এসসিওতে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব বাড়ছে

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ১৫ আগস্ট ২০২৩, ১৪:০৯

সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা এসসিও-র সম্মেলন সম্প্রতি ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সম্মেলনে চূড়ান্ত হয়েছে ইরানের নতুন সদস্যপদ। এসসিও-র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঐক্যের স্বরূপও এই সম্মেলনে বোঝা গেছে। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সাধারণ ঐক্যের বিষয়টি ফুটে উঠলেও এশিয়ার দুই প্রধান দেশ চীন আর ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টিও সেখানে প্রকাশ পেয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্প নিয়ে যথারীতি সমালোচনা করেছেন নরেন্দ্র মোদি। পাকিস্তান আর চীনের সামরিক বিনিময় নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন তিনি। এদিকে, চীনের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, পশ্চিমা কর্তৃত্বের বিশ্বব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে অভিন্ন স্বার্থের প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

ভারত সম্প্রতি আয়োজন করেছিল র্ভাচুয়ালি সাংহাই কোঅপারেশান অর্গানাইজেশান বা এসসিও-র সম্মেলন। সেখানে এক হয়েছিল এশিয়া ও এশিয়ার বাইরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশগুলো। সম্মেলনে অংশ নেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং, এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এসসিও কাউন্সিলের এবারের অধিবেশটি ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এশিয়ার আরেক গুরুত্বপূর্ণ দেশ ইরানের পূর্ণ সদস্যপদ চূড়ান্ত হয়েছে। উদ্বোধনী বক্তৃতায় মোদি এসসিও-র নতুন সদস্যকে স্বাগত জানান। রাশিয়ার মিত্র বেলারুশও শিগগিরই জোটে যোগ দিতে পারে বলে জানান তিনি।

সদস্য দেশগুলো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়েও আলোচনা করেছে। অবকাঠামো সংযোগ চ্যালেঞ্জ, ক্রস-বর্ডার নিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদ, এবং আফগানিস্তানের পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে তারা আলোচনা করেছেন। আফগানিস্তানের সাথে এসসিও-র বেশ কয়েকটি সমস্য দেশের রয়েছে সীমান্ত।

পুতিন মাত্র কিছু দিন হলো তার দেশে ওয়াগনার বিদ্রোহ দমন করেছেন। এসসিও সম্মেলনে তিনি তার শক্তি তুলে ধরেন। এশিয়ার সমমনা দেশগুলোর সাথে কৌশলগত সহযোগিতার সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার ব্যাপারেও আশাবাদ জানান তিনি। এসসিও-র সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো ক্রমেই বাড়ছে। তবে, তারা জোর দিয়ে বলছেন যে, এটাকে ঠিক সামরিক জোট বলা ঠিক হবে না। এখানে যা আছে, তা হলো, সবগুলো সদস্য দেশই একটা বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার পক্ষে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অভিন্ন স্বার্থ থাকলেও সাম্প্রতিক এই এসসিও সম্মেলনে দুই বড় দেশ ভারত আর চীনের মধ্যে উত্তেজনারও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ভারত যদিও জোট নিরপেক্ষতার নামে পশ্চিমাদের সাথে একাত্ম হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই প্রকল্পের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে জোরালো প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলার কারণে চীনের সমালোচনা করেছে দেশটি।

হিমালয় অঞ্চলে বেইজিংয়ের সাথে সীমান্ত নিয়ে বিবাদ রয়েছে দিল্লির। একই সাথে দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের প্রতিপক্ষ ও মার্কিন মিত্র ফিলিপাইন্সের মতো দেশের সাথে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদার করেছে নয়াদিল্লি।

অন্যদিকে, পুতিন সম্মেলনে রাশিয়ার সাহসী চেহারা তুলে ধরেন। একদিকে তিনি ওয়াগনার গ্রুপের বিদ্রোহ দমন করেছেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উল্লেখযোগ্য অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে রাশিয়া। আবার দেশের ভেতরে অর্থনৈতিক মন্দার মোকাবিলাও করছেন পুতিন।

রাশিয়ার নেতা বলেছেন, তার দেশ আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। কারণ তাদেরকে বাইরের বহু নিষেধাজ্ঞা, চাপ, আর উসকানির মোকাবেলা করতে হচ্ছে। তারপরও দেশের উন্নয়ন এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, যেটা আগে কখনও হয়নি।

পুতিন এসসিও সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, আমি এসসিওতে আমার সহকর্মীদেরকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। তারা রাশিয়ার নেতৃত্ব ও সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ও নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে মস্কোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়েছেন। গত মাসে রাশিয়া যখন রাজনৈতিক সঙ্কটের ভেতর দিয়ে গেছে, সে সময় প্রতিবেশী দেশগুলো কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে। বক্তৃতায় পুতিন ওই দেশগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেন। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মোকাবেলায় রাশিয়ার অর্থনৈতিকভাবে টিকে থাকার ক্ষেত্রে এসসিও সদস্য ভারত ও চীন রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ।

চীন-রাশিয়া বাণিজ্য প্রতি বছরই বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৩ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। বাৎসরিক হিসেবে এটা ৪০ দশমিক ৭ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে, রাশিয়ার তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন ভারত। পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার তেল কেনা কমিয়ে দেয়ার পর সেই জায়গা পূরণে সাহায্য করেছে দিল্লি।

রাশিয়ার মতো ইরানও পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মোকাবেলা করছে বহুদিন ধরে। মস্কো আশা করছে, এসসিওতে ইরান যুক্ত হলে এশিয়াতে তাদের প্রভাব আরও বাড়বে, এবং প্যান-রিজিওনাল বাণিজ্য ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণে অনেক অগ্রগতি হবে। এখানে মধ্য এশিয়ার সদস্য দেশগুলো ভৌগলিকভাবে সংযোগ বিন্দু হিসেবে কাজ করবে।

সবচেয়ে শক্তিশালী এসসিও সদস্যদের মৌখিক সমর্থনকেও কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন পুতিন। সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য চীন পশ্চিমা কর্তৃত্বের বাইরে একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে তোলার ডাক দিয়েছেন। চীনের নেতা শি জিনপিং রাশিয়ার পাশে জোরালোভাবে দাঁড়িয়েছেন। একবিংশ শতাব্দির ভূরাজনীতিতে এসে পশ্চিমারা সংকীর্ণমনতার পরিচয় দিচ্ছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি।

শি জিনপিং এসসিও-র সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আমার সবারই উচিত একে অন্যের প্রধান স্বার্থ ও উদ্বেগের বিষয়গুলোকে শ্রদ্ধা করা। উন্নয়নের জন্য সবাই যে সব পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেগুলোকেও আমাদের জোরালোভাবে সমর্থন জানানো উচিত। আঞ্চলিক দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থের বিষয়টি আমাদের মনে রাখা উচিত, এবং স্বাধীনভাবে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করা উচিত।

তিনি বলেন, বাইরের যে শক্তিগুলো আমাদের অঞ্চলে নতুন শীতল যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে, সেগুলোর ব্যপারে আমাদের সতর্ক থাকা উচিত। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্যের হস্তক্ষেপকে জোরালোভাবে প্রত্যাখ্যান করা উচিত। যে কোন ছুতোয় যে কোন দেশে সাজানো বিপ্লবের চেষ্টা হলে, আমাদেরকে সেটাও প্রত্যাখ্যান করা উচিত। পশ্চিমা আগ্রাসনের মোকাবেলায় প্রাচ্যের শক্তিগুলোর সংহতি নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ভারত যদিও বহুমেরুর বিশ্ব ব্যবস্থার পক্ষে কথা বলে থাকে, কিন্তু তাদের কৌশলগত হিসেব নিকেশ রাশিয়া বা চীনের চেয়ে আলাদা। ভারত এসসিওর পাশাপাশি মার্কিন নেতৃত্বাধীন কোয়াডেরও সদস্য। এই জোটে আরও আছে অস্ট্রেলিয়া আর জাপান। সে কারণে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা থেকে তারা মুক্ত রয়েছে।

ভারত রাশিয়ার সাথে জোরালো বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সম্পর্ক জারি রাখার ব্যপারে শক্ত অবস্থান নিয়েছে। পশ্চিমারা সেটাও সহ্য করে নিয়েছে। বরং ভারতের সাথে লেনদেনের ক্ষেত্রে পশ্চিমারা শাস্তির বদলে উপহার দিয়ে দিল্লিকে বশে রাখতে চেষ্টা করছে।

হোয়াইট হাউজে সাম্প্রতিক সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বেশ কতগুলো প্রতিরক্ষা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। মস্কোর উপর ভারতের যে ঐতিহাসিক নির্ভরতা, সেটা কমানোর জন্যই এই চুক্তিগুলো করা হয়েছে। এসসিও সম্মেলনেও ভারতের বহুমুখী কূটনীতির চেহারা বোঝা গেছে। একমাত্র মোদি, চীনের বিআরআই প্রকল্পের সমালোচনা করেছেন। অথচ, এসসিও-র অন্য সব সদস্যই এই অবকাঠামো প্রকল্পকে স্বাগত জানিয়েছে।

বিআরআই বা চীনের নাম সরাসরি না নিয়ে ভারতের নেতা বলেছেন, যে কোন অঞ্চলের অগ্রগতির জন্য সংযোগ প্রকল্প খুবই জরুরি। সংযোগ উন্নত হলে বাণিজ্য বাড়বে, পারস্পরিক আস্থাও বাড়বে। তবে, এটা করতে গিয়ে এসসিও সনদের মূলনীতি বজায় রাখা উচিত। বিশেষ করে অন্য সদস্য দেশের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার দিকে খেয়াল রাখা উচিত।

প্রতিবেশী পাকিস্তানের সাথে চীনের উষ্ণ সম্পর্কেরও সমালোচনা করেছেন ভারতের নেতা। এসসিও সম্মেলনে চীন ও পাকিস্তান দুই দেশের নেতারাই উপস্থিত ছিলেন। মোদি সেখানে পররাষ্ট্র নীতির অস্ত্র হিসেবে ক্রস-বর্ডার সন্ত্রাসকে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে সতর্ক করেন। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ভারতের ভেতরে সহিংস অভিযান চালাচ্ছে বলে যে অভিযোগ রয়েছে, সেদিকে ইঙ্গিত করেন তিনি।

তবে, ভূরাজনৈতিক পার্থক্য শুধু ভারত পাকিস্তান সীমান্তেই সীমাবদ্ধ নেই। দিল্লি এখন সক্রিয়ভাবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় চীনের প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে সমর্থন দিচ্ছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে, ব্রাহ্মস সুপারসনিক মিসাইল বিক্রির জন্য ভিয়েতনামের সাথে কথাবার্তা শুরু করেছে ভারত। দক্ষিণ চীন সাগরকে ঘিরে চীনের সাথে ভিয়েতনামের দ্বনদ্ব অনেক দিন ধরেই চলে আসছে।

এসসিও সম্মেলনের মাত্র কয়েক দিন আগেই ফিলিপাইন্সের সাথে দ্বিপাক্ষিক কৌশলগত সংলাপে অংশ নেয় ভারত। এই দেশটিও বেইজিংয়ের অন্যতম প্রতিপক্ষ। গত বছর ভারতের কাছ থেকে ব্রাহ্মস মিসাইল পেয়েছে ফিলিপাইন্স। এই সম্পর্ক তারা আরও বাড়াতে চায়। এরই ধারাবাহিকতায় ম্যানিলাতে ভারত তাদের প্রথম প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে পাঠানোরও প্রস্তুতি নিচ্ছে। ভারতের এসব তৎপরতায় চীন প্রকাশ্য কোনো মন্তব্য না করলেও বেইজিং বসে নেই। ভারতের প্রতিপক্ষ পাকিস্তানকে সামরিক দিকে দিয়ে আলো শক্তিশালী করার দিকে মনোনিবেশ করেছে চীন।