আফগানিস্তানে ১৮ বছর একটানা যুদ্ধের পর মার্কিন সূর্যের চূড়ান্ত অস্ত ঘটতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে আফগানিস্তান থেকে সকল সৈন্যকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এ সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে আপাত ফায়দা পেতে যাচ্ছে আফগানিস্তানের প্রতিবেশি দেশ ইরান। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের সাথে আফগান তালেবানদের সর্বশেষ যে সমঝোতা বৈঠকটি হয়েছে, ইরান তা ভালোভাবে নেয়নি। যুক্তরাষ্ট্র সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তে অটল আছে। কারণ এরই মধ্যে মার্কিন নাগরিকের করের টাকা থেকে এই যুদ্ধে দুই ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি পরিমান অর্থ ব্যয় হয়ে গেছে। বিডি ভিউজ ইনফোটেইনমেন্টে স্বাগত জানাচ্ছি আমি---। যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার থেকে ইরান কিভাবে লাভবান হচ্ছে আজ জানাবো সেই বিশ্লেষণ।
কাতারের রাজধানী দোহায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে ৯ দফা সমঝোতা বৈঠকের পর ট্রাম্প প্রশাসন এবং তালেবান কর্তৃপক্ষ একটি শর্তযুক্ত সমঝোতায় আসতে সক্ষম হয়। মূলত চারটি ইস্যুকে সামনে রেখে এ সমঝোতা চুড়ান্ত হয়। এগুলো হলো দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধবিরতি। আফগান জাতিগোষ্ঠীগুলোর মধ্যকার আন্ত:সংলাপ। আল কায়েদার সাথে তালেবানদের সম্পর্কচ্ছেদ। এবং পরবর্তী ১৪ মাসের মধ্যে আফগান মাটি থেকে সকল বিদেশী সেনাদের প্রত্যাহার।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মার্চ মাসের এক তারিখেই এ চুক্তির বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। ইরানের মতে, এ চুক্তির মাধ্যমে দীর্ঘ ১৮ বছর আফগান মাটিতে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতিকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু আফগানিস্তানের ঘরোয়া শান্তি প্রতিষ্ঠায় চুক্তি প্রণয়নের কোনো অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই। তারা কোনোভাবেই আফগানিস্তানের ভবিষ্যত নির্ধারন করতে পারে না বলেও দাবি করে ইরান। বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান ঠিক চুক্তির শর্ত বা বিষয়াবলীর কারণে এর বিরোধিতা করেনি। বরং তালেবানদের সাথে তাদের এতদিনের সম্পর্কের আদলে কথা বলেছে।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, যদি আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র আসলেই সকল সেনা প্রত্যাহার করে নেয়, তাহলে এর তাৎক্ষনিক ফায়দা পাবে ইরান। কেননা, ইরান তখন আফগান মাটিতে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হবে। আফগান জনগণের মাঝে মার্কিন বিরোধী ক্ষোভকে নিজেদের মতো করে কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে।
লন্ডনভিত্তিক এশিয়া-প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিভাগের পরিচালক ড. সাজ্জান গোহেল বলেন, ইরান দোহা চুক্তিকে প্রত্যাখান করেছে কারণ যুক্তরাষ্ট্র জড়িত এমন কোনো চুক্তিকে অনুমোদন করতে চায় না তেহরান। তবে বাস্তবতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র নিকট ভবিষ্যতে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়ায় ইরানের বর্তমান প্রশাসন বরং সন্তুষ্টই হয়েছে।
বিগত কয়েক বছর ধরেই ইরানের রেভিাউলিশনারী গার্ডের সাথে তালেবানদের একটি সহনশীল ও কৌশুলী সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। এর অংশ হিসেবে ইরান তালেবান জোটকে নানা ধরনের সমরাস্ত্র দিয়ে সহযোগিতাও করেছে যাতে তালেবান সদস্যরা আফগানিস্তানে বহুজাতিক সেনাদের ওপর হামলা চালাতে পারে।
১৯৯০ সালের পর থেকে ইরানের সাথে তালেবানদের সম্পর্কে টানাপোড়েন চললেও সা¤প্রতিক সময়ে দুই পক্ষের মাঝে সম্পর্ক অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। ১৯৯৮ সালে তালেবান সদস্যরা আফগান শহর মাজারি শরিফ দখল করে নেয় এবং ইরানের কনসুলেটে আক্রমন করে। এ সময় ইরানসহ বেশ কয়েকটি দেশের কুটনৈতিক কর্মকর্তাদেরকেও তারা জিম্মি করে। ইরানের একজন সাংবাদিক মাহমুদ সারেমি এসময় আটক হয়, যাকে পরবর্তীতে হত্যাও করা হয়।
ইরান এ সব ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে আফগান সীমান্তে ৭০ হাজার সেনা এবং ১৫০টি ট্যাংক মোতায়েন করে। নতুন করে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পরবর্তীতে ইরানের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মাদ খাতামী এবং জাতিসংঘের বিশেষ দূত লাখদার ব্রাহিমির মধ্যস্থতায় তালেবানরা ইরানের ২৬ জন বন্দীকে মুক্তি দেয়। এছাড়া যারা ইরানি সাংবাদিককে হত্যা করেছিল তাদের শাস্তি নিশ্চিত করারও প্রতিশ্রুতি দেয়।
২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী বিরোধী যুদ্ধ শুরু করার পর ইরান হঠাৎ করেই মার্কিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ জুনিয়রের প্রশাসনের সাথে সম্পর্ক গড়ে। উভয়পক্ষ যৌথভাবে তালেবানদেরকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করে। একই বছর, জাতিসংঘের সহায়তায় তালেবান ও মার্কিন প্রশাসন বণ চুক্তিতে সম্মত হয়। এ চুক্তি অনুযায়ী আফগানিস্তানে রাষ্ট্রীয় কাঠামো পুননির্মান এবং আফগান উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের বিষয়টিও চূড়ান্ত হয়।
ইরাক ও আফগানিস্তানে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত রায়ান ক্রকার এবং ইরানের সামরিক বাহিনীর তৎকালীন কমান্ডার কাসেম সোলাইমানি মিলেই নাইন ইলেভেন পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ইরানের সমঝোতা সংলাপগুলোর আয়োজন করেন। কাসেম সোলাইমানিকে এ বছরের শুরুর দিকে মার্কিন বাহিনী বাগদাদের নিকটবর্তী একটি এলাকায় ড্রোন হামলা চালিয়ে হত্যা করে।
নাইন এলিভেন পরবর্তী সময়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের এ হৃদ্যতার মূল কারণ ছিল দুদেশই একই এজেন্ডা নিয়ে তখন কাজ করছিল। তারা যেমন তালেবানদেরকে হটাতে চেয়েছিল ঠিক তেমনি আবার আফগানিস্তানে লুকিয়ে থাকা আল কায়েদার মাস্টারমাইন্ডদেরকেও শায়েস্তা করতে আগ্রহী ছিল।
তালেবানরা প্রবলভাবে শিয়া মতাদর্শের বিরোধী। অভিযোগ আছে আফগানিস্তানে শিয়া হাজারা সম্প্রদায়ের বহুলোককে তালেবনার হত্যা করেছে। ফার্সি ভাষী হওয়ায় তাদের সাথে ইরানের সাংস্কৃতিক নৈকট্যও গভীর। বর্তমানে শুধু ইরানেই আফগানিস্তানের ২৫ লাখ উদ্বাস্তু বসবাস করছে যাদের বেশিরভাগ হাজরা সম্প্রদায়ের।
তালেবান দমনে ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ম্পক বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ২০০২ সালে স্টেট অব ইউনিয়ন এড্রেসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরানকে ইরাক ও উত্তর কোরিয়ার সাথে মিলিয়ে শয়তানের চক্র বলে অভিহিত করেন। এ তিনটি দেশকে বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য হুমকি বলে ঘোষণা করেন, তখন থেকেই ইরানের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ততায় রূপ নেয়।
এরপর থেকে ইরান আবার তার আঞ্চলিক ফ্যাক্টরগুলোকে বিশেষ করে তালেবান ও আফগান পরিস্থিতিকে নতুন করে মুল্যায়ন করতে শুরু করে। ২০০৫ সালে কট্টরপন্থী মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ইরানের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ওয়াশিংটনের সাথে ইরানের দুরত্ব আরো বেড়ে যায়। ইরান হঠাৎ করেই আবিস্কার করে যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন তাদেরকে তালেবানদের মতোই হার্ডলাইনার হিসেবে বিবেচনা করছে।
২০০৭ সালে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র সর্ম্পক অরো অবনিত হয়। তৎকালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনি তেহরানকে সতর্ক করেন, যদি ইরান ভবিষ্যতে মার্কিন স্বার্থবিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত হয় তাহলে ওয়াশিংটন তার নৌ সক্ষমতাকে ব্যবহার করে ইরানী লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা চালাবে। ডিক চেনির মন্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ইরানের রেভিাউলিশনারী গার্ডের কমান্ডার জেনারেল মোহাম্মাদ আলী জাফারি বলেন, যদি ইরান কোনো ধরনের হামলার শিকার হয় তাহলে আফগানিস্তানসহ এ অঞ্চলের যত জায়গায় মার্কিন ঘাটি ও স্থাপনা আছে- সবগুলোতেই হামলা চালানো শুরু করবে।
এরপর থেকেই ইরানের সাথে আবার তালেবানদের সখ্যতা শুরু হয়। আফগানিস্তানের উরুজগান প্রদেশের পুলিশ প্রধান জেনারেল মুহাম্মাদ হায়া জানান, ইরানের রিভোলিউশনারী গার্ড এ সময় নিয়মিতভাবে তালেবানদেরকে বিমান বিধ্বংসী মিসাইল সরবরাহ করছে।
কানাডার রয়াল মিলিটারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর এমিরিটাস হাওচাং হাসান ইয়ারি মনে করেন, যদিও তালেবানদের সাথে ইরানের আদর্শগত কোনো মিল নেই। কিন্তু তারা এখন একসাথে কাজ করছে কারণ ঊভয়ের শত্রু এখন একই। যদি তালেবানদেরকে নিয়ে আফগানিস্তানে কোনো জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে ইরান তাকে স্বাগত জানাবে। আর দোহা চুক্তির পর এরকম একটি ঐকমত্যের সরকার এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
হাসান ইয়ারির মতে আফগানিস্তানন থেকে ইরান এখন তিনটি বিষয় প্রত্যাশা করছে। প্রথমত, আমেরিকার সেনাদের প্রত্যাহার। দ্বিতীয়ত কাবুলে একটি ইরান অনুকূল সরকার প্রতিষ্ঠা করা যারা ওয়াশিংটনের সাথে দুরত্ব বজায় রাখবে। তৃতীয়ত আফগানিস্তানে বসবাসরত শিয়া সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যগুলো অর্জনে ইরান যেকোনো কিছুই করতে তৈরি।
তালেবানদের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যে সমঝোতা হয়েছে তার মধ্যে একটি শর্ত হলো আফগান মাটিতে সহিংসতা কমানো। এরই অংশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালের মধ্যে মোতায়েন থাকা সেনার সংখ্যা ৪ হাজার ৫শ থেকে কমিয়ে আড়াই হাজারে নিয়ে আসবে আর পরবর্তী ১৪ মাসের মধ্যেই সকল সেনা প্রত্যাহার করে নেবে।
ট্রাম্প এ প্রস্তাবে সম্মত হলেও তিনি কংগ্রেস থেকে যথেষ্টই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন। এমনকি রিপাবলিকান দলের অনেক সিনিয়র নেতারাও তাকে সমর্থন করেননি। তাদের মতে আফগান থেকে সব সেনা প্রত্যাহার করে নিলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররা হুমকির মুখে পড়বে এবং মার্কিনীদের শত্রুরা সুবিধাজনক অবস্থায় চলে যাবে। তবে যখনই এ সেনাদেরকে উঠিয়ে নেয়া হোক না কেন, এমনটা হলে ইরানীদের পক্ষে আফগানিস্তানে একটি শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করে নেয়া সম্ভব হবে। নিজেদের সামরিক ও আদর্শিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রেও আফগানিস্তানকে প্রকৃতির হিসেবে ব্যবহার করতে পারে ইরান। তবে, মার্কিন সেনারা চলে গেলে ইরান শুধুমাত্র আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলেই নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারবেন। ইরান ছাড়াও রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তানও মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ওপর নজর রাখছে। এসব দেশও এর সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে