সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত সমরাস্ত্র এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বা আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এটিকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নামেও ডাকা হয়। তুরস্ক রাশিয়ার তৈরি এস-ফোর হান্ড্রেড কেনার পর থেকেই বিশ^জুড়ে এই সমরাস্ত্র নিয়ে ব্যপক আলোচনা শুরু হয়।
আকাশপথে শত্রুর হুমকি মোকাবেলায় তৈরি করা হয় এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। বর্তমান সময়ে নিজস্ব ভূখন্ডের সুরক্ষায় সব দেশই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে। যার ফলে কে কতটা উন্নত আর শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম তৈরি করতে পারে সেই প্রতিযোগীতাও চলছে বিশ্বে।
চীনের তৈরিএইচকিউ-নাইন এন্টি এয়রাক্রাফট মিসাইল সিস্টেম উদ্ভাবন করা হয়েছে শত্রুর বিমান, ক্রুজ মিসাইল ও হেলিকপ্টার ধ্বংস করার জন্য। আকাশ থেকে নিজস্ব ভূখন্ডের ওপর কোন হামলা বা হামলা করতে আসা আকাশ যান চিহ্নিত করে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়বে এটি। যে কোন উচ্চতা, যে কোন আবহাওয়ায়- অন্ধকার কিংবা আলোতে সমান তালে কাজ করতে পারে এটি।
তৃতীয় প্রজন্মের এন্টি এয়ারক্রাফট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের খুবই অগ্রসর একটি ভার্সন এইচকিউ নাইন। শত্রুর ফাইটার জেট থেকে সৃষ্ট জ্যামিংও এটিকে সহজে আটকাতে পারবে না। আবার একসাথে অনেকগুলো ফাইটার উড়ে এলেও এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম তা মোকাবেলা করতে পারে। এর পাল্লা ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। শব্দের চেয়ে চারগুণ গতিতে এর ছোড়া মিসাইল ছুটে যাবে শত্রæর বিমান লক্ষ্য করে। এটি থেকে স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার দুই ধরনের মিসাইল ছোড়া যায়। এর রয়েছে মোট ৫টি মিসাইল লঞ্চ প্ল্যাটফর্ম।
আবার ভূমি থেকে ভূমিতে ছোড়া ট্যাকটিকাল ব্যালেস্টিক মিসাইলও সনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে এইচকিউ-নাইন। এটি প্রস্তুত করেছে চায়না প্রিসিশন মেশিনারি ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট করপোরেশন। ১৯৯৭ সাল থেকে এটি চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি ও নেভীকে সেবা দিয়ে যাচ্ছে।এর প্রতিটির নির্মাণ ব্যয় আনুমানিক ২০ লাখ মার্কিন ডলার।
২০০৯ সালের মার্চে কেপটাউনে আফ্রিকা অ্যারোস্পেস এন্ড ডিফেন্স এক্সিবিশনে এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের নতুন একটি সংস্করণ প্রদর্শন করে প্রতিষ্ঠানটি। এফটি- টু থাউজেন্ড নামের এই সংস্করণটি রেডিয়েশন প্রতিরোধী। এটি রফতানি করবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে চীন। তবে নতুন এই সংস্করণটি এখনো মোতায়েনের উপযোগী হয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবিত এয়ার ডিফেন্স এসএএম এমএম ওয়ান জিরো ফোর। সংক্ষেপে প্যাট্রিয়ট নামেই পরিচিত এটি। আকাশপথে শত্রুর আক্রমণ থেকে গুরত্বপূর্ণ এলাকা, সামরিক ঘাটি, শিল্প এলাকা, প্রশাসনিক এলাকার সুরক্ষা দিতে এটি মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি একই সাথে একশোর বেশি টার্গেট চিহ্নিত করেত পারে।
প্যাট্রিয়টের রাডার একইসাথে আটটি টার্গেটের গতিবিধি অনুসরণ করতে পারে। পাশাপাশি তথ্য সংগ্রহ করে ফায়ারিংয়ের প্রস্তুতি নিয়ে প্রতিটি টার্গেটে তিনটি করে মিসাইল ছুটতে পারে একই সাথে।ক্ষেত্রভেদে প্যাট্রিয়টে চার থেকে ৮টি মিসাইল লঞ্চার থাকে। শত্রæর বিমান ছাড়াও ছুটে আসা ব্যালেস্টিক মিসাইল সনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে এটি। এর রয়েছে হাই পারফরম্যান্স রাডার সিস্টেম, যা যে কোন আবহাওয়ায় কাজ করতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা রেথন টেকনোলজিস কর্পোরেশন এটি তৈরি করেছে। পূর্ববর্তী হকমিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম সরিয়ে ১৯৬৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্যাট্রিয়ট মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের উন্নয়ন শুরু করে। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীতে এটি ব্যবহারের জন্য মোতায়েন করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও কিছু ন্যাটো সদস্য দেশের কাছে এটি বিক্রি করেছে ওয়াশিংটন। এছাড়া সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার জাপানসহ কয়েকটি দেশেও আছে প্যাট্রিয়ট। তুরস্ক এটি কিনতে চাইলেও বিক্রি করেনি যুক্তরাষ্ট্রের বারাক ওবামা প্রশাসন। এর কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে। সংস্করণ ভেদে প্রতিটি প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্রের নির্মাণ খরচ ২০ থেকে ৩০ লাখ মার্কিন ডলার।
ফ্রান্স ও ইতালির যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিরক্ষা পণ্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইউরোসাম ২০০১ সালে প্রস্তুত করে এসএএমপি টি কমপ্লেক্স নামের একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। সংক্ষেপে অ্যাস্টার নামেই ডাকা হয় এটিকে। এর রয়েছে দুটি ভার্সন। স্বল্প পাল্লার অ্যাস্টার ফিফটিন ও দূর পাল্লার অ্যাস্টার থার্টিন।
আকাশ পথে আসা যে কোন ধরণের হুমকি মোকাবেলায় এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমটি গড়ে তোলা হয়েছে। ফাইটার জেট, মিসাইল, ড্রোন সব কিছুই সনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে এটি। এর রয়েছে পৃথক ল্যান্ড ও ম্যারিটাইম লঞ্চিং প্ল্যাটফর্ম। যে কারণে এটি স্থল ও সমুদ্র দুই জায়গাতেই স্থাপন করা যায়। সমুদ্রে ডেস্ট্রয়ার ও ফ্রিগেটে এটি মোতায়েন করা যায়। জাহাজ লক্ষ্য করে ছুটে আসা সুপারসনিক এন্টিশিপ ক্রুজ মিসাইল ভূপাতিত করতে পারে বিপদসীমার বাইরে থেকেই।
দেড় হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত ব্যালেস্টিক মিসাইল ধ্বংস করতে পারে এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। তবে এর পাল্লা বাড়িয়ে ৩ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।অ্যাস্টারের রয়েছে থ্রিডি ফেস অ্যারে রাডার। এর রাডার যে কোন আবহাওয়ায় কাজ করতে পারে। এই মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম থেকে ছোড়া রকেট শব্দের চেয়ে চারগুণ গতিতে ছুটে যেতে পারে টার্গেট লক্ষ্য করে।
ফ্রান্স, ইতালির পাশাপাশি ব্রিটেনের কাছেও রয়েছে অ্যাস্টার মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম। এছাড়া এটি বিক্রি করা হয়েছে আলজেরিয়া, মিসর, কাতার, সৌদি আরব ও সিঙ্গাপুরের কাছে। কানাডা, সুইজারল্যান্ড ও তুরস্ক এটি কেনার ব্যাপারে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরাইলের হাতে আছে ডেভিড স্লিং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। যেটিকে এক সময় ডাকা হতো ম্যাজিক ওয়ান্ড নামে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষা সামগ্রী নির্মাতা প্রতিষ্ঠান রাফায়েল এর সাথে যৌথভাবে এটি নির্মাণ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের রেথিয়ন। ৪০ থেকে ৩০০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ফাইটার জেট, ড্রোন, ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ মিসাইল সনাক্ত করে ধ্বংস করতে পারে ডেভিড স্লিং।
ডেভিড ¯স্লিং মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমটি ২০১৭ সালে পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে। তবে পূর্ণ মাত্রায় সেবা দিতে আরো কয়েক বছর লাগবে। ইসরাইলের হাতে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের হক ও প্যাট্রিয়টের বদলে এটিকে মোতায়েন করার পরিকল্পনা রয়েছে তেল আবিবের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের। ইসরাইলের নিজস্ব উদ্ভাবিত অ্যারো টু, অ্যারো থ্রি, আয়রন ডোম, আয়রনবিম ও বারাকু এইটের পাশাপাশি এটি মোতায়েন করা হলে ইসরাইল স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের দিক থেকে।
রাশিয়ার ইস্কান্দার, চীনের ডিএফ-ফিফটিনসহ আধুনিক সব ক্ষেপণাস্ত্রই এর কাছে পরাস্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ডেভিড স্লিং এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য ইসরাইল প্রকাশ করেনি। যতটুকু জানা যায়, এর রয়েছে ইলেকট্রোনিক্যালি স্ক্যানিং মাল্টিমুড রাডার। ডেভিড স্লিংয়ের সলিড ফুয়েল রকেট বুস্টার ও জ্যামিং সিস্টেমও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এর রয়েছে তিনটি রকেট লঞ্চিং ব্যাটারি। যার সাহায্যে ছোড়া হবে দুই ধাপের রকেট। এগুলোর সর্বোচ্চ পাল্লা ১৬০ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ গতিসীমা কত হবে সেটিও গোপন রেখেছে ইসরাইল।
২০১৯ সালে এটির সাহায্যে সিরিয়া থেকে ইসরাইলের ভূখন্ড লক্ষ্য করে ছোড়া দুটি মিসাইল ভ‚পাতিত করা হয়েছে বলে জানা যায়। ইসরাইলের কাছ থেকে ভারত এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমটি কিনতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে। এছাড়া ইরানকে মোকাবেলায় কয়েকটি আরব দেশও এ ব্যাপারে আগ্রাহ দেখাচ্ছে বলে কথিত আছে। যদিও বিষয়টি এখনো স্পষ্ট নয়।
এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের জগতে সবচেয়ে আলোচিত রাশিয়ার তৈরি এস-ফোর হান্ড্রেড ট্রাইয়াম্ফ। প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিতে এটি সবচেয়ে শক্তিশালীও। যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধ উপেক্ষা করে তুরস্ক রাশিয়ার কাছ থেকে এস-ফোর হান্ড্রেড কেনার পরই হৈচৈ শুরু হয় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের মধ্যে এটিকেই সেরা বলে মনে করা হয়।
২০০৭ সালে রাশিয়া এস থ্রি হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমকে আরো আধুনিক করে উদ্ভাবন করেছে এস-ফোর হান্ড্রেড। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আলমাজ আন্তে’র করা নকশায় এটি তৈরি করেছে ফাকেল মেশিন বিল্ডিং ডিজাইন ব্যুরো। প্রতিটি এস-ফোর হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের নির্মাণ খরচ ৩০০ মিলিয়ন বা ৩০ কোটি মার্কিন ডলার।
এর প্রতিটি ইউনিটে থাকে ৮৯টি মিসাইল লঞ্চার, ১২০টি মিসাইল ও কমান্ড এন্ড সাপোর্ট ভেহিকেল। এর রয়েছে চার ধরনের মিসাইল ছোড়ার ক্ষমতা। ভেরি লং রেঞ্চ ৪০০ কিলোমিটার পর্যন্ত, লং রেঞ্জ ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত, এছাড়া মিডিয়াম ও শর্ট রেঞ্জে যথাক্রমে ১২০ ও ৪০ কিলোমিটার দূরত্বের টার্গেটে আঘাত হানার ক্ষমতা।
আবার এর মিসাইল লঞ্চিংয়ে ব্যবহার করা হয়েছে গ্যাস সিস্টেম। লঞ্চ টিউব থেকে এই গ্যাসের শক্তিতে ৩০ মিটার পর্যন্ত যাওয়ার পর রকেটের নিজস্ব ইঞ্জিন চালু হয়। যে কারণে রকেটের গতি ও দূরত্ব অতিক্রমের ক্ষমতা বেড়ে যায়। যুদ্ধবিমান, ড্রোন, ক্রুজ মিসাইল ছাড়াও স্থল টার্গেটের উদ্দেশ্যও ছোড়া যায় এস-ফোর হান্ড্রেড। খুব নিচু হয়ে আসা ক্রুজ মিসাইলওএর রাডার ও সেন্সরকে ফাঁকি দিতে পারে না। একই সাথে ১০০টি টার্গেট সনাক্ত করতে পারে এটি। আর টার্গেট সনাক্ত করতে পারে আকাশে ১০০ কিলোমিটার উচ্চতা পর্যন্ত। এস-৪০০ একই সময়ে ৩৬টি লক্ষবস্তুতে আঘাত হানতে পারে। এক ক্লিকেই৭২টি রকেট ছুড়তে সক্ষম।
এটির রয়েছে দীর্ঘ এলাকাজুড়ে জ্যামিং তৈরির ক্ষমতা যে কারণে শত্রুর রাডার ও গোয়েন্দা বিমান কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে না। আবার শত্রুর জ্যামিং ভেদ করার ক্ষমতাও রয়েছে এর।
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক সাইমন ওয়াজেমানের ভাষায়, এস-৪০০ হচ্ছে এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সর্বাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। পশ্চিমারা এখন পর্যন্ত যা তৈরি করেছে তার চেয়ে অনেকগুন উন্নতএটি। এটির রাডার, ক্ষেপণাস্ত্র কিংবা অন্যান্য সেন্সরের ক্ষমতা অনেক বেশি।
বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে