ড্রোন প্রযুক্তিতে আরও এগিয়ে গেল রাশিয়া

রাশিয়ার টু-নাইন্টি ফাইভকে সঙ্গ দেওয়া স্টেল্থ স্ট্রাইক ড্রোন -

  • মুরশিদুল আলম চৌধুরী
  • ০৩ জানুয়ারি ২০২১, ১৫:৩৩

বিশ্বের বৃহত্তম সামরিক শক্তির নাম যুক্তরাষ্ট্র। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থেকে দেশটির ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে রাশিয়া। দেশ দুটির সামরিক সামর্থ্যরে ব্যবধান সামান্য। যুক্তরাষ্ট্র যখন এগোচ্ছে, তাকে স্পর্শ করা কিংবা ছাড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ঘুম হারাম করছে রাশিয়া। কোনো না কোনোভাবে সে প্রযুক্তি করায়ত্ত করছেন তারা।

ঠিক একই পথে স্টেল্থ স্ট্রাইক ড্রোন প্রযুক্তিও করায়ত্ত করল রাশিয়া। নতুন প্রজন্মের যুদ্ধবিমানের নিয়ন্ত্রণে ড্রোন পরিচালনায় সাফল্যের পর সেকেলে যুদ্ধবিমানের নিয়ন্ত্রণেও এ প্রযুক্তির সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে দেশটি। এখন এই স্টেল্থ ড্রোন শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এড়িয়ে তাদের অবস্থান নির্ণয় করে দেবে রুশ যুদ্ধবিমানকে। আর যুদ্ধবিমান বিপদসীমার বাইরে থেকে দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে শত্রুঘাঁটি ধ্বংস করবে।

এ সংক্রান্ত একটি খবর দিয়েছে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা তাস। খবরে বলা হয়েছে, রাশিয়ার বোমারু বিমান ‘টুপোলেভ টু-নাইন্টি ফাইভ এমএস’-এর ক্রু সম্প্রতি ককপিট থেকে মানবহীন একটি ড্রোনকে ইন-ফ্লাইট নির্দেশনা প্রদানের অনুশীলন চালিয়েছে।

কোন ধরনের ড্রোন এ অনুশীলনে অংশ নিয়েছে, তা খবরে বলা হয়নি। তবে তাস উল্লেখ করেছে, এটি অত্যাধুনিক এস-সেভেনটি ওখোটনিক ‘স্টেল্থ স্ট্রাইক ড্রোন’ কিনা তা প্রতিরক্ষা সূত্র নিশ্চিত যেমন করেনি, অস্বীকারও করেনি।

স্টেল্থ প্রযুক্তি হলো স্বল্প পর্যবেক্ষণযোগ্য টেকনোলজি, সংক্ষেপে এলও প্রযুক্তি। এটি একটি সামরিক কৌশল, যা রাডার, ইনফ্রারেড এবং অন্যান্য শনাক্তকরণ প্রযুক্তি থেকে বিমান, জাহাজ, সাবমেরিন, মিসাইল, উপগ্রহ ও স্থল যানবাহনকে প্রায় অদৃশ্য করে রাখে। যুক্তরাষ্ট্রে আধুনিক স্টেল্থ প্রযুক্তির বিকাশ ১৯৫৮ সালে শুরু হয়েছিল। সে সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে স্নায়ুযুদ্ধে ইউ-টু গুপ্তচর বিমানগুলির রাডার ট্র্যাকিং প্রতিরোধ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় তাদের। এখন এ প্রযুক্তি রাডার সংকেত হ্রাস বা ব্লক করতে সক্ষম।

টুপোলেভ টু-নাইন্টি ফাইভ বোমারু বিমান সোভিয়েত মিলিটারি প্রথম ব্যবহার করেছিল ১৯৫২ সালে। এটিই একমাত্র বিমান, যেটি দীর্ঘকাল ধরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পরবর্তীকালে রাশিয়ার মিলিটারিকে সাহায্য করে যাচ্ছে। মার্কিন বিমান বাহিনীর বি-ফিফটি টু বোমারু বিমানের চেয়ে পুরনো এটি। এখনও টিকে থাকা প্রপেলারযুক্ত একমাত্র বোমারু বিমান টু-নাইন্টি ফাইভ। এখনও প্রায় পঞ্চাশটির বেশি টুপোলেভ টু-নাইন্টি ফাইভ বিমান রাশিয়ার বিমান বাহিনীতে সক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। ন্যাটো এর নাম দিয়েছে ‘বেয়ার’। স্নায়ুযুদ্ধ আমলের আশ্চর্যজনক প্রযুক্তি বলা হয় একে। প্রায় ৭০ বছর ধরে সক্রিয় এ ‘বেয়ার’ এখনও নিয়মিতভাবে আলাস্কায় টহল ও গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। টু-নাইন্টি ফাইভ সবচেয়ে বেশি শব্দ করা বিমানগুলোর মধ্যে একটি। এত বেশি শব্দ হয় যে, একে অনুসরণ করা অন্য জেটের পাইলটরাও নাকি এ শব্দ শুনতে পান।

টু-নাইন্টি ফাইভের সঙ্গ দেওয়া স্টেল্থ স্ট্রাইক ড্রোনের দুটি ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছে সংবাদ সংস্থা তাস। এক. শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে বিভ্রান্ত করা, দুই. টু-নাইন্টি ফাইভের অবস্থান নির্ণয় করে পুনরায় সংযোগ তৈরি করা।

আসলে কী ঘটছে, তা নির্ধারণ করা খুব সহজ নয় এখানে। যদি মনে করা হয়, রাশিয়া শিশুর মতো স্রেফ যুক্তরাষ্ট্রের অনুকরণ করে চলেছে, এটা ভুল হবে। প্রসঙ্গত, ড্রোন এয়ারফেয়ার প্রযুক্তি পরিপক্বতার সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘ডিফেন্স অ্যাডভান্সড রিসার্চ প্রজেক্ট এজেন্সি’ সংক্ষেপে ডারপা ড্রোন-বিষয়ক ‘গ্রেমলিন্স’ প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। ২০১৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় ড্রোন তৈরির চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তারই অংশ হিসেবে বিশ্বে প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক যুদ্ধবিমানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগ করা হয়েছে। অনুষ্ঠিত হয়েছে কৃত্রিম যুদ্ধও। এসি-ওয়ান থার্টি গানশিপেট জন্য ‘অফবোর্ড সেন্সর’ হিসেবে ড্রোন বানিয়েছেন দেশটির বিমানবাহিনী। ড্রোন প্রযুক্তিতে বেশ এগিয়ে গেছে যুক্তরাষ্ট্র।

যদি মনে করা হয়, ড্রোন নিয়ে রাশিয়ার সক্ষমতার অভাব রয়েছে, এটা ভুল হবে। টু-নাইন্টি ফাইভের সীমিত বৈশিষ্ট বিবেচনায় নিয়ে ব্যবহৃত ড্রোনের সামর্থ চিন্তা করা হলে তাও যথার্থ হবে না। নীরবে-নিভৃতে বড় কিছু করার প্রবণতা রাশিয়াকে বেশ সাহসী করে তুলেছে। এখানেও তাই হচ্ছে।

সিএনএ’র বিশ্লেষক এবং রাশিয়ান প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল বেনডেথ মনে বলেন, দুই ধরনের ড্রোন নিয়ে কাজ করছে রাশিয়া- একটি ‘ওখোটনিক’, অন্যটি ‘আলতুইস’। তিনি বললেন, ‘কী ধরনের ড্রোন নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয়েছে, সে ব্যাপারে আমরা তেমন জানি না। আসলে, রাশিয়ার সব চিন্তাই এখন ‘ওখোটনিক’ অথবা ‘আলতুইস’কে কেন্দ্র করে । ওখোটনিক হচ্ছে স্টেল্থ স্ট্রাইক ড্রোন, যা আকাশ থেকে আকাশে হামলার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র বহন ছাড়াও অভিযান পরিচালনা করতে পারে। গত বছর মানববাহী যুদ্ধবিমান সু-ফিফটি সেভেন থেকে এর একটিকে নিয়ন্ত্রণ করা নিয়ে অনুশীলন করা হয়। এর রেঞ্জ ছিল তিন হাজার মাইলেরও বেশি।

২০১৯ সালের জানুয়ারি মাসে ড্রোন রাশিয়ার তৎপরতার খবর জানাজানি হয়। সেই সময় রাশিয়ান সামরিক বিভাগ থেকে এ বিষয়ে কিছুই জানানো হয়নি। এরপর বহুবার খবর প্রকাশ্যে আসে যে, রাশিয়া গোপনে অত্যাধুনিক ড্রোন তৈরির কাজ করছে। অবশেষে দেশটি সেই ড্রোনের ছবি প্রকাশ্যে আনে আট মাস পর। এবারও তাই করা হলো। অনুশীলনের তেমন কিছুই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ পায়নি।

ড্রোন নিয়ে রাশিয়ার দ্বিতীয় যে প্রকল্প, তার নাম ‘আলতুইস’। তিন হাজার মাইলেরও বেশি রেঞ্জে কাজ করবে এ ড্রোন। মার্কিন ‘এমকিউ-ফোর গ্লোবাল হোক’-এর সমমানের। তবে, কয়েক বছর এ ড্রোন সার্ভিসে থাকবে না। যুদ্ধকৌশলে এটি ব্যবহৃত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

বেনডেথ জানান, ওখোটনিক ড্রোন ও সেকেলে টু-নাইনটি ফাইভের সক্ষমতা একসঙ্গে বাড়ানো হতে পারে। এই স্টেল্থ ড্রোন শত্রুপক্ষের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এড়িয়ে তাদের স্থান নির্ণয় করতে পারবে। এতে টু-নাইনটি ফাইভ ডেঞ্জার জোনের বাইরে অবস্থান করে দূরপাল্লার ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে তাদের ধ্বংস করে দেওয়ার সুযোগ পাবে। ড্রোনটির ‘এয়ার টু এয়ার’ সক্ষমতার কারণে টু-নাইনটি ফাইভ শত্রুদের যুদ্ধবিমান থেকে দূরে অবস্থানের সুযোগ পাবে। আধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় টু-নাইনটি ফাইভের সক্ষমতা কম হলেও, কিংবা ওখোটনিকের বোমা বহনে দুর্বলতা থাকলে তারা সমন্বিতভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

মার্কিন নৌবাহিনীর ‘এমকিউ-টোয়েন্টি ফাইভ স্টিনগ্রে’র সঙ্গে এর চমকপ্রদ বৈপরিত্য রয়েছে। মানুষের সামনে থেকে কাজ করার জন্য স্টেল্থ অ্যাটাক ড্রোন হিসেবে এর পরিকল্পনা করা হলেও এরিয়াল ট্যাঙ্কার হিসেবে এখন কাজ করছে এমকিউ-টোয়েন্টি ফাইভ। রাশিয়ানরা যখন যুদ্ধক্ষেত্রে সামনের সারিতে রোবটকে কাজে লাগিয়ে মানবসম্পদকে তাদের পেছনে রাখছে, যুক্তরাষ্ট্র তখন অভিযান থেকে ড্রোনকে দূরে রেখে সেখানে ব্যয়বহুল মানববাহী যুদ্ধবিমান পাঠাচ্ছে।

শেষমেষ, রাশিয়ার এ অনুশীলনের একটি ব্যাখ্যাই থাকতে পারে। সেটা হলো, অন্য এয়ারক্রাফটের সঙ্গে আরও বেশি দূরত্বে থেকে ওখোটনিক ড্রোন সামঞ্জস্য বজায় রাখতে পারে। এটাই হয়তো করে দেখিয়েছেন তারা।

বেনডেথ বলেন, মানববাহী বিমান ও মানবহীন বিমানের সমন্বয়ের প্রযুক্তি এবং ওখোটনিকের অভিযান পরিচালনার সক্ষমতা পরীক্ষার চেয়েও বেশি কিছু ছিল এখানে। এর মাধ্যমে এটাও পরীক্ষা করা হয়েছে যে, এটি শুধু সু-ফিফটি সেভেনের সঙ্গেই ওড়ে না, রাশিয়ার অন্য গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধবিমানের সঙ্গেও এটি সমন্বয় সাধন করতে পারে। তার মানে, ড্রোন নিয়ন্ত্রণকারী যুদ্ধজাহাজের সংখ্যাও স্বয়ংক্রীয়ভাবে বেড়ে গেল।

রাশিয়ার এ অনুশীলনকে সাদামাঠা চোখে দেখার সুযোগ নেই। কীভাবে মানববাহী বিমান ও ড্রোন একসঙ্গে কাজ করে, এটা দেখানোর জন্য একটি ডেমো ফ্লাইট পরিচালনা করতে গিয়ে অনাকাঙ্ক্ষি ভুলের শিকার হয় যুক্তরাষ্ট্রে বিমানবাহিনী। রাশিয়া সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে পুরো ব্যবস্থাকেই ঝালাই করে নিয়েছে।

নাম প্রকাশ না করে প্রকাশিত এক কর্মকর্তার বক্তব্য এখানে প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, টু-নাইন্টি ফাইভ নিয়ে করা পরীক্ষা ঠিকঠাক সম্পন্ন হয়েছে। রাশিয়া মানবহীন যুদ্ধব্যবস্থা উন্নত করার প্রতিও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এ কাজে বিপুল লোক নিয়োগ করা হয়েছে। প্রাচীন টু-নাইনটি ফাইভ হয়তো এর মাধ্যমে দ্বিতীয় জীবন লাভ করল। কৌশলগত বোমারু বিমান হিসেবে নয়, স্টেল্থ অ্যাটাক ড্রোনের জন্য নিয়োজিত স্কেয়াড্রনগুলোর উড়ন্ত নিয়ন্ত্রণকেন্দ্র হিসেবে এখন সদম্ভে উড়তে পারবে টু-নাইনটি ফাইভ যুদ্ধবিমান।

রাশিয়ার সামরিক ঝুলিতে যুক্ত হলো আরও একটি সাফল্য। প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্রকে চিন্তিত করার কাজটাও ভালোভাবে সেরে নিল প্রায় ৩০ লাখ সেনাসদস্যের দেশটি। ১ হাজার ২৬৪টি যুদ্ধবিমান, ১৯৫টি বোমারু বিমান, ১ হাজার ২৬৭টি জঙ্গিবিমান, ১ হাজার ৬৫৫টি সাঁজোয়া হেলিকপ্টার এবং ১২ হাজার পরমাণু অস্ত্রসমৃদ্ধ রাশিয়া বিশ্বরাজনীতিতে প্রভাব বলয় বাড়ানোর ক্ষেত্রে আরও এক ধাপ এগিয়ে গেল। আরও একটি সামরিক প্রযুক্তি যুক্ত হলো তাদের বিক্রিপণ্যের তালিকায়।