যারা টাকার বিনিময়ে যুদ্ধ করে

বর্তমান বিশ্বের বিখ্যাত নিরাপত্তা ঠিকাদারি কোম্পানিগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাকাডেমি’। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটির শুরুতে নাম ছিলো ‘ব্ল্যাকওয়াটার’ - পলিটিকো ডটকম

  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৩:৪৯

বিশ্বের প্রায় সব দেশেরই আছে সামরিক বাহিনী। কোনো দেশেরটা আয়তনে বিশাল, কোনোটা বা ছোট। রাষ্ট্রীয় প্রতিরক্ষা কিংবা দেশের বাইরে যে কোনো যুদ্ধে ডাক পরে সামরিক বাহিনীর; কিন্তু রাষ্ট্রীয় এই সামরিক বাহিনীর বাইরেও আছে এক শ্রেণির যোদ্ধা, যাদের বলা হয় মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধা। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সৈন্যদের প্রাণহানী এড়াতে ভাড়া করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় এসব সৈন্যদের।

সশস্ত্র সৈনিক তারা। তবে নেই কোনো জাতিগত কিংবা আদর্শিক আনুগত্য। যে কোম্পানি বেতন দেয় আর যে ক্লায়েন্টের সাথে কোম্পানিটির চুক্তি হয়- এই দুইয়ের নির্দেশ পালন করতে ঝাপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। একটাই পরিচয় তাদের- ভাড়াটে যোদ্ধা। যে কোনো দেশ বা সংস্থার হয়ে যুদ্ধ করে, বিনিময়ে পায় অর্থ। এই সৈনিক বা যোদ্ধা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বলা হয় নিরাপত্তা ঠিকাদার- ইংরেজিতে সিকিউরিটি কন্ট্রাক্টর। নিজস্ব সৈনিকদের প্রাণহানী এড়াতে অনেক দেশই যুদ্ধে ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহার করছে।

বিভিন্ন দেশে বেসরকারি সামরিক ঠিকাদার বা পিএমসি প্রতিষ্ঠান আছে যারা যোদ্ধা সরবরাহ করে। সামরিক প্রশিক্ষণ আছে কিংবা অস্ত্র চালাতে জানে এমন লোকদের নিয়ে বাহিনী তৈরি করে প্রতিষ্ঠানগুলো।

কখনো কখনো নিজেরাও প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করে যোদ্ধা। মাসিক, বাৎসরিক বেতন কিংবা অ্যাসাইনমেন্টভিত্তিক পারিশ্রমিকে নিয়োগ করা হয় এই লোকদের। পছন্দের শীর্ষে থাকেন সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্যরা।

বর্তমান বিশ্বের বিখ্যাত নিরাপত্তা ঠিকাদারি কোম্পানিগুলোর একটি যুক্তরাষ্ট্রের ‘অ্যাকাডেমি’। ১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিটির শুরুতে নাম ছিলো ‘ব্ল্যাকওয়াটার’। এটির প্রতিষ্ঠাতা মার্কিন নেভি-সিল ফোর্সের সাবেক কর্মকর্তা এরিক প্রিন্স। নর্থ ক্যারোলিনায় ৭ হাজার একর জায়গা জুড়ে প্রতিষ্ঠানটির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে।

এছাড়া আরো কয়েকটি পৃথক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে সংস্থাটির। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থাকে চুক্তিভিত্তিক নিরাপত্তা সহযোগিতা দেয় সংস্থাটি।

যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে আফগান ও ইরাক যুদ্ধে লড়াই করেছে এই প্রতিষ্ঠানটির সৈনিকরা। এছাড়া বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীকে উন্নত প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকে সংস্থাটি।

২০০৩ সালে বাগদাদে আটকে পড়া ৬ ব্রিটিশ আইনজীবীকে অক্ষত উদ্ধার করে আলোচনায় এসেছিল ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের সদস্যরা।

এছাড়া সিরিয়া, লিবিয়া, ইউক্রেন ও ইয়েমেন যুদ্ধেও ব্যবহৃত হচ্ছে এমন ভাড়াটে যোদ্ধা। রাশিয়ার স্লোভোনিক কর্পস, যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারস্কানও এই সময়ের আলোচিত নিরাপত্তা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।

লিবিয়ার বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের বাহিনীর হয়ে দেশটির গৃহযুদ্ধে দীর্ঘদিন কাজ করেছে রাশিয়ার নিরাপত্তা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওয়াগনার গ্রুপের সৈন্যরা। ২০১৯ সালের শেষ দিকে রাজধানী ত্রিপোলি অভিমুখে হাফতার বাহিনীর সামরিক অভিযানের বড় ভূমিকা ছিলো ওয়ানগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের।

যুদ্ধক্ষেত্রে ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহার করা নতুন কোনো আইডিয়া নয়। সামরিক গবেষকদের মতে, ভাড়াটে সৈনিক পেশাটি বিশ্বের দ্বিতীয় প্রাচীনতম পেশা। ইতিহাসের সব শাসকরাই নিজেদের নিয়মিত সৈনিকদের বাইরেও ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহার করতেন।

পিটার ডব্লিউ সিঙ্গারের ‘কর্পোরেট ওয়ারিয়র্স’ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘নথিভূক্ত আছে এমন ইতিহাসের মধ্যে সর্বপ্রথম প্রাচীন মেসোপটমিয়ার উর রাষ্ট্রের সুমেরীয় রাজা শুলঘি ভাড়াটে সৈন্যদের কাজে লাগান। খ্রিস্টপূর্ব ২০৯৪ অব্দ থেকে ২০৪৭ অব্দ পর্যন্ত ছিল তার শাসন কাল।

পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের বিখ্যাত সুইস গার্ড বাহিনীতে ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহারের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এই সৈন্যদের কখনো ‘ভাড়াটে বন্দুক’ নামেও ডাকা হতো।

আধুনিক ইতিহাসে এই সেক্টরের যাত্রা শুরু ব্রিটিশদের হাতে। ১৯৬৫ সালে ব্রিটিশ বিমান বাহিনীর একদল সাবেক কর্মকর্তা গড়ে তোলেন ওয়াচগার্ড ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি প্রতিষ্ঠান। যেটি সত্তরের দশকে লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফিকে উৎখাতের ব্যর্থ প্রচেষ্টাসহ অনেক ঘটনার সাথে জড়িত।
আধুনিক বিশ্বে খুব দ্রুতই বেড়েছে এর ব্যবহার।

একের পর এক দেশ এই কৌশল অবলম্বন করেছে যুদ্ধক্ষেত্রে। বিশেষ করে ম্নায়ুযুদ্ধের পর সৈন্য ভাড়া করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানোর প্রবণতা বাড়তে থাকে দ্রুত। চাহিদার কারণেই বিশ্বে অনেক নিরাপত্তা ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে, যারা বেসরকারি সেনাবাহিনী গঠন, অর্থায়ন ও তাদের প্রশিক্ষণ দেয়। যুদ্ধের গতিবিধি পরিবর্তন ও বিশ্ব অর্থনীতির বেসরকারিকরণ বৃদ্ধির কারণেই মূলত এই সেক্টরটি চাঙ্গা হয়েছে।

মার্কিন লেখক ও সামরিক বিশেষজ্ঞ শন ম্যাকফেট তার বিখ্যাত বই ‘দ্য মর্ডান মার্সেনারি’তে বলেছেন, ২০০৮ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে বিশ্বে নিরাপত্তা ঠিকাদারের সংখ্যা ৬৭ হাজারে পৌছায়, অর্থাৎ দুই বছরে এই সংখ্যা বেড়েছে পূর্বের তুলনায় ৪১ শতাংশ।

নিরাপত্তা ঠিকাদরি ব্যবসায়ের আধুনিকায় ব্রিটিশদের হাত ধরে হলেও এর ব্যবহারের পথিকৃত যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্র এই ভাড়াটে সৈন্যদের ওপর এতোটাই নির্ভরশীল যে, এদের ছাড়া কোনো যুদ্ধের কথা চিন্তাই করে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রর সৈন্যদের ১০ শতাংশ ছিলো ভাড়াটে; কিন্তু ইরাক ও আফগান যুদ্ধে এই সংখ্যা বেড়েছে অন্তত ৫ গুণ। মার্কিন সরকার ও তাদের বিভিন্ন সংস্থা নিরাপত্তা ঠিকাদারদের প্রধান ক্লায়েন্ট।

যুক্তরাষ্ট্রের দেখা দেখি বিভিন্ন দেশের সরকার ও তাদের বিভিন্ন সংস্থা ভাড়াটে সৈনিকদের কাজে লাগাতে শুরু করে। আসলে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতো সঙ্ঘাতগুলোতে সৈন্যদের মৃত্যুর হার দেখেই এই বিকল্প সৈন্যদের বেছে নিয়েছে রাষ্ট্রগুলো। টাকা দিয়ে যদি ভাড়াটে লোক পাওয়া যায়, তাহলে কেনবা নিজস্ব সৈনিকদের ঠেলে দেয়া হবে প্রাণঘাতি সঙ্ঘাতে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতও প্রচুর ভাড়াটে সৈন্য ব্যবহার করে। ইয়েমেন যুদ্ধে দেশটি যে বাহিনী নিয়োগ করেছে তার বড় একটি অংশ ভাড়াটে। ২০১৫ নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক নিউ ইয়র্ক টাইমস এক রিপোটে বলেছে, ইয়েমেনে কয়েকশো লাতিন ভাড়াটে যোদ্ধা পাঠিয়েছে আরব আমিরাত। যারা পানামা, চিলি ও এলসালভাদরের নাগরিক।

এমনকি জাতিসঙ্ঘও তাদের কিছু কাজে ভাড়াটে সৈন্যদের ব্যবহার করে, এক্ষেত্রে লন্ডনভিত্তিক বহুজাতিক বেসরকারি নিরাপত্তা কোম্পানি জি-ফোর-এস উল্লেখযোগ্য। ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে নিরাপত্তার কাজে ইসরাইলও এই প্রতিষ্ঠানটির সৈন্যদের ভাড়া করেছে।

আবার বেসরকারিভাবে ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহারের নজিরও আছে। ২০০৪ সালে ইকুয়েটোরিয়াল গিনির প্রেসিডেন্ট তিউদারো ওবিয়াং এমবাসোগো-কে উচ্ছেদের লক্ষ্যে লোগো লজিস্টিকস নামের একটি কোম্পানিকে ভাড়া করেছিল কিছু ব্রিটিশ ব্যবসায়ী। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে আসা গোটা দলটাকেই গ্রেফতার করা হয় জিম্বাবুয়ের হারারে বিমানবন্দরে। ব্যর্থ হয় অভ্যুত্থান পরিকল্পনা।

এসব কারণেই অনেক বিশেষজ্ঞের আশঙ্কা, আগামী দিনে যুদ্ধের সবচেয়ে সহজলভ্য ও বড় উপকরণ হয়ে উঠতে পারে ভাড়াটে সৈন্যরা। তাদের ধারণা এমনটি হলে ভাড়াটে যোদ্ধারা ক্রমেই ‘সৈন্য’ থেকে ‘পণ্য’ হয়ে উঠবে। যে কেউ যে কোন উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অর্থের বিনিময়ে লেলিয়ে দেবে তাদের।

ভাড়াটে যোদ্ধা পেশাটির সাথে যুদ্ধবিগ্রহের সম্পর্ক যতটা ততটাই সম্পর্ক অর্থের। কারণ সঙ্ঘাত আর যুদ্ধ যত বাড়ে ততই মুনাফা বাড়ে নিরাপত্তা ঠিকাদার কোম্পাগিুলোর। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে এই খাতে হাজার হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে বলেন ‘যুদ্ধের ব্যবসা’। শুধুমাত্র ২০১৭ সালেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দফতর পেন্টাগন তাদের ঠিকাদারদের দিয়েছে ৩২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার।

বোকো হারামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নাইজেরিয়া থেকে ভাড়াটে যোদ্ধা নিয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ছবি : ফরেন পলিসি
বোকো হারামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে নাইজেরিয়া থেকে ভাড়াটে যোদ্ধা নিয়েছিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। ছবি : ফরেন পলিসি

 

অভিযোগ আছে, মুনাফার জন্য এই ঠিকাদারি কোম্পানিগুলো যুদ্ধ বাধিয়ে রাখে। ‘অ্যাকাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা এরিক প্রিন্স নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এক উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছিলেন, সৈন্যরা নয়, ঠিকাদাররাই আফগানিস্তানে যুদ্ধ টিকিয়ে রাখবে’।

ভাড়াটে সৈন্যদের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের একটি ওয়ার্কিং কমিটির প্রধান হোসে এল গোমেজ ডেল পারডো তার রিপোর্টে বলেছিলেন, বেসরকারি সামরিক ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানগুলো চায় মুনাফা। যেটি জন্ম দিতে পারে বিপজ্জনক ও ভয়াবহ পরিস্থিতির।

যুদ্ধক্ষেত্রে এই ভাড়াটে যোদ্ধাদের হাতেই বেশি সহিংসতা হয় বলে অভিযোগ আছে। হত্যা, নির্যাতন, ধর্ষণের অভিযোগ প্রায় ওঠে তাদের বিরুদ্ধে। মার্কিন কংগ্রেসের এক নথিতে বলা হয়েছে, ‘অ্যাকাডেমি’র সদস্যরা ২০০৫ সালের পর থেকে অন্তত দুইশ ঘটনার সাথে জড়িত। ২০০৭ সালে তারা ইরাকের একটি মার্কেটে গুলি চালিয়ে ১৭ জন বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। এল-৩ নামের আরেক মার্কিন প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা কুখ্যাত আবু গরিব কারাগারে বন্দী নির্যাতনের সাথে জড়িত।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যুদ্ধবিগ্রহে ভাড়াটে সৈনিকদের পা পড়ার কারণে তা ক্রমশেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে এবং সঙ্ঘাতকে আরো প্রাণঘাতী ও দীর্ঘতর করছে।

বিডিভিউজ-এ প্রকাশিত লেখার স্বত্ব সংরক্ষিত। তবে শিক্ষা এবং গবেষণার কাজে সূত্র উল্লেখ করে ব্যবহার করা যাবে