পুতিন-কিম চুক্তি : বড় যুদ্ধের বীজ বপন

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৪:২৮

চলমান যুদ্ধে ইউক্রেন রুশ-বাহিনীকে টার্গেট করে বছরে প্রায় ২৫ লাখ শেল নিক্ষেপ করছে। তবে এ-সব শেলের সরবরাহ পেতে দেশটিকে অন্যদের ওপর বিশেষ করে পািশ্চমাবিশে^র ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, রাশিয়া বছরে প্রায় ১৪ লাখ শেল নিক্ষেপ করছে ইউক্রেনে। দেশটি বছরে উৎপাদন করে ২০ লাখ শেল। রাশিয়া তার শেলের চাহিদা পূরণে উত্তর কোরিয়ার দিকে হাত বাড়িয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। প্রেসিডেন্ট পুতিন ও কিম জং উনের সামরিক সম্পর্ক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে।

উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের আমন্ত্রণে মস্কো সফর করেন। সেখানেই তারা গোলাবারুদ সরবরাহের বিষয় নিয়ে গোপন আলোচনা ও চুক্তি করেছেন বলে ধারণা করছেন অনেক প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক। কারণ, দুই নেতাই বলেছেন, রাশিয়ার সমস্যা সমাধানে তারা সক্রিয়ভাবে একটি সহজ সমাধানের পথে অগ্রসর হচ্ছেন।



পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়া এই দুই দেশের মধ্যে এরকম একটি চুক্তি সমগ্র বিশে^র জন্যই বিপজ্জনক হিসেবে প্রমাণিত হতে পারে। কারণ, যুদ্ধবাজ হিসেবে পরিচিত দুই নেতার মধ্যে এ-ধরনের চুক্তি বিশ^কে অস্থিতিশীল করে তুলবে বলে মনে করেন ব্রিটেনের হাল বিশ^বিদ্যালয়ের ইনন্টেলিজেন্স ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি বিভাগের অধ্যাপক রবার্ট এম ডোভার।

২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ইউক্রেনে সামরিক আগ্রাসন চালানোর পর পশ্চিমা বিশ^ রাশিয়ার ওপর সর্বাত্মক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার অর্থনীতিকে খুব একটা কাবু করতে পারেনি। নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই রাশিয়া আর্টিলারি শেলসহ বিভিন্ন ধরনের সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম কিনেছে চীন ও উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে।

রাশিয়ার সাথে চীনের উষ্ণ সম্পর্ক থাকলেও প্রকাশ্যে সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহে পুতিনের অনুরোধ নাকচ করে দিয়েছে বেইজিং। তবে ইরান বেশ কিছু ড্রোন ও শেল বিক্রি করেছে রাশিয়ার কাছে।

উত্তর কোরিয়াই হচ্ছে প্রথম দেশ যারা প্রকাশ্যে রাশিয়ার কাছে বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদ বিক্রি করেছে। এখন আরও গোলাবারুদ সরবরাহে রাশিয়ার সাথে উত্তর কোরিয়ার চুক্তি হয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তা সত্যি হলে বিস্তৃত পরিসরে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ায় ইন্ধন যোগাতে পারে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন দুজনেই আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত হবে এমন ধরনের সফরে যেতে খুব একটা আগ্রহী নন। কিন্তু ২০২০ সালে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পর প্রথমবারের মতো কিম জং উন কোন আন্তর্জাতিক সফরে বের হন। কিমের সর্বশেষ আন্তর্জাতিক সফর ছিল ২০১৯ সালে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করতে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয় গিয়েছিলেন তিনি। এরপরে ওই বছরের এপ্রিলে রাশিয়ার ভøাডিভস্টকে গিয়েছিলেন পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। চার বছরের ব্যবধানে রাশিয়ায় কিমের এটি দ্বিতীয় সফর।

কিম জং উন আগের মতো এবারও ভারি সমরাস্ত্র সজ্জিত ট্রেনে করে রাশিয়া সফরে আসেন। ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে মুখোমুখি বৈঠক করেন। দুই নেতাই পশ্চিমা-বিরোধী। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুজনেই অনেকটা বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা কিমের রাশিয়া সফর নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। তারা বলছেন, পুতিন ইউক্রেন যুদ্ধের নতুন অস্ত্র সরবরাহকারী খুঁজছেন। কিম জং উন পুতিনের সেই অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহকারি হতে পারেন। দুই নেতার বৈঠকে অস্ত্র চুক্তি হয়েছে বলে তাদের ধারণা। তবে মস্কো এবং পিয়ংইয়ং যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার স্থল অভিযান এবং যুদ্ধের ফ্রন্টলাইনে সেনাদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখা ব্যাপকভাবে আর্টিলারি ব্যবহারের ওপর নির্ভর করে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অস্ত্র গবেষক সিমন টি. ওয়েজম্যান বলেন, খুব সম্ভবত উত্তর কোরিয়ার কাছে কয়েক মিলিয়ন আর্টিলারি গোলা মজুদ আছে। এছাড়া দেশটির কাছে ১০০ মিলিমিটার বা তারও বেশি ক্যালিবারের প্রায় ১০ হাজার আর্টিলারি কামান রয়েছে। এ-সংখ্যা সবগুলো ন্যাটো দেশের সমন্বিত আর্টিলারি কামানের চেয়েও বেশি।

১৯৫০ সালে শুরু হওয়া কোরিয়া যুদ্ধের সময় কমিউনিস্ট উত্তর কোরিয়াকে রাশিয়া ও চীন এবং গণতন্ত্রী দক্ষিণ কোরিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্র ও অর্থ সহায়তা দিয়েছিল। এখন উল্টো রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র দুই কোরিয়ার কাছে গোলাবারুদের জন্য হাত পাতছে। উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়া উভয় দেশেরই যুক্তরাষ্ট্র-বিরোধী অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে।

কিম জং উনের রাশিয়া সফরকালে মস্কো ও পিয়ংইয়ংয়ের মধ্যে কোনো অস্ত্র চুক্তি হলেও তা কোনো পক্ষই প্রকাশ করেনি। প্রকাশ করার সম্ভাবনাও নেই। কারণ উত্তর কোরিয়া থেকে অস্ত্র কেনা বা দেশটির অস্ত্র কর্মসূচিতে সহায়তা করা জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে গৃহীত প্রস্তাবের বিরোধী। কেননা রাশিয়া ওই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলার দুই নেতার বৈঠককে ‘কিম জং উনের কাছে পুতিনের সাহায্যভিক্ষা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু সাহায্যের জন্য কোরিয়া উপদ্বীপের দিকে কেবল রাশিয়াই যে হাত বাড়িয়েছে তা নয়, রাশিয়ার মতো একই কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রও। ওয়াশিংটনের সঙ্গে গোপনে স্বাক্ষরিত এক চুক্তির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়া গত কয়েক মাস ধরে যুক্তরাষ্ট্রে জাহাজ ভর্তি করে আর্টিলারি গোলা পাঠাচ্ছে। তবে সিউলের দাবি তারা ইউক্রেনকে কোনো প্রাণঘাতি অস্ত্র সরাসরি সরবরাহ করছে না।

দুই কোরিয়ার মধ্যে ১৯৫০ সালে যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৯৫৩ সালে তাদের মধ্যে অস্ত্রবিরতি হয়। কিন্তু কোরিয়ান যুদ্ধ আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও শেষ হয়নি। দুই কোরিয়ার মধ্যে তখন থেকেই অস্ত্র-প্রতিযোগিতা চলছে। দুই দেশই বিশ্বের অন্যতম বড় দুটি সেনাবাহিনী ও অস্ত্রের মজুত গড়ে তুলেছে। উত্তর কোরিয়া বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হলেও দেশটি তার সামরিক শক্তি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে পরমাণু অস্ত্র তৈরি করে। উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সিউলের আসান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের সামরিক বিশেষজ্ঞ ইয়াং উক মনে করেন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া এখনও স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো একে অপরের সঙ্গে সামরিক ও অস্ত্র প্রতিযোগিতায় রয়েছে। এ কারণেই ওয়াশিংটন ও মস্কো এ দুই দেশের কাছে অস্ত্রের সন্ধান করছে।

ইউক্রেনযুদ্ধে দুই পক্ষেরই রয়েছে আর্টিলারি গোলার ব্যাপক চাহিদা। দক্ষিণ কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এখন পর্যন্ত কতগুলো গোলা পাঠিয়েছে তা কোনো পক্ষই প্রকাশ করেনি। তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, দক্ষিণ কোরিয়া মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর কাছে লক্ষাধিক আর্টিলারি গোলা বিক্রি করেছে বা ধার দিয়েছে। মস্কো অবশ্য সিউলকে বারবার সতর্ক করে দিয়েছে, তারা যেন ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ না করে।

ব্রিটেনের হাল বিশ^বিদ্যালয়ের ইনন্টেলিজেন্স ও ন্যাশনাল সিকিউরিটির অধ্যাপক রবার্ট এম ডোভার মনে করেন, অস্ত্র দেওয়ার বদলে উত্তর কোরিয়া রাশিয়া থেকে খাবার, জ্বালানি এবং এর সোভিয়েত যুগের পুরোনো যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক, হাউটজার ও সাবমেরিনের জন্য যন্ত্রাংশ চাইতে পারে। এছাড়া রাশিয়ার সুখোই যুদ্ধবিমানের নতুন ভার্সন এবং এস-৩০০ ও এস-৪০০ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থার প্রতিও চোখ রয়েছে উত্তর কোরিয়ার। এছাড়া রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়া যদি পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে কোনো যৌথ পরিকল্পনায় পৌঁছায়, তা সারাবিশ্বের জন্যই হুমকির কারণ হয়ে দাাঁড়াবে বলে মনে করেন অধ্যাপক রবার্ট এম ডোভার।

এশিয়ান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিসের রিসার্চ ফেলো ইয়াং ইউক বলছেন, রাশিয়া যদি উত্তর কোরিয়ার অস্ত্রের দাম তেল ও খাবার দিয়ে পরিশোধ করে তাহলে তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিচ্ছিন্ন দেশটির অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করায় ভূমিকা রাখবে। যা উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র কর্মসূচিকেই আরও শক্তিশালী করবে। এটি তাদের জন্য বাড়তি আয়ের একটি পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যে সুযোগ আগে কখনও ছিল না।

ইয়াং ইউক আরও বলেন, ১৫ বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা বলবত রয়েছে যেন তারা ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর মতো অস্ত্র তৈরি ও সেগুলোর ব্যবসা করতে না পারে। এখন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাশিয়া কিমের সাথে সম্পর্ক গড়ে পুরো ব্যবস্থাটিকেই অকার্যকর করে দিতে পারে।

অন্যদিকে, উত্তর কোরিয়ার ওপর পশ্চিমা বিশ^ যত বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দেশটি ততই চীনের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এখন রাশিয়ার সাথেও উত্তর কোরিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেশটির নেতা কিম জং উনকে আরও বেপরোয়া করে তুলবে বলে মনে করেন অধ্যাপক রবার্ট এম ডোভার।