যুক্তরাষ্ট্রের আঙিনায় ইরানের পদচারণা

লাতিন আমেরিকা সফরে নিকারাগুয়ায় ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি - সংগৃহীত

  • মোতালেব জামালী
  • ৩০ জুন ২০২৩, ১৪:১৪

কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নে লাতিন আমেরিকার বামপন্থী সরকারশাসিত ৩ দেশ- ভেনিজুয়েলা, কিউবা ও নিকারাগুয়ায় সফর করেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি। যুক্তরাষ্ট্রের ‘উঠোন’ হিসেবে পরিচিত দেশ তিনটির সাথে ইরানের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সর্ম্পক। পশ্চিমাবিরোধী এই দেশগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে সফরে যান রাইসি। ক্ষমতায় আসার পর লাতিন আমেরিকার দেশ তিনটিতে রাইসির এটি ছিল প্রথম সফর।

মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করার ইরানি লড়াইয়ের সাথে একমত পোষণ করে ল্যাতিন আমেরিকার তিন দেশ- কিউবা, ভেনিজুয়েলা এবং নিকারাগুয়া। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের শক্ত অবস্থানের পাল্টা হিসেবে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেশী দেশগুলোকে নিয়ে একটি জোট গড়ে তুলছে। সে-কারণেই তেহরান ছাড়ার আগে প্রেসিডেন্ট রাইসিও বলেছিলেন, ‘লাতিন আমেরিকার স্বাধীন দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে।’

ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট মাদুরোর সৌদি আরব সফরের এক সপ্তাহের মধ্যে দেশটিতে এই সফরে যান রাইসি। চলতি বছরের মার্চে চীনের মধ্যস্থতায় সম্পর্কের বরফ গলেছে ইরান ও সৌদি আরবের। এছাড়া সম্প্রতি কিউবা ও নিকারাগুয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছে তেহরানের।

কিছুদিন আগে প্রথমবারের মতো হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছে ইরান। সর্বশেষ এই ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা এবং সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে বৈরীতার অবসান ঘটিয়ে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল। এবার বাইডেন প্রশাসনের সেই উদ্বেগ বাড়িয়ে দিতেই দেশ তিনটিতে সফর করলেন ইব্রাহিম রাইসি।

২০১৬ সালে ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি কিউবা ও ভেনেজুয়েলা সফর করেন। আর ২০০৭ সালে নিকারাগুয়া সফর করেন সেই সময়ের ইরানি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। ইরানি গণমাধ্যম জানিয়েছে, লাতিন আমেরিকার তিনটি দেশের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের বৈরী সম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে বহু বছর আগে থেকে দেশ তিনটির সঙ্গে সুসম্পর্ক রয়েছে তেহরানের। সেই সম্পর্ককে আরও জোরদার করতেই রাইসির এই সফর।

বিভিন্ন দিক থেকেই প্রেসিডেন্ট রাইসির এই সফর অনেকাংশেই প্রতীকী। এ সম্পর্কে লন্ডনভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের মিডল ইস্ট নর্থ আফ্রিকা প্রোগ্রামের উপপরিচালক ড. সনম ভাকিল দ্য নিউ আরবকে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট রাইসি এই সফরের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রকে এই বার্তা দিতে চান যে, ইরানের সম্মিলিত প্রতিরোধের শক্তি কেবল মধ্যপ্রাচ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। যুক্তরাষ্ট্রের ‘উঠানে’ও ইরানের বন্ধু রয়েছে। আর এসব দেশেরও উদ্দেশ্য হলো বাইডেন প্রশাসনকে একথা বুঝিয়ে দেওয়া যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা রাখে।

রাইসি প্রথমে ভেনিজুয়েলা হয়ে তারপর অন্য দুই দেশে যান। ভেনিজুয়েলায় তার এই সফরের অন্যতম লক্ষ্য ছিল দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিধি বাড়ানো। রাইসি জানান, বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে বছরে ৩০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য এটাকে দুই হাজার কোটি ডলারে উন্নীত করা। সংবাদ সম্মেলনে দুই নেতা ঘোষণা দেন শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে খনিসহ বিভিন্ন খাতে তারা ২৫টি চুক্তি সই করেছেন। দুই দেশের মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতা বাড়ানোর বিষয়টিও তাদের আলোচ্যসূচিতে ছিল।

যদিও রাইসির লাতিন আমেরিকা সফর থেকে বার্তা দেওয়া, সংহতি প্রকাশ ও যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী বক্তব্য দেওয়ার মধ্যেই সীমিত ছিল কিন্তু এরপরও এই সফরের প্রতি গভীর নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র। কেননা, তাদের ঘরের পাশের দেশগুলোতে ইরানের প্রভাব বিস্তার করা ওয়াশিংটনের জন্য ভালো কোনো খবর নয়, বরং যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়।

বামপন্থী এই তিনটি দেশের ওপর দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে। দেশ তিনটির মধ্যে ভেনিজুয়েলার সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ। গত বছর ইরান সফর করেন ভেনিজুয়েলার প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো। তখনই দেশ দুটির মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদারে ২০ বছর মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী, দুটি দেশ জ্বালানি,প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ও পর্যটনশিল্পে একে অপরকে সহযোগিতা করবে।

বিগত বছরগুলোতে বামপন্থী এই দেশগুলোর সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ধারাবাহিকভাবে সৌহার্দপূর্ণ ছিল। কারণ বড় বড় আন্তর্জাতিক ইস্যুতে তেহরানের সঙ্গে তাদের মতের মিল রয়েছে। ইরানি প্রেসিডেন্ট বলেন, এই তিন দেশের সঙ্গে আমাদের সাধারণ অবস্থান হলো বিশ্বের আধিপত্যবাদী ব্যবস্থা এবং একতরফাবাদের বিরোধিতা।

গত বছর নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার একটি প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছিল কারাকাসে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা প্রেসিডেন্ট মাদুরো ও বিরোধী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে ওয়াশিংটন মার্কিন তেল-গ্যাস কোম্পানি শেভরনকে ভেনেজুয়েলায় ছয় মাসের জন্য কাজ করার অনুমোদন দেয়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেলের খনি রয়েছে ভেনেজুয়েলায়। এরপরও দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি ব্যাপক অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে।

লাতিন আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী দেশগুলোর সাথে ইরানের সম্পর্ককে দক্ষিণ-দক্ষিণ সংহতির দিক দিয়ে দেখতে হবে। ইরানের মতো যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়েছে এসব দেশ। এই তিনটি দেশের সাথে ইরানের সম্পর্কও অনেক দিন আগে থেকে গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে তেলসমৃদ্ধ দেশ ভেনিজুয়েলার সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের শুরু ১৯৬০ সাল থেকে। ওই বছরই তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোর সংগঠন ওপেকের যাত্রা শুরু হয় এবং ইরান ও ভেনিজুয়েলা এই সংগঠনের ৫টি প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্যে দুটি।

মধ্য আমেরিকার দারিদ্রপীড়িত দেশ নিকারাগুয়ার বামপন্থী সরকারের সাথে ইরানের জোরালো সম্পর্কের শুরু ২০০০ সালের দিকে। প্রেসিডেন্ট রাইসির সফরের আগে গত বছর পেট্রোলিয়াম বিষয়কমন্ত্রী জাভেদ ওজি-র নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল দেশটি সফর করে। এ-সময় দুইদেশের মধ্যে জ্বালানি ও প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেশকিছু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে নিকারাগুয়ার একটি রিফাইনারি সম্প্রসারণে ইরানের কারিগরি সহযোগিতা প্রদানের বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।

এরপর চলতি বছরের শুরুতে নিকারাগুয়ায় যান ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসাইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান। এরপর দেশটিতে যান প্রেসিডেন্ট রাইসি। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার যাতাকলে পিষ্ট দুই দেশের সম্পর্ক কীভাবে আরও জোরদার করা যায়, সেটাই ইরানি নেতাদের এসব সফরের লক্ষ্য।

১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর কিউবার তৎকালীন নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো এই বিপ্লবকে স্বাগত জানান। আর তখন থেকেই দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ইরাকের সাথেও আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখতেন ক্যাস্ট্রো। ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময়ে দুই দেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে কিউবা। যুদ্ধ শেষ হবার পর ইরান-কিউবার ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে। দুটি দেশই জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য। ২০০১ সালে ফিদেল ক্যাস্ট্রো ইরান সফর করেছিলেন।

সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদের শাসনামলে (২০০৫-১৩) এসব দেশের সাথে সম্পর্ক গড়তে ইরান তার জ¦ালানিকে কাজে লাগিয়েছে। সে সময় লাতিন আমেরিকা সফরকালে আহমাদিনেজাদ বরিভিয়ার ইবো মোরালেস, ব্রাজিলের লুলা দ্য সিলভা, কিউবার ফিদেল ও রাউল ক্যাস্ট্রো, ইকুয়েডরের রাপায়েল কোরেরা, নিকারাগুয়ার ড্যানিয়েল ওর্তেগা ও ভেনিজুয়েলার হুগো শ্যাভেজের সাথে বৈঠক করেছেন। গত মাসে কিউবার একটি প্রতিনিধিদল ইরান সফরে আসে। এ-সময় দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ১৩টি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

আহমাদিনেজাদের প্রশাসনের সময়ে যে নীতি অনুসরণ করা হয়েছে, ইব্রাহিম রাইসির সফর ছিল তার ধারাবাহিকতা। আহমাদিনেজাদ যুক্তরাষ্ট্রকে দেখাতে চেয়েছেন, তারা যদি পারস্য উপসাগরে তাদের বিশাল সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখে, তাহলে ইরানও যুক্তরাষ্ট্রের উঠানে নিজের অবস্থান জোরদার করবে।

কুইন্স ইন্সটিটিউট ফর রেসপনসিবল স্টেটক্রাফট-এর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. তিতা পারসি ইরান-মার্কিন দ্বন্দ্ব নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘ইরানের পররাষ্ট্রনীতিতে আমরা একটা প্যাটার্ন দেখছি । দেশটির কট্টরপন্থী নেতারা সব সময়ই প্রমাণের চেষ্টা করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক রাখা ছাড়াও ইরান ভালো থাকতে পারে। বিশে^র দক্ষিণাঞ্চলের দেশগুলোর সাথে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেই ইরানের পক্ষে ভালোভাবে টিকে থাকা সম্ভব।’

লাতিন আমেরিকার তিনটি দেশ সফরের মাধ্যমে ইব্রাহিম রাইসি একইসাথে দেশে-বিদেশে এই বার্তাও দিলেন যে, ইরান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দেশ নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ইরানি নীতির প্রতি সারা বিশে^ই সমর্থন আছে। যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী ভূরাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভেনিজুয়েলা, নিকারাগুয়া ও কিউবার সাথে ইরানের সখ্যতা আগামী দিনে আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।