ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে খ্রিস্টান ধর্মযাজকদের মধ্যে বিরোধ

- সংগৃহীত

  • হায়দার সাইফ
  • ০৫ মে ২০২৩, ২২:৪৮

রাশিয়া আর ইউক্রেনের মধ্যে যে মুহূর্তে সঙ্ঘাত চলছে, ঠিক সেই সময়ে ইউক্রেনের ভেতরে বড় হয়ে উঠছে অন্য একটা সঙ্কট। খ্রিস্টান ধর্মের প্রধান দুই ধারার মধ্যে দীর্ঘদিনের যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে, সেই ধারা দুটো আলাদাভাবে এখন পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য সক্রিয় হয়েছে। ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী সরকার এখন সেখানকার রাশিয়াপন্থী চার্চের বিরুদ্ধে চড়াও হয়েছে। সেখানেও তাদের সহায়তা করছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতি যেদিকে মোড় নিচ্ছে, তাতে যুদ্ধের ফলাফল পুরো অর্থডক্স খ্রিস্টান জগতের উপরও বড় ধরনের প্রভাব ফেলবে।

দুই ধারার চার্চের মধ্যে দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে রয়েছে কিয়েভের পেশেরস্ক মনাস্ট্রি। অর্থডক্স খ্রিস্টান জগতের মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম মনাস্ট্রি। রাশিয়ার অর্থডক্স খ্রিস্টানরাও এই মনাস্ট্রিকে এক সময় তীর্থ জ্ঞান করতো। তীর্থযাত্রী হিসেবে এখানে সফরও করতো তারা।

মস্কোর অর্থডক্স ঘরানায় ইউক্রেনের যে অর্থডক্স চার্চ রয়েছে, তারাই দীর্ঘদিন ধরে এই মনাস্ট্রিটি পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু মার্চ মাসে ইউক্রেনের সরকার মনাস্ট্রির ভাড়ার চুক্তি বাতিল করেছে। সেখানে অবস্থানরত পাদ্রীদের তারা ওই আশ্রম ছেড়ে যাওয়ারও নির্দেশ দিয়েছে। ইস্তাম্বুলের অর্থডক্স ধারায় ইউক্রেনে যে খ্রিস্টান চার্চ রয়েছে, সরকার এখন তাদের কাছে এই মনাস্ট্রির নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছে। তবে, সরকারের এই আদেশে মস্কো ঘরানার পাদ্রীরা টলে যায়নি। তারা বরং তাদের সমর্থকদের সাথে নিয়ে বিক্ষোভের আয়োজন করেছে।

এই বিতর্ক ঠিক সাদামাটা নয়, এবং এর নানা স্তর রয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধ যেমন এখানে একটা কারণ, তেমনি ইউক্রেনের জাতীয় পরিচয়ও এই দ্বন্দ্বের পেছনে বড় ইস্যু হিসেবে কাজ করছে।

ইউক্রেনের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ বড় অংশই হলো অর্থডক্স খ্রিস্টান। এই খ্রিস্টানরা মূলত দুটো ভাগে বিভক্ত। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ মস্কো ঘরানার ইউক্রেনিয় অর্থডক্স চার্চের অনুসারি। বাকিরা অর্থডক্স চার্চ অব ইউক্রেন বা ওসিইউকে অনুসরণ করে। এই ওসিইউ মূলত ইস্তান্বুলের গ্রিক অর্থডক্স খ্রিস্টান ধারার অনুসারী।

১৯৯০ দশকের শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের সময় ইউক্রেনের জাতীয়তাবাদী কিছু পাদ্রী মস্কো ধারার অর্থডক্স ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক রক্ষা করেছিল। সে সময় তারা বিভিন্ন স্বাধীন চার্চ সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো 'ইউক্রেনিয়ান অটোসেফালাস অর্থডক্স চার্চ' এবং 'কিয়েভ পেট্রিয়ার্কেট'। ২০১৮ সালের আগ পর্যন্ত ইউক্রেনের এই ধারাকে অর্থডক্স ক্রিস্টান বিশ্বের অন্যেরা স্বীকৃতি দেয়নি। এই সময়টাতে যখন 'ফেনার বা ইস্তান্বুল পেট্রিয়ার্ক বার্থোলোমিউ' ঘোষণা করা হলো, তখন বলা হলো যে, ইউক্রেন থাকবে মূলত ফেনার ধারার অর্থডক্স ব্যবস্থার অধীনে। মস্কো ধারার অধীনে তারা থাকবে না।
চার্চের সাথে রাজনীতি আরও দৃশ্যমানভাবে জড়িয়ে পড়ে। মস্কো অর্থডক্স ধারায় ইউক্রেনের যে শাখা রয়েছে, তাদের অধিকাংশই পাদ্রিই সে সময় ইউক্রেনের নির্বাচনে রাশিয়া-পন্থী প্রার্থীদেরকে সমর্থন দেয়। অন্যেরা সমর্থন দেয় পশ্চিমাদের সমর্থিত প্রার্থীদেরকে।

মস্কোপন্থী শাখা প্রায় সবসমই রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়দের মধ্যে ভ্রাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখার কথা বলে এসেছে। অন্যদিকে, অন্য খ্রিস্টান পক্ষ পশ্চিমা-পন্থী পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিয়েছে। এই গ্রুপটি ইউক্রেনের ন্যাটো সদস্যপদের পক্ষে কথা বলেছে। শুধু তাই নয়, তারা এমন পররাষ্ট্র নীতি গ্রহণের কথা বলেছে, যেটা ইউরোপিয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র নীতির এজেন্ডার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

ফেনার ধারায় ইউক্রেনে যে চার্চ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, সেটা ভূরাজনীতি আর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যৌথ ফসল। ইউক্রেনের সাবেক প্রেসিডেন্ট পেট্রো পোরোশেঙ্কো ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে জাতীয়তাবাদীদের সমর্থন অর্জন করতে চেয়েছিলেন। সে কারণে তিনি একটা 'জাতীয় চার্চ' গড়ে তুলেছিলেন। কিন্তু এই পদক্ষেপ নিয়েও তিনি নির্বাচনে জিততে পারেননি।

তার উত্তরসুরী হিসেবে যিনি প্রেসিডেন্ট হন, সেই ভোলোদিমির জেলেন্সকি ধর্মীয় বিষয়ে আগ্রহী ছিলেন না। পোরোশেঙ্কোর চার্চ কেন্দ্রীক নীতি নিয়ে তিনি ঠাট্টা মশকরাও করেছিলেন সে সময়। কিন্তু দুই বছর পরে এসে জেলেন্সকি নিজেও জাতীয়তাবাদী ভোটারদের সাথে একাত্ম হওয়ার চেষ্টা করেছেন। এই সময়টাতেই মস্কো পন্থী চার্চের ব্যাপারে তিনি আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেন।

রাশিয়া সব সময়ই ইউক্রেনের উপর তাদের প্রভাব ধরে রাখার, এবং পশ্চিমা শক্তি থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেছে। এ ক্ষেত্রে অর্থডক্স খ্রিস্টান পাদ্রিদের উপর তাদের যে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, সেটা সবসময় রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ইতিবাচক কাজ দিয়েছে। কিয়েভ যেহেতু ইস্টার্ন স্লাভিক বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠি এবং অর্থডক্স ব্যবস্থার সূতিকাগার ছিল, সে কারণে এই কিয়েভকে নিয়ন্ত্রণে রাখার একটা জোরালো আগ্রহ মস্কোর মধ্যে সবসময়ই ছিল। রাশিয়া, ইউক্রেন, আর বেলারুশ মূলত কিয়েভান প্রিন্সিপ্যালিটি বা 'কিয়েভান রুসের' বংশধর। নবম শতাব্দি থেকে নিয়ে ত্রয়োদশ শতাব্দি পর্যন্ত এই কিয়েভান রুস টিকে ছিল।

রাশিয়ান জাতীয়তাবাদীদের কাছে কিয়েভ হলো স্লাভদের প্রথম রাজধানী। কিয়েভান প্রিন্সিপ্যালিটির অধীনে রাশিয়ান, ইউক্রেনিয়, আর বেলারুশদের পূর্বপুরুষরা নিজেদের জন্য অর্থডক্স খ্রিস্টান ব্যবস্থাকে ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেছিল। ৯৮৮ সালে বাইজেন্টাইনদের প্রভাবে কিয়েভান প্রিন্সিপ্যালিটি খ্রিস্টান ধর্মকে আনুষ্ঠানিক ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। সে সময় ইস্তান্বুল পেট্রিয়ার্কেটের তত্ত্বাবধানে কিয়েভ মেট্রোপলিটানেট প্রতিষ্ঠা করা হয়।

ত্রয়োদশ শতাব্দিতে তাতার আর মঙ্গোলদের হাতে ধ্বংস হয়ে যায় কিয়েভান প্রিন্সিপ্যালিটি। এক পর্যায়ে কিয়েভান মেট্রোপলিট কিয়েভ থেকে মস্কোতে স্থানান্তরিত হয়। ১৪৪৮ সালে মস্কোর চার্চ ইস্তান্বুল পেট্রিয়ার্কেট থেকে আলাদা হয়ে যায়। এরই ধারাবাহিকতায় মস্কো পেট্রিয়ার্কেট স্থাপিত হয় ১৫৮৮ সালে। এই সব ঘটনা প্রবাহের ধারাবাহিকতায় মস্কো পেট্রিয়ার্কেট সব সময় দাবি করে এসেছে যে, তারাই কিয়েভ মেট্রোপলিটানেটের বৈধ বংশধর ও উত্তরসূরী।

বর্তমান ইউক্রেন যুদ্ধের যে ধর্মীয় মাত্রা রয়েছে, সেটিও ঠিক এখানেই প্রকাশিত হয়েছে। সবারই জানা , এই যুদ্ধের একটা আন্তর্জাতিক মাত্রা রয়েছে। ১৯৪০ এর দশকের মাঝামাঝি একদিকে তৎকালিন সোভিয়েত ইউনিয়ন বা বর্তমান রাশিয়া, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন ধর্মীয় সংবিধানকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিল। পূর্ব ইউরোপের অর্থডক্স খ্রিস্টান জনগোষ্ঠির উপর প্রভাব ধরে রাখার জন্য রাশিয়া সবসময় রাশিয়ান অর্থডক্স চার্চকে সমর্থন দিয়েছে।

একই উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সবসময় সমর্থন দিয়েছে ফেনার ধারার অর্থডক্স ব্যবস্থাকে। ১৯৪৮ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থডক্স সম্প্রদায়ের যিনি প্রধান, তাকে নিজের ব্যক্তিগত বিমানে করে ইস্তান্বুল পাঠিয়েছিলেন তৎকালিন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান। তাকে সে সময় তুরস্কের নাগরিকত্ব দেয়া হয় এবং দ্রুত তিনি ফেনার ধারার অর্থডক্স ব্যবস্থার প্রধান নির্বাচিত হন।

অনেক অগে থেকে চার্চ প্রকাশ্যেই ভূরাজনীতির অস্ত্র হয়ে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্র আর রাশিয়া পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন ইস্যুতে সবসময় এই অস্ত্রকে ব্যবহার করতে শুরু করে। ২০১৮ সালে ফেনার পেট্রিয়ার্কেট রাশিয়া কেন্দ্রিক চার্চ ব্যবস্থার সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে। এই সিদ্ধান্তকে সবার আগে স্বাগত জানায় যুক্তরাষ্ট্র। বহু সংবাদ প্রতিবেদনে এই ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, যুক্তরাষ্ট্র জেলেন্সকি প্রশাসনের সাথে ফেনার অর্থডক্স গ্রুপের সম্পর্ক স্থাপনের ব্যপারে সাহায্য করেছে।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সেখানকার মস্কো পন্থী চার্চ যখন প্রকাশ্যেই রাশিয়ার পদক্ষেপের সমর্থন জানিয়েছে, তখন তারা কিছুটা হলেও কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের মে মাসে মস্কো পেট্রিয়ার্কেটের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করে ইউওসি বা ইউক্রেনিয় অর্থডক্স চার্চ।

ইউক্রেনের পশ্চিমাপন্থী সরকার ইউওসি'র এই পদক্ষেপের পরও পুরোপুরি আশ্বস্ত হতে পারেনি। সরকার তখন থেকেই ইউওসিকে চাপ দিয়ে যাচ্ছে, যাতে তারা ইউক্রেনের বিভিন্ন মনাস্ট্রি ও চার্চ থেকে মস্কো-পন্থী পাদ্রীদেরকে বের করে দেয়। সমস্যা হলো, ক্যাথলিক খ্রিস্টান জগতে পোপের যে ধরণের একক কর্তৃত্ব রয়েছে, অর্থডক্স খ্রিস্টান জগতে ফেনার পেট্রিয়ার্কেটের সে ধরণের কোন কর্তৃত্ব নেই।

১৫টি চার্চ নিয়ে অর্থডক্স খ্রিস্টান বিশ্ব গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে ফেনার পেট্রিয়ার্কেটকে প্রথম সারির মনে করা হয়। কিন্তু এককভাবে তারা শীর্ষে নেই। সে কারণেই অর্থডক্স বিশ্বে তারা আরও কর্তৃত্ব অর্জনের অর্জনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে তারা পুরো অর্থডক্স জগতের একক নেতা হয়ে উঠতে পারে। সেই জায়গাতেও যুক্তরাষ্ট্র তাদেরকে যথারীতি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।

ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে যে ভাবে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উত্তেজনা বিরাজ করছে, সেটা বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, শুধু ভূরাজনীতির জন্য নয়, এই যুদ্ধের ফলাফল অর্থডক্স খ্রিস্টান জগতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি নিয়ে আসবে।