সিসি কেন মোদির দোস্ত?

- সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ১৭ জুলাই ২০২৩, ১৪:৪৮

মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিসরের সাথে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক দিনদিন বাড়ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি, ব্রিকসের সম্প্রসারণ, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কসহ নানা কারণেই ভারত ও মিসর পরস্পরের ঘনিষ্ঠ হচ্ছে বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মিসর সফরে তারই প্রতিফলন ঘটেছে বলে মনে করা হয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গত ২৫ জুন দুই দিনের সফরে মিসরে সফরে যান। কিছু বিশ্লেষক মনে করছেন, মোদির এই সফর দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে হতে যাচ্ছে ‘গেম চেঞ্জার’। এই সফরের কারণে উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে ভারতের বিনিয়োগ অনেক বাড়বে। একইসঙ্গে ব্রিকস অর্থনৈতিক জোটে মিসরের যুক্ত হওয়ার পথও প্রশস্ত হতে পারে।



আলজাজিরা জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মিসরে মোদির প্রথম সফর এটি। ১৯৯৭ সালের পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী দেশটি সফরে গেলেন। এ বছরের শুরুতে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি সফর করেন। তাকে ভারতের ৭৪তম প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি করা হয়েছিল। তিনি প্রথম মিসরীয় প্রেসিডেন্ট যাকে এই সম্মান দেওয়া হয়। মোদির আমলে প্রেসিডেন্ট সিসি এ নিয়ে তিনবার ভারত সফর করেন। অন্যদিকে কায়রো সফরকালে মোদিকে মিসরের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক ‘অর্ডার অব দ্য নীল’ খেতাবে ভূষিত করেন সিসি।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট সিসির ভারত সফরের মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই মিসর সফরে গেলেন মোদি। আমরা আশা করি এই সফর দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অব্যাহত গতি নিশ্চিত করবে। পাশাপাশি, বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততার নতুন ক্ষেত্রগুলিও প্রসারিত করবে। মিসরও পশ্চিমা ব্লকের বাইরে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়াতে চায়। এ ক্ষেত্রে ভারত সব দিক থেকেই সুবিধাজনক দেশ।

নয়া দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক অধ্যাপক আফতাব কামাল পাশা মনে করেন, মিসর ও ভারতের মধ্যে ঐতিহাসিকভাবেই সুসম্পর্ক রয়েছে। আবার উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো থেকে পাওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের স্পষ্ট সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই মোদি মিসরের দিকে হাত বাড়াচ্ছেন। এছাড়া আছে ভূরাজনৈতিক হিসাব-নিকাশও। পাশা বলেন, সিসি তার দেশকে অর্থনৈতিক জোট ব্রিকসে যুক্ত করতে চান।

বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির দেশগুলো নিয়ে গঠিত ব্রিকস জোট নিকট ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্ব দেবে বলে আশা করা হচ্ছে। এতে আছে রাশিয়া, চীন, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। শিগগিরই এই জোট আরও বড় করতে চায় ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো। তবে এই জোটের দেশগুলোর মধ্যেও আছে অভ্যন্তরীণ বিবাদ। মোদি ব্রিকসের মধ্যে চীনের সঙ্গে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে চান। চীন চায় পাকিস্তানকে ব্রিকসের সদস্য করতে। কিন্তু তাতে ভারতের সায় নেই। এর বিপরীতে ভারত মিসরকে ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য সমর্থন দিতে আগ্রহী।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মিসর মার্কিন ডলারভিত্তিক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য থেকে বেরিয়ে এসে এর বিকল্প খোঁজার চেষ্টা শুরু করে। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে গত বছর জাপানি ইয়েন ভিত্তিক সামুরাই বন্ড ও এ বছর চীনের মুদ্রা রেনমিনবি ভিত্তিক পান্ডা বন্ড ইস্যু করে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের প্রভাব কমাতে বিকল্প একটি মুদ্রা চালুর চেষ্টা করছে ভারতসহ ব্রিকসের অন্য সদস্য দেশগুলো। মিসর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে এবং দেশটি ইতিমধ্যেই ব্রিকসে যোগদানের আবেদন করেছে বলে জানিয়েছেন মিসরে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত। ভারত ও মিসরের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্ক বৃদ্ধির সাথে ব্রিকসের সম্প্রসারণ অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ভৌগোলিকভাবে মিসরের অবস্থান বিশ্বের এমন একটা জায়গায় যাকে ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সংযোগস্থল বলা যেতে পারে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ রুট সুয়েজ খাল মিসরই নিয়ন্ত্রণ করে। বর্তমানে বিশে^র মোট বাণিজ্যের ১২ শতাংশই হয়ে থাকে ১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এই খাল দিয়ে। গত বছর ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পর কৃষ্ণসাগর দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায সুয়েজ খালের গুরুত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।

মিসরের ভূঅবস্থানগত সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সুয়েজ খালের মাধ্যমে ইউরোপের সাথেও ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো জোরদার করার চেষ্টা করছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। বিশেষ করে মিসরের মাধ্যমে ইউরোপের বাজারের সাথে ভারতের অবকাঠামোগত একটি সংযোগ তৈরির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে নয়াদিল্লি। মিসর সফরকালে প্রেসিডেন্ট সিসির সাথে মোদির আলোচনায় এ বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পায়। মিসরে নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত নাভদীপ সুরি বলছেন, ‘মিসরের সাথে অনেক দেশের অবাধ বাণিজ্য চুক্তি আছে। ফলে ভারতীয় কোম্পানিগুলো ওই দেশে প্ল্যান্ট স্থাপন করলে তাদের জন্য ইউরোপ, আফ্রিকা বা মধ্যপ্রাচ্যের নতুন নতুন বাজারে প্রবেশ করা অনেক সহজ হবে।

দিল্লিতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক সি রাজামোহন মনে করেন, কৌশলগত অবস্থানের কারণেই বৈশ্বিক রাজনীতি ও কূটনীতির বহু সিদ্ধান্তকে নানাভাবে প্রভাবিত করার ক্ষমতা আছে মিসরের। তিনি আরো বলেন, মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসি’র সম্মেলনেও একাধিকবার মিসরের আপত্তির কারণে ভারতবিরোধী কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করা যায়নি কিংবা কাশ্মীর নিয়ে ওআইসি’র বিবৃতির ভাষা নরম করতে হয়েছে।

বাণিজ্যিক দিক থেকে ভারত তার উৎপাদিত প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ও কৃষিজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে মিসরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে বিবেচনা করছে। মিসর হচ্ছে বিশে^র বৃহত্তম গম আমদানিকারি দেশ। আগে দেশটি ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম আমদানি করত। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন গমের জন্য ভারতের দিকে নজর দিয়েছে কায়রো। আর ভারতও এই সুযোগটি লুফে নিতে চাইছে বলে মনে করেন দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের ফেলো কবির তানেজা।

কৃষিক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য মিসর সফরকালে মোদি প্রেসিডেন্ট সিসির সাথে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন। বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বছরে অর্থনৈতিক লেনদেনের পরিমাণ ৭.২৬ বিলিয়ন ডলার। দুই দেশই তা বাড়িয়ে ১২ বিলিয়ন ডলারে নিতে চায় বলে জানিয়েছেন ক্লিনজেনডেল কনফ্লিক্ট রিসার্চ ইউনিটের গবেষক মাত্তেও কলম্বো।

মিসর ভারত থেকে যুদ্ধবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র ও বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম কেনার ব্যাপারেও কথাবার্তা বলছে। প্রতিরক্ষার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ক্ষেত্রেও ভারত ও মিসরের সহযোগিতার পরিসর দ্রুত বাড়ছে। ২০২১-২২ অর্থ বছরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের পরিমাণ ৭০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যা তার আগের বছরের তুলনায় ৬০ শতাংশ বেশি।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল-ইস্ট ইনস্টিটিউটের গবেষক মোহাম্মাদ সোলায়মান মনে করেন, মিসর ও ভারতের মধ্যে আদর্শ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক অংশীদার হয়ে ওঠার সব লক্ষণই আছে। তিনি আরো বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মিসর গুরুতর খাদ্য সংকটের সম্মুখীন হলে ভারত তাদের গম রফতানির ওপর নিষেধাজ্ঞা থেকে মিসরকে ছাড় দিয়েছিল। ওষুধ উৎপাদন ও ভ্যাকসিন সরবরাহেও দিল্লি ও কায়রো পরস্পরকে সাহায্য করেছে। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধ ও কোভিড-১৯ দুই দেশকে আরো কাছাকাছি এনেছে।

মিসর ‘সুয়েজ ক্যানাল ইকোনমিক জোন’কে একটি গ্লোবাল প্রোডাকশন হাব হিসেবে গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছে, সেখানে ভারতের আরো সক্রিয় ও বৃহত্তর যোগদান আশা করছে। এই অর্থনৈতিক জোনটি প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার লম্বা একটি চ্যানেল বা বাণিজ্যিক হাব। এখানে আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মাঝে অন্তত ছয়টি বন্দর থাকবে।

সাবেক ভারতীয় কূটনীতিক নাভদীপ সুরির মতে, সুয়েজ খাল ইকোনমিক জোনে বিভিন্ন প্রকল্পে চীন ইতোমধ্যেই ১০০ কোটি ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে। এটা তাদের বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা বিআরআই এর একটা অংশ। এখানে চীনের তুলনায় ভারত এখনও অনেক পিছিয়ে থাকলেও সুয়েজ খালে ভারতের সরকার ও বেসরকারি শিল্পসংস্থাগুলোর বিনিয়োগের বড় সুযোগ আছে বলে সুরি মনে করেন।

চীনের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গাং দায়িত্ব নেওয়ার পর তার আফ্রিকা সফরের শেষ ধাপে ১০ দিন আগেই কায়রো ঘুরে এসেছেন। প্রেসিডেন্ট সিসি এবং মিসরের কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন, সুয়েজ খালে ও মিসরের অন্য অবকাঠামো প্রকল্পগুলোতে তাদের বিনিয়োগের ধারা অব্যাহত থাকবে। চীনা বিনিয়োগের সাথে ভারতের হয়তো টেক্কা দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু মিসর মনে করছে, তাদের দেশের শিল্পসহ বিভিন্ন খাতে ভারতও খুব বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। অন্যদিকে, ভারত আশা করছে, তারা মিসরের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে গ্লোবাল সাউথ বা বিশে^র দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।