সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে এসে অস্ত্র বিক্রির প্রস্তাব দিয়েছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসগলু। প্রতিরক্ষা শিল্পে গত কয়েক বছর ধরে অভূতপূর্ব উন্নতি করা দেশটি ক্রমশই তার অস্ত্রের বাজার সম্প্রসারণ করছে। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া এমনকি ইউরোপেও আছে তুর্কি অস্ত্রের ক্রেতা।
১৯৮০ এর দশকে বেশ কয়েকটি ন্যাটো সদস্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নিজেরাই সমরাস্ত্র তৈরির উদ্যোগ নেয়। তুরস্ক তার একটি। প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে তারা দেশেই প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষা সামগ্রী উৎপাদনেরবিশাল পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করে।
২০০৩ সালে একে পার্টি ক্ষমতায় আসার পর এই খাতে আরো বেশি গুরুত্ব দেয় দেশটি। প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ান ভিশন ২০২৩ হাতে নেন দেশকে প্রতিরক্ষা খাতে স্বনির্ভর করতে। শুরুতে সাজোয়া যান দিয়ে শুরু করলেও এখন ট্যাঙ্ক, মিসাইল, রকেট লঞ্জার, ড্রোন সব কিছুই তৈরি হচ্ছে তুরস্কের বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানে। এখন তুরস্কের অনেকগুলো সমরাস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে যারা বিশ^মানের পণ্য উৎপাদান করে। দেশটি এখন স্থল, নৌ এবং আকাশ যুদ্ধের অনেক সামরিক যান, প্রযুক্তি ও যন্ত্রাশং রফতানিও করে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে তুরস্ক এখন বিশে^র অস্ত্র রফতানিকারণ দেশগুলোর তালিকায় উপরের দিকেই অবস্থান করছে। সংস্থাটির প্রকাশিত এক সূচকে দেখা গেছে ২০১৪-১৮ এই চার বছরে তুরস্কের অস্ত্র রফতানি বেড়েছে পূর্ববর্তী চার বছরের তুলনায় ১৭০ শতাংশ।
২০১৭ সালেই আসেলসান ও টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ নামের দুটি তুর্কি প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বিশে^র সেরা একশো কোম্পানির তালিকায় জায়গা করে নেয়। তবে এসব একদিনে হয়নি। এর পেছনে রয়েছে একটি মাস্টারপ্ল্যান। ২০২৩ সালকে সামনে রেখে রিসেপ তাইয়েব এরদোয়ানের সরকার যে ভিশন ঘোষণা করেছে তার মূল দুটি লক্ষ হলো- অর্থনৈতিকভাবে বিশে^র সেরা দেশগুলোর কাতারে যাওয়া এবং প্রতিরক্ষা খাতে বিদেশ নির্ভরতা কমিয়ে নিজস্বভাবে সমরাস্ত্র উৎপাদন করা।
প্রতিরক্ষা খাতে যার শুরুটা হয়েছিল বিদেশ থেকে কেনা অস্ত্র আধুনিকায়ন দিয়ে। এরপর নিজেরাই বিভিন্ন অস্ত্র উৎপাদান শুরু করে তুর্কি কোম্পানিগুলো।স্থলযুদ্ধের বিভিন্ন উপকরণ নির্মাণ দিয়ে শুরুর পর যুদ্ধজাহাজ, অ্যাটাক হেলিকপ্টার এমনকি সর্বাধুনিক ফাইটার জেটও নির্মাণ করছে তারা। পাশাপাশি ইলেট্রনিক ওয়ারফেয়ারের বিভিন্ন প্রযুক্তিও উৎপাদন করছে দেশটি। ২০২০ সালের শেষ দিকে এসে দেশটির দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথভাবে টর্পেডো উৎপাদনের ঘোষণাও দিয়েছে। হেলিকপ্টার ড্রোন, মনুষ্যবিহীন নৌযানেরও সফল পরীক্ষা চালিয়েছে। বর্তমানে তারা মনোযোগ দিয়েছে মনুষ্যবিহীন সাজোয়া যান, আন্ডারগ্রাউন্ড এন্ড টানেল ওয়ারফেয়ার উইপন্স এবং ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী অস্ত্র উৎপাদনে।
তুরস্কের সমরাস্ত্র উৎপাদন শিল্পের নীতি নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান এসএসবির প্রধান ইসমাইল দেমির বলেন,নতুন প্রজন্মের ব্যাটল ট্যাঙ্ক, আর্মার্ড কমব্যাট ভেহিকেল, টেকটিক্যাল হুইল আর্মার্ড ভেলিকেল প্রস্তুত করি আমরা। ন্যাটোর সামরিক অভিযানের প্রয়োজনীয়তা ও স্ট্যান্ডার্ড মাথায় রেখে শুরু থেকে প্রতিটি প্রকল্প চলছে। নিজেদের সামরিক বাহিনীর জন্য তুরস্কের উৎপাদিত পণ্যের বাজার ক্রমশ বিদেশেও সম্প্রসারিত হয়েছে।
অপেক্ষাকৃত কমদামে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন করায় অনেক দেশই আকৃষ্ট হয়েছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা সামগ্রী কিনতে। মধ্যপ্রাচ্য, পূর্ব এশিয়া এমনকি ন্যাটো সদস্য দেশের কাছে অস্ত্র বিক্রি করছে। বর্তমানে তুরস্কের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তান। বিশে^ অস্ত্র আমদানিকারক দেশগুলোর তালিকায় তুর্কমেনিস্তানের অবস্থান ৪০ নম্বরে। ২০১৭ সালে দেশটি আমদানি করেছে ৯২ মিলিয়ন বা ৯ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারের অস্ত্র। আর এর বেশির ভাগই তুর্কি পণ্য। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিচার্স ইনস্টিটিউটের তথ্য মতে, তুর্কমেনিস্তান তাদের আমদানিকৃত অস্ত্র ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা সামগ্রীর সবচেয়ে বড় অংশ- ৩৬ শতাংশ কেনে তুরস্ক থেকে। এরপর ২৭ শতাংশ কেনে চীন থেকে আর ২০ শতাংশ কেনে রাশিয়া থেকে।
মধ্যএশিয়ার এই দেশটি তুরস্ক থেকে সবচেয়ে বেশি কেনে সামরিক নৌযান। বর্তমানে কাস্পিয়ান সাগরে তুর্কমেনিস্তানের বিশাল উপকূল পাহাড়া দেয় তুরস্কের তৈরি ১০টি তুজলা ক্লাস প্যাট্রোল বোট। এরপরেই আছে সাঁজোয়া যান ও অন্যান্য স্থলযুদ্ধ উপকরণ। ওই অঞ্চলে তুরস্কের অস্ত্রের আরেক বড় ক্রেতা আজারবাইজান। এতদিন বিষয়টি প্রকাশ্যে না এলেও ২০২০ সালের নাগোরনো কারাবাখের যুদ্ধের পর সেটি আর গোপন থাকেনি। তুর্কি অস্ত্র দিয়ে ওই যুদ্ধে আর্মেনিয়ার দখল থেকে অনেক এলাকা মুক্ত করেছে আজারবাইজান। তুরস্কের বেরাকতার টিবি টু ড্রোন তার ধ্বংস ক্ষমতা দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এমনকি রাশিয়ার তৈরি এস-থ্রি হান্ড্রেড মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমও রীতিমতো ভস্ম হয়ে গেছে বেরাকতার ড্রোনের মিসাইল হামলায়।
অবশ্য বেরাকতার টিবি টু ড্রোন সবার আগে পেয়েছে কাতার। কাতার সশস্ত্র বাহিনীর কাছে ৬টি বেরাকতার ড্রোন আছে।মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে তুর্কি সমরাস্ত্রের বড় ক্রেতা কাতার। দোহার সাথে আঙ্কারার সম্পর্ক অনেক বছর ধরেই বন্ধুত্বপূর্ণ। যে কারণে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতাও জোরদার হয়েছে অনেকগুন। কাতারের নৌ বাহিনী তুরস্কের তৈরি যুদ্ধ জাহাজও ব্যবহার করছে। এছাড়া ট্যাঙ্ক, সাজোয়া যানসব স্থল যুদ্ধের বিভিন্ন উপকরণ কাতারের কাছে বিক্রি করেছে তুরস্ক।
তুরস্কের অস্ত্রের ক্রেতা দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে কাজাখস্তান, সৌদি আরব, সংযুক্ত আবর আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপাইন। মালয়েশিয়ার কোস্টগার্ডের নৌযানের জন্য রিমোট কন্ট্রোল টারেট গান সরাবরাহ করেছে তুরস্কের আসেলসান। ফিলিপাইন তাদের নৌ বাহিনীর দুটি করভেটের জন্যও নিয়েছে একই ধরণের অস্ত্র। ২০১৬ সালে ফিলিপাইন আর্মির জন্য ৫ হাজার নাইট ভিশন ডিভাইস দিয়েছে একই প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে ছোটখাট অস্ত্র তো আছেই।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েন থাকলেও অস্ত্র বাণিজ্যে সেটি খুব একটা প্রভাব ফেলেনি।এই দুটি দেশ প্রধানত স্থলযুদ্ধের উপকরণ ও ছোট সমরাস্ত্র কেনে তুরস্কের কাছ থেকে। এই অঞ্চলের ছোট দেশ বাহরাইনও তুর্কি অস্ত্রের অন্যতম ক্রেতা।
দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের সমরাস্ত্রের সবচেয়ে বড় ক্রেতা পাকিস্তান। ইতোমধ্যেই পাকিস্তান নৌ বাহিনীর জন্য যুদ্ধজাহাজ বানিয়েছে তুরস্ক। পাকিস্তানকে ২টি করভেট সরবরাহ করেছে তুর্কি প্রতিষ্ঠান আসফাত। আরেকটি জাহাজের নির্মাণ কাজ চলছে। ২০১৮ সালের এক চুক্তি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটি পাকিস্তান নৌ বাহিনীর জন্য তিনটি করভেট নির্মাণ করার কথা। যার দুটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে তুরস্কে আর তৃতীয়টির নির্মাণ কাজ চলছে করাচির একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানায়। একই সাথে পাকিস্তানে করভেট নির্মাণের প্রযুক্তিও হস্তান্তর করছে তুরস্ক।
এছাড়া তুরস্কের নিজস্ব উদ্ভাবিত টি-ওয়ান টুয়েন্টি নাইন অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার চুক্তিও করেছে পাকিস্তান। এই হেলিকপ্টার একসঙ্গে আটটি অ্যান্টিট্যাংক মিসাইল, ১২টি গাইডেড রকেট রকেট ও অটোমেটিক গানের জন্য ৫০০টি গুলি বহন করতে পারে। এই হেলিকপ্টার প্রচণ্ড গরম ও ঠাণ্ডায় বিরূপ পরিবেশে রাতের আঁধার বা দিনের আলোতে ভূমি থেকে অনেক উচ্চতায় অভিযান পরিচালনা করতে সক্ষম। এই হেলিকপ্টারে বহনকরা টি-ওয়ান ফিফটি ফাইভ ফিরটিনা মিসাইল ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে ৪০ কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
পাকিস্তান দেড় বিলিয়ন ডলারে ৩০টি টি-ওয়ান টুয়েন্টি নাইন অ্যাটাক হেলিকপ্টার কেনার জন্য ২০১৮ সালে তুরস্কের সঙ্গে চুক্তি করছিল; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র হেলিকপ্টার বিক্রিতে তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। কারণ, এই হেলিকপ্টারে ব্যবহৃত ইঞ্জিন যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি; তুরস্ক এসব ইঞ্জিনচালিত হেলিকপ্টার যুক্তরাষ্ট্রের অনুমতি ছাড়া তৃতীয় পক্ষের কাছে বিক্রি করতে পারবে না। তবে সেই বাধা কাটাতে তুরস্ক নিজেই উদ্ভাবন করেছে হেলিকপ্টারের ইঞ্জিন। দেশটির রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান তুসান ইঞ্জিন ইন্ডাস্ট্রিজ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে তাদের তৈরি একটি হেলিকপ্টার ইঞ্জিন পরীক্ষার জন্য দিয়েছে। ২০১৭ সালে এই প্রকল্প শুরু হয়ে সম্প্রতি তা সফলতার মুখ দেখেছে। তাই পাকিস্তানকে হয়তো নিজস্ব উদ্ভাবিত ইঞ্জিনের হেলিকপ্টার সরাবরাহ করবে তুরস্ক।
এই অঞ্চলে পাকিস্তান ছাড়াও আফগানিস্তানের কাছেও অস্ত্র বিক্রির প্রক্রিয়া শুরু করেছে তুরস্ক। এরপর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশকেও। ডিসেম্বরের শেষ সময়ে এসে উত্তর আফ্রিকার মুসলিম দেশ তিউনিসিয়ার কাছে ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির চুক্তি চূড়ান্ত করেছে তুরস্ক।
তিউনিসিয়ার সাথে এই চুক্তি অনুযায়ী ৫টি তুর্কি প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন ধরণের সমরাস্ত্র রফতানি করবে তিউনিসিয়ার কাছে। এসব সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে মাঝারি উচ্চতা ও দীর্ঘ সময় উড্ডয়নে সক্ষম ৩টি আনকা ড্রোন। ড্রোনটি নির্মাণ করছে টার্কিশ অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ। নিজস্ব উদ্ভাবিত এই ড্রোনটি প্রথমবারের মতো রফতানি করতে যাচ্ছে তুরস্ক। ৭০ মিলিমিটারের রকেস্তান সিরিট মিসাইল ও স্মার্ট মাইক্রো মিউনিশন বহন করতে পারে ৮ মিটার লম্বা ড্রোনটি।এছাড়া ড্রোনের জন্য তিনটি গ্রাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেমও নেবে তিউনিসিয়া।
আনকা ড্রোন ছাড়াও তিউনিসিয়ায় রফতানি করতে চলা তুর্কি সমরাস্ত্রের মধ্যে রয়েছে- কিরপি মাইন রেসিস্ট্যান্ড অ্যাম্বুশ প্রটেক্টেড ভেহিকেল, আর্মার্ড ভেহিকেল এবং ট্যাংক। এছাড়া আসেলসানের উদ্ভাবিত ইলেক্ট্রো অপটিক সিস্টেমও কিনবে তিউনিসিয়া।
তুর্কি সমরাস্ত্রের আরেক উল্লেখযোগ্য ক্রেতা ইউক্রেন। ৬টি টিবি টু ড্রোন কিনেছে তারাও। আরো ৫টি সরবরাহ করার কথা রয়েছে ২০২১ সালে। এছাড়া সম্প্রতি ইউক্রেনের নৌ বাহিনীর জন্য করভেট নির্মাণের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে তুরস্ক। তুর্কি প্রযুক্তিতে জাহাজটি নির্মিত হবে ইউক্রেনেরই একটি জাহাজ নির্মাণ কারখানায়।