গৃহযুদ্ধের মুখোমুখি ইসরায়েল

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু - সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১৮:৫৪

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারের বিরুদ্ধে এই মুহূর্তে শত্রু-দেশের কোনো সেনাবাহিনীর অস্ত্র তাক করার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। বরং ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য এই মুহূর্তে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে নেতানিয়াহু সরকারের বিচার বিভাগের সংস্কার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন ধরে চলা গণআন্দোলন। নজিরবিহীন এই গণআন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইহুদিবাদী দেশটিতে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, তার সমাধান কোন পথে হবে, সে সম্পর্কে কারোরই স্পষ্ট কোনো ধারণা নেই।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইসরায়েলে দীর্ঘদিন ধরে চলা অস্বস্তিকর পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে সম্পূর্ণ নতুন মডেলের একটি সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হতে পারে। যাতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অথবা তার সরকারের উগ্রপন্থী ইহুদি ধর্মীয় নেতাকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়ে আবার পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠনের পথ প্রশস্ত করা হতে পারে।



কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে, বর্তমান আন্দোলনের আবসান ঘটাতে ইহুদিদের কট্টরপন্থী সংগঠন হিলটপ মুভমেন্টের অপরাধীচক্র তৎপর। বর্তমান সরকারের দুই মন্ত্রী বেন গভির ও বেজালেল স্মোট্রিচের নেতৃত্বাধীন কাহানিস্ট খুনিদের উগ্রপন্থী তৎপরতা থামানো এখন জরুরি। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর ওপর তাদের চাপ বৃদ্ধির মাধ্যমে ইসরায়েলকে একটি উগ্র ইহুদিবাদী ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে।

কিছু বিশ্লেষক মনে করেন, এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের সম্ভাবনা শতকরা এক ভাগেরও কম। কেননা, নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সাজাপ্রাপ্ত এই উগ্রপন্থীরা সহজে দমার পাত্র নয়। তাদের শরীরে শেষ ফোটা রক্ত দিয়ে হলেও তারা তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে।

কাহানিজম হলো ইহুদিবাদী চরমপন্থী ধর্মীয় আদর্শে বিশ^াসী একটি খুনি চক্রের নাম। ইসরায়েলের রাব্বি মেইর কাহানির উগ্র দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে এই মতাদর্শ বা মতবাদ গড়ে উঠেছে বলে একে বলা হয় কাহানিজম বা কাহানিবাদ। মেইর কাহানি জুইশ ডিফেন্স লীগ ও কাচ পার্টি নামের দুটি রাজনৈতিক দলেরও প্রতিষ্ঠাতা। যুক্তরাষ্ট্র এই দুটি সংগঠনকে সন্ত্রাসী সংগঠনের তালিকাভুক্ত করেছে। মেইর কাহানি সহিংস পন্থার মাধ্যমে ইসরায়েলে একটি উগ্রপন্থী ইহুদিবাদী ধর্মীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার অনুসারীদের উৎসাহিত করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে ১৯৩০-এর দশকে জন্মগ্রহণকারী জঙ্গি এই ইহুদি ধর্মীয় নেতা পরবর্তীতে ইসরায়েলে চলে আসেন। ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কট্টর ডানপন্থী সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী বেন গভির মেইর কাহানির একজন অনুসারী ও বর্তমানে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী। কাহানিজমের আরেকজন নেতা হলেন নেতানিয়াহুর উগ্রপন্থী জোট সরকারের অর্থমন্ত্রী ও রিলিজিয়াস জায়নিজম পার্টির প্রধান বেজালেল স্মোট্রিচ। এই দুজনই বর্তমানে অধিকৃত পশ্চিমতীরে কাহানিজম মতবাদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে স্মোট্রিচ ইতোমধ্যে ইসরায়েলের আরব ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত নগর, শহর ও এলাকাগুলোতে মুসলমানদের জন্য সরকারি অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছেন।

ইসরায়েলের আরেক কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় সংগঠন হলো হিলটপ ইয়ুথ মুভমেন্ট। ১৯৯৮ সালের নভেম্বরে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে চলমান শান্তি আলোচনা নস্যাৎ করতে এই সংগঠনের জন্ম দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন ইহুদি যুবকদেরকে পশ্চিমতীরের বিভিন্ন পাহাড়ের চূড়া দখল করার নির্দেশ দেন। সেই সময়ই প্রতিষ্ঠিত হয় হিলটপ ইয়ুথ মুভমেন্ট। এই সংগঠনের সদস্যরা ইসরায়েল সরকারের অনুমতি না নিয়েই পশ্চিমতীরে অবৈধ চেকপোস্ট বসিয়ে ফিলিস্তিনিদের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করে।

এই সংগঠনটিও কাহানিজম মতাদর্শকে অনুসরণ করে থাকে। হিলটপ ইয়ুথ মুভমেন্ট মনে করে, ফিলিস্তিনিরা ‘পবিত্র ভূখণ্ড’-কে কলঙ্কিত করছে। কাজেই তাদেরকে এখান থেকে তাড়াতে হবে। এটি মূলত অধিকৃত পশ্চিমতীরে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে একটি হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।

কট্টরপন্থী এই ইহুদি অপরাধীচক্রের নেতা বেন গভির ও স্মোট্রিচ বিশ^াস করেন, তারা সত্যের অনুসারী এবং সত্য ও মিথ্যার মধ্যে একটি মহাযুদ্ধ সন্নিকটে। এই মহাযুদ্ধে সত্যের অনুসারী হিসেবে ইহুদি সম্প্রদায় ফিলিস্তিনি ও আরবসহ সব শত্রুর বিরুদ্ধে জিতবে। এরপর পরাজিতদেরকে দাস ও চাকর হিসেবে তারা ব্যবহার করবে। বেন গভির আরো বিশ^াস করেন, এই মহাযুদ্ধে ইহুদিরা মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র ধর্মীয় স্থান আল-আকসা মসজিদ ধ্বংস করে দেবে।

অন্যদিকে ‘ইসরায়েলি ভূখণ্ডে’ শান্তি কিভাবে আসবে তার একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা আছে স্মোট্রিচের। ইহুদি অপরাধীচক্রের এই নেতার পরিকল্পনাটি হাসিলোচ ম্যাগাজিনে ‘ইসরায়েলস ডিসাইসিভ প্ল্যান’ শিরোনামে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়। তিনি মনে করেন, তার এই পরিকল্পনায় ইহুদি-ফিলিস্তিনি সংঘাতের অবসান ঘটবে। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু স্মোট্রিচকে অধিকৃত পশ্চিমতীরের ‘মুকুটহীন সম্রাট’ হিসেবে নিয়োগ করার পর থেকে তিনি তার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু করেছেন।

স্মোট্রিচের পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে দুই-রাষ্ট্র সমাধানের মৃত্যু ঘটেছে এবং বিরামহীন এই প্রক্রিয়ার সমাপ্তি ঘটানোর এখনই সময়। স্মোট্রিচের কথায়, তার এই পরিকল্পনার লক্ষ্য অর্জন বা বাস্তবায়নে প্রথমেই সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে তাদেরকে। এজন্য পশ্চিমতীরে ইসরায়েলকে ইহুদি বসতি নির্মাণ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটাতে হবে যেটা তিনি ইতোমধ্যে শুরু করে দিয়েছেন।

স্মোট্রিচের পরিকল্পনায় আরো বলা হয়েছে, বসতি নির্মাণ নিয়ে বিতর্কের চূড়ান্ত অবসান ঘটাতে পশ্চিমতীরের অনেক গভীরে নতুন নতুন নগরী ও শহর তৈরি করে নতুন ইহুদি বসতি নির্মাণ সম্পন্ন করতে হবে। এরপর বিভিন্ন দেশের ইহুদিদেরকে এনে সেখানে বসবাসের ব্যবস্থা করে দিতে হবে।

ফিলিস্তিনিদের জন্য স্মোট্রিচের সুস্পষ্ট বার্তা হচ্ছে, তাদের সামনে দুটি বিকল্প আছে। এর একটি হলো- স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রে বসবাসের স্বপ্ন পরিত্যাগ করে একটি ‘ইহুদি রাষ্ট্রে’ তাদেরকে বসবাস করতে হবে। আর যেসব ফিলিস্তিনি তাদের স্বাধীন রাষ্ট্রের আকাক্সক্ষা পরিত্যাগ না করবে তারা তাদের পছন্দ অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যের যে কোনো অথবা বিশে^র অন্য কোনো দেশে অভিবাসী হিসেবে চলে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইহুদি রাষ্ট্র তাদেরকে প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা দেবে। যারা প্রতিরোধ আন্দোলনের পথে হাঁটবে নিরাপত্তা বাহিনী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেবে। স্মোট্রিচ দাবি করেন, তার এই পরিকল্পনাই হচ্ছে প্রকৃত শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সহাবস্থানের একমাত্র পথ।

ইসরায়েলে চলমান সংকট সমাধানের দ্বিতীয় উপায়টি হচ্ছে নেতানিয়াহুর কট্টরপন্থী সরকার ও তার সমর্থকদের সাথে বিরোধীদল ও আন্দোলনকারীদের একটি সমঝোতা বা আপস ফর্মূলায় পৌঁছা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এটি অসম্ভব একটি কাজ বলেই মনে করেন অনেক বিশ্লেষক ও পর্যবেক্ষক। কেননা, কোনো পক্ষই তাদের বর্তমান অনড় অবস্থান থেকে সবে যাবে না।

এই মুহূর্তে নেতানিয়াহু রাষ্ট্রকে বাঁচানোর পরিবর্তে নিজেকে ও তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন, নেতানিয়াহু ইতোমধ্যে নিজেকে বাঁচিয়েছেন এবং ধ্বংস করেছেন ইসরায়েলকে। ফলে সংকট সমাধানের দ্বিতীয় উপায়টি এই মুহূর্তে কার্যকরের আর কোনো সুযোগ নেই।

ইসরায়েলের জন্য তৃতীয় ও শেষ উপায়টি হচ্ছে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। ইসরায়েলে পরিচালিত সর্বশেষ জনমত জরিপে বলা হয়েছে, গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ইসরায়েলি সংবাদপত্র মারিভ-এর পক্ষে এই জনমত জরিপটি পরিচালনা করে লাজার ইন্সটিটিউট নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এই জরিপের ফলাফলে দেখা যায়, ইসরায়েলের ৫৮ শতাংশ বসতিস্থাপনকারী গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। তবে ইসরায়েলের বেশ কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের মতো দেশে এই মুহূর্তে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরির সম্ভাবনা কম।

গৃহযুদ্ধের বিকল্প হিসেবে ক্যু বা সামরিক অভ্যুত্থানের সম্ভাবনার বিষয়টি সামনে আনছেন কোনো কোনো বিশ্লেষক। সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক হেলমি আল-আসমার-এর মতে, আধুনিক ও উদ্ভাবনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এমনভাবে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানো হতে পারে, যেখানে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু অথবা কট্টর ইহুদিবাদী ধর্মীয় শিবিরের এক বা একাধিক নেতাকে মেরে ফেলা হতে পারে।

এর ফলে নতুন নির্বাচনের পথ উন্মুক্ত হবে এবং এই নির্বাচনের ফলাফল নিশ্চিতভাবেই বিরোধীদলের পক্ষে যাবে। তবে এই বিরোধী দলও ডানপন্থী, বামপন্থী নয়। ইসরায়েলে বামপন্থী বিরোধীদলের অস্তিত্ব বেশ কয়েক বছর আগেই বিনাশ হয়েছে।

সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থানের কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, নেতানিয়াহুর কট্টরপন্থী সরকারের বিচারবিভাগ সংস্কারের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে দেশটির সেনা ও বিমান বাহিনীর বহু সদস্য। ফলে বর্তমান সরকারের অবসান ঘটাতে সামরিক অভ্যুত্থানই শেষ পন্থা হতে পারে বলে মনে করেন বিশ্লেষক হেলমি আল আসমার।