের বিমান ও অন্যন্য উপকরণ নির্মাণে রাশিয়ার তুলনায় চীনের উৎকর্ষতা ক্রমশই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। যেসব দেশ রাজনৈতিক টানাপোড়েন বা স্বল্প বাজেটের কারণে পশ্চিমা দেশগুলোর বিমানের দিকে হাত বাড়াতে সাহস পায় না ভবিষ্যতে তারাও হয়তো মস্কোর পরিবর্তে বেইজিং এর ওপর ভরসা করতে শুরু করবে।
রাশিয়ার তুলনায় চীনের বিমান কাঠামোতে এগিয়ে যাওয়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। বর্তমান সময়ে বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে বিমানের ওজনকে যথা সম্ভব কম রাখার জন্য নির্মাণশৈলীতে ভারী ওজনের উপকরণের পরিবর্তে হালকা ওজনের উপকরণ ব্যবহার করা হচ্ছে। ওজন কম থাকলে বিমান অল্প সময়ে অনেক বেশি দুরত্ব অতিক্রম করতে পারে। অনেকক্ষেত্রে এ হালকা উপকরণগুলো অনেক চড়া দামে কিনতে হয়। চীন এক্ষেত্রে বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় আছে। তারা জে-এলিভেন, জে-ফিফটিন এবং জে-সিক্সটিন বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে হালকা উপকরণগুলোকেই ব্যবহার করেছে। এ বিমানগুলো রাশিয়ার বিমানের আদলে তৈরি হলেও ওজন কম হওয়ায় তা রাশিয়ার বিমানগুলোর থেকেও অনেক বেশি কার্যকর হিসেবে প্রমানিত হয়েছে। পাশাপাশি চীনের বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান জিয়ান এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন সম্প্রতি থ্রি ডি প্রিন্টিং কম্পোজিট উপকরণের ব্যবহার শুরু করেছে। একইসঙ্গে কম্পিউটার সহায়ক কারিগরি প্রযুক্তি প্রয়োগ করছে। ধারণা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে চীন ভবিষ্যত প্রজন্মের বিমান নির্মাণেও এক ধাপ এগিয়ে গেলো।
আকাশপথে দুটো বিমানের মধ্যকার যুদ্ধের ক্ষেত্রে কিংবা আকাশ থেকে ভূমিতে গোলা নিক্ষেপের ক্ষেত্রে একজন পাইলটের টার্গেট থাকে যথাযথভাবে শত্রুর অবস্থান সনাক্ত করা। শত্রুর চোখকে ফাঁকি দিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে একটি সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যাওয়া। এ কারণেই অনেক ক্ষেত্রে অধিক গতির তুলনায় বরং উন্নত মানের রাডার বেশি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।
রাশিয়ার হাতে অত্যাধুনিক এসইউ থার্টি ফাইভ জেট বিমান আছে যাতে শক্তিশালী ইরবিস ই-পেসা জাতীয় রাডার রয়েছে। এ রাডার দিয়ে ২৫০ মাইল দূর থেকেই শত্রুপক্ষের এফ-সিক্সটিনের মতো বিমানকে সনাক্ত করা যায়। কিন্তু ইরবিসের নেতিবাচক দিকও আছে। ইরবিস নিজেই খুব দৃশ্যমান একটি প্রযুক্তি। তাই এ রাডারটি শত্রুপক্ষের বিমান সনাক্তে নিজের মুন্সীয়ানা দেখানোর আগেই নিজেই বরং শত্রুদের কাছে ধরা পড়ে যায়।
মার্কিন বিমান বাহিনী এবং নৌ বাহিনী আরো প্রায় দু যুগ আগেই এসা রাডারের ব্যবহার শুরু করেছে। রাশিয়াও তার এসইউ ফিফটি সেভেন যুদ্ধবিমান এবং মিগ থার্টি ফাইভে এই রাডার ব্যবহারের কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এ পর্যন্ত তারা যে কয়টি মিগ-থার্টি ফাইভ বাজারে ছেড়েছে তার কোনোটিতেই এসা রাডার পাওয়া যায়নি।
এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানেও আসলেই এ রাডার ব্যবহার করা যাবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এদিক দিয়ে চীন অনেকটা সুবিধাজনক অবস্থায় চলে গেছে। কারণ তারা তাদের দ্বি-ইঞ্জিন বিশিষ্ট জে-এলিভেন, জে-ফিফটিন এবং জে-সিক্সটিন বিমান নির্মাণের ক্ষেত্রে এসা রাডারকে ব্যাপকভিত্তিক সংযোজন করতে শুরু করেছে।
চীনের অত্যাধুনিক বিমানগুলোতে এসা রাডারের ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় ধারণা করা যাচ্ছে তারা শুধু রাডারে নয় বরং সেন্সর প্রযুক্তিতেও পশ্চিমা উন্নত দেশের মতোই প্রযুক্তি ব্যবহার করতে যাচ্ছে। রাশিয়ায় এ জাতীয় সেন্সর ব্যবহারের কোনো তথ্য এখনো পাওয়া যায়নি। সেন্সরের পাশাপাশি যুদ্ধজয়ের জন্য চাই বিয়ন্ড ভিজুয়াল রেঞ্জ তথা বিভিআর ধরনের সমরাস্ত্র। এক্ষেত্রে এমন সব মিসাইলের প্রয়োজন যা অনেক দূর থেকেই শত্রু টার্গেটে নির্ধারণ করা যায়।
একই সঙ্গে উচ্চমাত্রার গতি এবং শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা ও জ্যামিংয়েরও দরকার হয়। বিগত দশক থেকেই চীন দুটো বিভিআর প্রযুক্তির মিসাইলের ব্যবহার শুরু করে। এগুলো হলো পিএল-টুয়েলভ ও পিএল ফিফটিন। এ দুটো মিসাইল মার্কিন এইম-হান্ড্রেড টুয়েন্টি মিসাইলের মতোই কার্যকর। এর কাছে রাশিয়ার আর সেভেনটি সেভেন বিভিআর মিসাইল অনেকটাই দুর্বল।
চীন স্বল্প দুরত্বের মিসাইল নির্মাণেও রাশিয়াকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। এ কারণেই ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দিনগুলোতে বিমান, বৈমানিক প্রযুক্তি ও আকাশপথের সমরাস্ত্র নির্মাণে চীন বিশ্বের নতুন শক্তি হিসেবে ভালোভাবেই আবির্ভূত হতে যাচ্ছে।