যুক্তরাষ্ট্রের ভিত কাঁপিয়ে দিচ্ছে রাশিয়া-চীন-ইরান জোট

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ২১ জুন ২০২৩, ১৪:০৮

পশ্চিমের দৃষ্টিকোণ থেকে ইউক্রেন যুদ্ধের অনেক ইতিবাচক দিক আছে। এখানে রাশিয়ার শক্তিক্ষয় হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে শক্তি ও নেতৃত্বের কেন্দ্রে দেখতে পাচ্ছে। তথাকথিত গণতান্ত্রিক পশ্চিম ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। আবার যুদ্ধের কিছু ভিন্ন দিকও আছে। ইউরেশিয়ায় মার্কিন প্রতিপক্ষ দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে উঠছে। ভৌগলিকভাবে কাছাকাছি এই দেশগুলো পশ্চিমের ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে। এই দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য বেড়েছে, সামরিক বিনিময় বেড়েছে। নিষেধাজ্ঞা এড়াতে ডলারকে পাশ কাটিয়ে বাণিজ্যের প্রবণতাও বেড়েছে। এই সংহতি বাড়তে থাকলে এই অঞ্চলে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বলয়ের কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে যাবে।

চীন, রাশিয়া, ইরান ও উত্তর কোরিয়া যে শুধু নিজেদের অঞ্চলেই শক্তি গড়ছে তা নয়, বরং বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভৌগলিক বলয় জুড়ে তারা কৌশলগত অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে। মার্কিন ডলার বা মার্কিন নৌবাহিনীর আওতার বাইরে তারা বাণিজ্য আর পরিবহন নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। এই ব্লকটা এখনও পূর্ণ রূপ নেয়নি। তবে, ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যতটা ভয়ঙ্কর হবে, তেমন ভয়ঙ্কর আর কিছুর মোকাবেলা যুক্তরাষ্ট্র বহু দশক ধরে করেনি।

আধুনিক যুগের সবগুলো বড় সঙ্ঘাতের কেন্দ্রে ছিল ইউরেশিয়া। এই সুপার-মহাদেশ আর আশেপাশের সাগরের উপর কর্তৃত্ব নিয়ে বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সঙ্ঘাত হয়েছে। আমেরিকান শতাব্দি মানেই যেন ইউরেশিয় শতাব্দি। ওয়াশিংটন তার মত করে বৈশ্বিক ভারসাম্য রাখতে গিয়ে ইউরেশিয়াকে সবসময় বিভক্ত রেখেছে। এখন আবার যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে যেমন কিছু দেশ এক হয়েছে, তেমনি তাদের প্রতিপক্ষের দেশগুলোও এক হতে শুরু করেছে।

এই সময় তুরস্ক, সৌদি আরব, ও ভারতের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। ভৌগলিক অবস্থান ও প্রভাব - দুই বিবেচনাতেই এই দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্ষেত্রে এই দেশগুলো দুই পক্ষেই খেলছে। ইউরেশিয়ার চ্যালেঞ্জে জিততে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে তার বিভিন্ন নেটওয়ার্কের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ককে মজবুত করতে হবে। কিন্তু এই সময়ের বাস্তবতা হলো, এই দেশগুলোর ভূমিকা ইউরেশিয়া কেন্দ্রিক দুই পক্ষের লড়াইয়ের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিতে পারে।

ইউরেশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের প্রধান কৌশলগত অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যতম ধনী ও শক্তিধর কিছু দেশ আছে এই অঞ্চলে। আবার, বিংশ শতাব্দির শুরু থেকেই এই সুপারমহাদেশ ভূরাজনৈতিক লড়াইয়ের কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইংলিশ চ্যানেল থেকে নিয়ে ককেশাস পর্যন্ত দীর্ঘ সাম্রাজ্য গড়তে চেয়েছিল জার্মানি। তাদের হারাতে ট্রান্স-আটলান্টিক জোট গঠনের দরকার হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি আর জাপান ইউরেশিয়ার প্রান্তিক কিছু ভূখন্ড দখল করে এর কেন্দ্রে ঢুকে পড়েছিল। সেখানেও আদর্শিকভাবে ভিন্ন ভিন্ন কিছু শক্তির জোট এসে ভারসাম্য ফিরিয়ে এনেছিল। শীতল যুদ্ধকালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতিপক্ষ ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। দেখা যাচ্ছে, ইউরেশিয়ায় কর্তৃত্ব করার আকাঙ্ক্ষা, এবং তাদের প্রতিহত করার পাল্টা আকাঙ্খা সবসময়ই ছিল।

শীতল যুদ্ধে জেতার পর ওয়াশিংটন আর তার মিত্রদের সব জায়গাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আধিপত্য। ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য - কোন জায়গায় বাদ পড়েনি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যাদের প্রতিপক্ষ জ্ঞান করে, তারাও যখন নিজেদের স্বার্থ নিয়ে সক্রিয় হয়েছে, তখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পাল্টা চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। বড় ধরণের সঙ্কট সাধারণত ইতিহাসের গতি পাল্টে দেয়। এখন ইউক্রেন যুদ্ধ সেটাই করছে। ইউরেশিয়ায় নতুন ব্লক জেগে উঠতে শুরু করেছে।

ইউক্রেনে রাশিয়া বড় ব্যবধানে জিতলে মধ্য এশিয়া থেকে ন্যাটোর পূর্ব ফ্রন্ট পর্যন্ত অঞ্চলে কর্তৃত্বের পর্যায়ে চলে যাবে রাশিয়া। চীন-রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্বও ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। অন্যদিকে, পশ্চিমের দৃষ্টিকোণ থেকে ইউরোপিয় গণতন্ত্রগুলো আগের চেয়ে জোরালোভাবে এখন একজোট হয়েছে। ন্যাটো আরও সম্প্রসারিত হচ্ছে।

এশিয়ার কেউ কেউ ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়েছে। কেউ পশ্চিমের অনুকরণে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। তথাকথিত উদারনৈতিক আদর্শবাদীরা মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থাকে সমর্থন দিয়েছে। মার্কিন নেতৃত্বে একটা অক্ষ শক্তিশালী হয়ে উঠছে। আবার এটাও ঠিক , তাদের বিপক্ষ শক্তির জোটও ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে। পশ্চিমারা এই জোটকে স্বৈরাচারি তকমা দিয়ে খাটো করতে চায়, কিন্তু বাস্তবতা হলো, তাদের সমর্থনেও বিশ্বের বহু দেশ দাঁড়িয়ে গেছে।

মস্কো, বেইজিং, তেহরান তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চায়। সবার ক্ষেত্রেই প্রধান বাধা হয়ে আছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্র সব সময় নিষেধাজ্ঞা ও এ ধরণের অন্যান্য শাস্তি দিয়ে তাদেরকে দমিয়ে রাখতে চায়। এই দেশগুলোর টিকে থাকাটাও তাই পরস্পরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বিচ্ছিন্ন থাকলে পশ্চিমারা তাকে সহজেই কোনঠাসা করতে পারে। সে ক্ষেত্রে অন্য রাষ্ট্রগুলো আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই সবগুলো দেশই ইউরেশিয়ায় পড়েছে, এবং ভৌগলিকভাবে তারা কাছাকাছি। ইউক্রেন যুদ্ধে পশ্চিমারা একতরফা কিয়েভকে সহযোগিতা দেয়ার কারণে এই দেশগুলোও এখন পরস্পরের আরও কাছাকাছি এসেছে। নিজেদের সুরক্ষার প্রয়োজনেই তারা আরও সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে।

ইরান ও উত্তর কোরিয়ার মধ্যে আগে থেকেই মিসাইল প্রযুক্তি বিনিময় হয়েছে। চীন-রাশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব বহু দশক ধরে তৈরি হচ্ছে। যুদ্ধের কারণে অংশীদারিত্বের উপর কিছু চাপ সৃষ্টি হয়েছে ঠিক। কিন্তু সব পক্ষের অভিন্ন স্বার্থের বিষয়গুলিও এখানে আরও স্পষ্ট হয়েছে। ইউরেশিয়াকে কেন্দ্র করে এই জোটের সমন্বয় তাই আরও গতি পেয়েছে।

যুদ্ধের কারণে ইউরেশিয় ব্লকের মধ্যে সামরিক বিনিময় বেড়েছে। পিয়ংইয়ং মস্কোকে কামানের শেল দিচ্ছে। রাশিয়া আর ইরান মিলে একটা সামগ্রিক প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব গড়ে তুলছে। সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম বার্নস যাকে বলেছেন "পূর্ণ মাত্রার" অংশীদারিত্ব। এই অংশীদারিত্বের অধীনে ড্রোন, কামান দেবে ইরান। আবার মিসাইল সরবরাহের কথাও শোনা গেছে। এগুলো ইউক্রেনে রাশিয়াকে শক্তি যোগাবে। অন্যদিকে, রাশিয়া সু-৩৫ জঙ্গি বিমান দেবে ইরানকে। এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, বা ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রযুক্তি দেয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে। এগুলো পেলে তেহরান মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলের শক্ত প্রতিপক্ষ হয়ে উঠবে।

রাশিয়াকে কোন সামরিক সহায়তা দেয়নি চীন। তবে বেসামরিক ড্রোন বা কম্পিউটার চিপসের মতো সরঞ্জাম দিয়ে তারা শক্তি যোগাচ্ছে। এগুলো যুদ্ধে টিকে থাকতে রাশিয়াকে সাহায্য করবে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সাম্প্রতিক সম্মেলন উপলক্ষে যখন মস্কো যান, তখন তার সাথে প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরাও ছিলেন।

এতে বোঝা যায়, দুই দেশের মধ্যে বৃহত্তর প্রতিরক্ষা সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশ একসাথে যৌথ মহড়া করেছে, অস্ত্র বিক্রি করেছে, প্রযুক্তি কেন্দ্রিক সহযোগিতাও রয়েছে তাদের। পশ্চিমের অনেকে এই সম্পর্কের মাত্রা নিয়ে যে ধারণা করেছিলেন, সেই সীমা বাস্তবে অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে।

সামরিক ভারসাম্য পাল্টে দিতে চীন রাশিয়ার মধ্যে পূর্ণ মাত্রার জোট গড়ার দরকার পড়বে না। রাশিয়া যদি চীনকে তাদের সংবেদনশীল সাবমেরিন প্রযুক্তি বা সার্ফেস-টু-এয়ার মিসাইল দেয়, তাহলেই পশ্চিম প্রশান্ত অঞ্চলে যে কোন সম্ভাব্য যুদ্ধের চেহারা বদলে যাবে।

চীন রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন বলয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যও বদলে দিচ্ছে। বহু বছর ধরে চীন স্থলপথে পাইপলাইন ও রেলপথ নির্মাণের উপর গুরুত্ব দিয়েছে, যাতে মধ্যপ্রাচ্যের তেল ও অন্যান্য সম্পদ পরিবহনে সুবিধা পাওয়া যায়। বেইজিং এখন তাদের অর্থনীতিকে নিষেধাজ্ঞামুক্ত রাখতে চায়। এ জন্য তারা স্বনির্ভর হওয়ার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার উপর পশ্চিমারা চড়াও হওয়ার কারণে চীনের তৎপরতা আরও বেড়েছে। রাশিয়া আর ইরান এখন ইন্টারন্যাশনাল নর্থ-সাউথ করিডোর চাঙ্গা করার চেষ্টা করছে। এই করিডোর স্থলবেষ্টিত কাস্পিয়ান সাগর দিয়ে দুই দেশকে এক করেছে। অন্যদিকে, রাশিয়া আর চীন নর্দার্ন সি রুট চালুর জন্য কাজ করছে। চীন আর রাশিয়ার মধ্যে যোগাযোগের এই পথটিতে কোন ঝুঁকি নেই বললেই চলে।

রাশিয়া ও ইরানের মধ্যে বাড়ছে বাণিজ্য। অপরদিকে মস্কোর প্রধান বাণিজ্য অংশীদার এখন চীন। রাশিয়ার তেল আর চীনের কম্পিউটার চিপসের বেচাকেনা বাড়ছে। নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে পুঁজির জন্য রাশিয়ার ফার্মগুলো এখন হংকংয়ের দিকে ঝুঁকছে। চীনের প্রযুক্তির সম্প্রসারণের সাথে সাথে তাদের মুদ্রার বাজারও বড় হচ্ছে।

ফেব্রুয়ারিতে মস্কো এক্সচেঞ্জে ডলারকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল ইউয়ান। চীন ও ইরানও ডলারকে পাশ কাটিয়ে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের কথা ভাবছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা হিসেবে ডলারের পতন না হলেও চীন কেন্দ্রিক একটা অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তি ব্লক প্রাচ্যের প্রাণকেন্দ্রে জায়গা করে নিচ্ছে।

ইউরেশিয়া ব্লকের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক ও আদর্শিক সংহতিও বাড়ছে। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে চীন-রাশিয়ার যৌথ বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধকালিন মানসিকতাকে প্রতিহতের কথা বলা হয়। পুতিন ইউরেশিয়াকে ঐতিহ্যিক মূল্যবোধের ভিত্তিভূমি বলেছেন, যেটা পশ্চিমাদের নব্যউদার চিন্তাভাবনায় আক্রান্ত হয়েছে।

ইউরেশিয়ার সংহতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ দেশগুলোকে নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারে শঙ্কামুক্ত করে তুলবে। শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের পারস্পরিক সামরিক সংহতি বাড়বে। পারস্পরিক কূটনৈতিক সহযোগিতাও জোরালো হবে। এই দেশগুলো যত বেশি নিরাপদ বোধ করবে, তত বেশি একে অন্যের থেকে তারা সহায়তা পাবে। যত বেশি তারা শক্তিশালী হবে, পশ্চিম প্রশান্ত, ইউরোপ, ও মধ্যপ্রাচ্যের মতো অঞ্চলগুলোতে তাদের শক্তির প্রদর্শনীও তত বাড়তে থাকবে।