প্রয়াত প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন বলেছিলেন, রাশিয়া হলো একটি ঝুঁকিপূর্ণ গ্যাস স্টেশন, যা একটি দেশের ছদ্মবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, রাশিয়া কূটনীতির নামে অপনীতি করছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। অর্থনীতিকে সচল রাখার জন্য শুধুমাত্র তেল ও গ্যাসের ওপর নির্ভর করে। ম্যাককেইনের দেখা রাশিয়া এখন আর নেই। সীমাবদ্ধতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে। রাশিয়া এখন নিজস্ব প্রযুক্তি ও সক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে দক্ষ ও কার্যকর জেট বিমান নির্মাণ করতে পারে। তাদের কারও কাছ থেকেই আর প্রযুক্তি চুরি করতে হয় না।
রাশিয়ার প্রভাবশালী গণমাধ্যম আরটির হিসাবে এবার বড়দিনের আগ মুহূর্তে দেশটির সামরিক বাহিনী একটি বহুপ্রতীক্ষিত সুসংবাদ পেয়েছে। রাশিয়ার বিমান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সুখোই দেশটির বিমানবাহিনীকে এসইউ ফিফটি সেভেন বিমান সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে রাশিয়ার বিমানবহরে আরও ১০টি অত্যাধুনিক বিমান যুক্ত হওয়ার আভাস পাওয়া গেলো। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি নতুন বিমান সরাসরি যুদ্ধেও অংশ নিয়েছে। নতুন এ বিমানগুলোর নির্মান কার্যক্রম আগামী মাস থেকে আরও বহুগুণে বাড়বে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। মস্কো সব মিলিয়ে ৭৬টি নতুন ধরনের সমরাস্ত্র নির্মাণ নিয়ে কাজ করছে।
আগামী দিনগুলোতে রাশিয়ার সামরিক কৌশলেও এসব যুদ্ধাস্ত্রের প্রভাব পড়বে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন নিজেই উদ্যেগী হয়ে এসব প্রকল্পে অর্থের যোগান দিচ্ছেন। ক্রেমলিন অবশ্য এসইউ ফিফটি সেভেনের নির্মাণ ব্যয় কমানোর জন্য বিগত কয়েক বছর ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাশিয়া চাইছে, যাতে ব্যাপক হারে এ বিমানের উৎপাদন করা যায়। কেননা, রাশিয়া খুবই সাশ্রয়ী মূল্যে এ বিমানটি বিভিন্ন দেশে রফতানি করে নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পকেও শক্তিশালী একটি জায়গায় নিয়ে যেতে চায়।
ধারণা করা হচ্ছে, একেকটি এসইউ ফিফটি সেভেন যুদ্ধ বিমান নির্মাণে ৪০মিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ হবে। এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানগুলো সমরাস্ত্র বাজারে থাকা অন্যন্য বিমানের তুলনায় অনেক বেশি আধুনিক। এর আগের সংস্করণ এসইউ থার্টি ফাইভের সাথে খরচ মেলালে এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানটি যথেষ্ট সাশ্রয়ী।
রাশিয়ার এই সব নতুন প্রযুক্তি আগামী কয়েক বছরের মধ্যে দেশটির এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির ভিত্তিমূলে পরিণত হবে। রাশিয়ার বিমান পরিবহনের সাথে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মনে করছেন, এ বিমানটি একবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি থেকেই অপারেশনে চলে আসবে।
এ বিমানগুলোতে আধুনিক যেসব প্রযুক্তি সংযোজন করা হয়েছে, তা বর্তমানে আর কোনো বিমানে নেই। আর রাশিয়ার এরোডায়নামিক প্লাটফর্মগুলোর মানও এখন যথেষ্ট উন্নত। এসব প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে খুব শীঘ্রই নতুন অস্ত্র নির্মাণ করবে। পঞ্চম প্রজন্মের বিমানে যেসব প্রযুক্তি ও সুযোগ সুবিধা থাকবে বলে ধারণা করা হয় তার সবগুলোই এ বিমানে সংযোজন করা হচ্ছে।
এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানকে ন্যাটো ফেলন নামে অভিহিত করছে। এ বিমানের কথা প্রথম শোনা যায় প্রায় দুই দশক আগে। অন্যদিকে, ২০১০ সালে আবার প্রোটোটাইপ ধরনের বিমান আকাশপথে ফিরে আসে। এরপর আসে টি-ফিফটি এবং পিকেএ এফ এ নামেও বেশ কিছু বিমান। অর্থাৎ, কাক্সিক্ষত বিমানটি তৈরি করার পথেই এর পূর্ববর্তী ধাপের অংশ হিসেবে আরো বেশ কয়েকটি বিমানও বাজারে চলে এসেছে। অন্যদিকে, প্রোটোটাইপ ধরনের বিমানগুলো এখনও বিমান বাহিনীর মহড়াগুলো নিয়মিতই দেখা যায়। এখন আবার এসইউ ফিফটি সেভেনের নির্মান কাজ জোরে শোরে শুরু হয়েছে। প্রথম যে এসইউ ফিফটি সেভেনটি নির্মিত হলো, তাতে পুরনো একটি ইঞ্জিন ব্যবহৃত হলেও আগামীতে সাধারণ রফতানির জন্য যে বিমানগুলো তৈরি হবে, সেখানে নতুন ইঞ্জিন সংযোজন করা হবে।
এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানের নির্মান কাজ গত বছর এক দফা হোঁচট খায়। সে সময় এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানটি একটি ফ্যাক্টরি ট্রায়ালে ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও বিমানটি ধ্বংস হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে পাইলট নিজেকে নিরাপদে বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
এ দুর্ঘটনার কারনে সামরিক বাহিনীর কাছে এ প্রযুক্তিটি আসার প্রক্রিয়া আরো প্রায় এক বছর বিলম্বিত হয়।
এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানটি একটি স্টেলথ যুদ্ধবিমান হিসেবে কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে কিছুটা সংশয় আছে। বিমানটি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল যাতে দ্রুত বিমানের স্পিড বাড়ানো যায়, পারদর্শিতা বজায় থাকে আবার একইসঙ্গে বিমানগুলোতে এমন সব প্রযুক্তি আছে যা দিয়ে আকাশপথের টার্গেটকে সঠিকভাবে সনাক্ত করা যায়। তবে রুশ কর্মকর্তারা বলছেন এ বিমানগুলোর কার্যকারিতা প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে যাবে।
এ বিমানগুলোতে এডভান্সড লেভেলের এভিওনিকস যুক্ত করা হয়েছে যার মাধ্যমে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করা হবে। এ প্রযুক্তির ফলে পাইলট যথাযথভাবে বিমান উড্ডয়ন করতে পারে। বিমানের সাথে বহন করা অস্ত্রগুলোকেও সঠিকভাবে নিক্ষেপ করতে পারে। কৃত্রিম এ প্রযুক্তিগুলো থাকার কারণে একজন পাইলটই এ বিমানটি পরিচালনা করতে পারে। আলাদা করে কোনো কো-পাইলটের প্রয়োজন পড়ে না। এমনকী এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানটি মনুষ্যবিহীন ড্রোনের সাথেও পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে।
নতুন এ যুদ্ধবিমানটিতে রাশিয়ার নির্মিত সকল বৈমানিক অস্ত্র ব্যবহার করার সুযোগ থাকছে। হাইপারসনিক মিসাইলগুলোকেও এ বিমানে সংযুক্ত করা যাবে। বিশেষ করে কিনঝাল মিসাইল এবং আভ্যন্তরিন কিছু সমরাস্ত্র প্রযুক্তিকে ভালোভাবেই এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানে ব্যবহার করা যাবে।
কিনঝাল হলো রাশিয়ার পারমানবিক বোমা বহন উপযোগী এক ধরনের ব্যালিস্টিক মিসাইল-যা ২ হাজার কিলোমিটার পথও পাড়ি দিতে পারে। এ ব্যালিস্টিক মিসাইলগুলো ১০ ম্যাক গতিতে চলতে পারবে। আর তেমনটা হলে বিমান উড্ডয়নের প্রতিটি প্রক্রিয়ায় এ মিসাইলগুলো কার্যকর থাকতে পারবে। এসইউ ফিফটি সেভেন বিমাননে প্রথাগত এবং পারমানবিক উভয় ধরনের অস্ত্রই বহন করতে পারবে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সার্গেই শোইঘু সম্প্রতি বলেছেন, আগামী ২০২৪ সালের মধ্যেই সুখোই ২২টি এসইউ ফিফটি সেভেন বিমান সরবরাহ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
যদিও এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানটি এখনও প্রাথমিক অবস্থায় আছে তারপরও এরই মধ্যে এ বিমানটি বেশ কিছু সামরিক যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। ২০১৮ সালে, রাশিয়া তার বেশ কিছু প্রোটোটাইপ সিরিয়া যুদ্ধে ব্যবহার করেছে। রাশিয়া যেহেতু এসইউ ফিফটি সেভেন বিমানটি ব্যাপকহারে রফতানি করতে চাইছে, তাই ক্রেতাদের কাছে এ বিমানটির গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য বিমানের প্রাথমিক সংস্করণকেই যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার করে ফেলেছে।
এদিকে সাম্প্রতিক একটি যৌথ মহড়ার খবরে বিশ্বজুড়ে বেশ সরব আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। ডিসেম্বরের ২২ তারিখে রাশিয়ার বিমান বাহিনী ও চীনের বিমান বাহিনী মিলে যৌথভাবে জাপান সাগর এবং দক্ষিন চীনা সাগরে যৌথ বিমান মহড়া চালিয়েছে। এ ঘটনায় এশিয়া- প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ক্ষেত্রে নতুন করে হিসেব নিকেশ শুরু হয়েছে। চীনের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, আগামীতে রাশিয়ার সাথে মিলে তারা হয়তো নিয়মিতভাবেই এ জাতীয় মহড়া পরিচালনা করবে।
চীন এ মহড়ায় পারমানবিক বোমা বহনে সক্ষম এমন চারটি এইচ-সিক্সকে বোমারু বিমান পাঠায়। অন্যদিকে রাশিয়া পাঠায় তার বিখ্যাত টিইউ নাইনটি ফাইভ বোমারু বিমানকে। দুই দেশের এ অত্যাধুনিক বিমানগুলো বার্ষিক সামরিক সহযোগিতা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে যৌথ টহল কার্যক্রমও পরিচালনা করে। বিজ্ঞপ্তিতে দাবি করা হয়, যৌথ এ টহলের উদ্দেশ্য হলো চীন ও রাশিয়ার কৌশলগত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরো মজবুত করা। নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পরস্পরকে সহায়তা করা। বিশেষ করে দুদেশের সামরিক বাহিনী আগামীতে কৌশলগতভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতাকে নিশ্চিত করতে চায়।
এর আগে রাশিয়ার দুটো টুপোলেভ টিইউ নাইন্টি ফাইভ এম এস মিসাইল বহনকারী বোমারু বিমান জাপান সাগরের ওপর দিয়ে আট ঘন্টা উড়ে যায়। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয় বলছে, এ উড্ডয়নের সময় মিসাইল বহনকারী বিমানগুলোকে এসইউ থার্টি ফাইভ যুদ্ধবিমান ঘেরাও করে পাহাড়া দিয়ে নিয়ে যায়।
ধারণা করা হচ্ছে, এ যৌথ টহলের মাধ্যমে চীন রাশিয়ার সহযোগিতা নিয়ে তাইওয়ানকেও একটি প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে দিলো।