ইউক্রেনের পর যুদ্ধ ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে বলকান

বলকান অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন নিয়ে মস্কো আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে লড়াই শুরু হয়ে গেছে - সংগৃহীত

  •  আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৭ মে ২০২২, ১২:৪৪

 

ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করেই গোটা বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতি বড়ো আকারের ধাক্কা খেয়েছে। তবে তা এখানেই থামবে বলে মনে হচ্ছে না। রাশিয়া যখন সাবেক সেভিয়েত ইউনিয়নের আওতাধীন এলাকাগুলোর ওপর নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সশস্ত্র পথে অগ্রসর হয়েছে, তখন বলকান অঞ্চলেও সাবেক যুগোশ্লোভিয়ার আওতাধীন অঞ্চলগুলোতে নতুন করে টানাপোড়েন শুরু হয়েছে। সার্বিয়া ও বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনাও নিজেদের স্বার্থে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মস্কোতে দৌড়ঝাপ শুরু করেছে। কেউ বা স্বাধীন দেশের জন্য কাজ করছে আবার কেউ বা বিদ্যমান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ধ্বংসের চেষ্টা করছে। বলকান অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন নিয়ে মস্কো আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে পরোক্ষ লড়াইও শুরু হয়ে গেছে। 


পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপীয় অঞ্চল থেকে নতুন কোনো সংকেত এলে বলকান অঞ্চলের প্রভাবশালী দেশ অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বরাবরই বেশ সংবেদনশীল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। কারণ ১৯১৮ সাল পর্যন্ত বসনিয়ার সারায়েভো এবং বানজালুকাসহ তৎকালীন সময়ে লভিভ শহরটি ভিয়েনা থেকেই শাসিত হয়েছিল। এই কারণেই অস্ট্রিয়ান কূটনীতিকরা চলমান ইউক্রেন সংকট নিয়েই শুধু উদ্বিগ্ন নন বরং বলকান অঞ্চলের পটপরিবর্তনের দিকেও তারা ঘনিষ্ট নজর রাখছেন। অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেকজান্ডার শ্যালেনবার্গ বলেছেন, আমরা সবাই জানি শুধু ইউক্রেন নয় বরং বিশ্বের নানা স্থানে সমস্যা তৈরি করার মতো সক্ষমতা মস্কোর রয়েছে। বিশেষ করে বলকান অঞ্চলের বসনিয়া ও হার্জেগোভিনা এখন ঝুঁকির মুখে রয়েছে।


ইউক্রেনের চলমান সংঘাত যদি কোনো কারণে সাবেক যুগোশ্লোভিয়ার দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে গোটা ইউরোপেই এর ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে বলে অস্ট্রিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সতর্ক করেছেন। তার মতে, সংঘাতটি যদি পশ্চিম বলকানেও ছড়িয়ে পড়ে তাহলে এর অর্থ হলো ইউরোপীয় ইউনিয়নের একেবারে ঘরের উঠোনেই সংঘাত চলে এসেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য তিনি অবিলম্বে বলকান অঞ্চলের ৬টি দেশকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আওতায় নিয়ে আসার তাগিদ দিয়েছেন। তার মতে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিজেদের স্বার্থেই এ ভূমিকা পালন করা উচিত।


সার্বরা যে অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে অস্ট্রিয়াসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর অস্থিরতা যেন বেড়ে যায়। সার্বিয়া ছাড়াও বসনিয়া, কসোভো, মন্টিনিগ্রো এবং উত্তর মেসিডোনিয়াতেও অস্থিরতা তৈরি হতে পারে। সার্বরা ঐতিহাসিকভাবেই রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ ও আস্থাভাজন হওয়ায় সার্বদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলো অস্থিরতায় ভোগে। ইতোমধ্যেই বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার সংখ্যাগরিষ্ঠ সার্ব সম্প্রদায় বিশেষ করে রিপাবলিক অব স্ক্রাপস্কায় জটিলত দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। মস্কোর প্রত্যক্ষ মদদে স্ক্রাপকার প্রধানমন্ত্রী মিলোরাদ ডোডিক বিচ্ছিন্নতার লক্ষ্য অর্জনে তার প্রচেষ্টা আগের তুলনায় জোরদার করছেন।

 

ত্রিপক্ষীয় প্রেসিডেন্সির সদস্য হিসাবে, ডোডিক নিজেও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার একজন সরকারী প্রতিনিধি। এরপরও তিনি প্রায়ই বসনিয়া ও হার্জোগোভিনাকে "দানবীয় দেশ" হিসাবে উল্লেখ করেন। বিজেলজিনা শহরে সমর্থকদের উদ্দেশ্যে এপ্রিলের মাঝামাঝি একটি বক্তৃতায় তিনি প্রকাশ্য বলেন সার্বিয়ার জয় হোক! জয় হোক রাশিয়া! জয় হোক রিপাবলিক অব ¯্রপস্কার। এই সময় তিনি একবারও বসনিয়া ও হার্জেগোভিনার নাম উচ্চারন করেননি। বসনিয়ান যুদ্ধে এক লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক ৩০ বছর পর এসে আবারও বলকান অঞ্চলে বড়ো আকারের সংঘাতের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আগের যুদ্ধে প্রায় ১ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এখন বলকানে আরও একটি সশস্ত্র সংঘাত তৈরি হতে পারে।

অনেক পর্যবেক্ষক মস্কো থেকে বেলগ্রেড এবং রিপাবলিক স্প্রকপার রাজধানী বানজা লুকা পর্যন্ত একটি যুদ্ধ এলাকা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কারন এই অঞ্চলের সার্ব বিচ্ছিন্নতাবাদীরা নিশ্চিতভাবেই ক্রেমলিনের সমর্থন পাবে। ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ এপ্রিলের শুরুতে সম্ভাব্য হুমকির যে ইংগিত দিয়েছিলেন, সেখানে তিনি বসনিয়ার কথা উল্লেখ করেছিলেন। এখন প্রশ্ন হলো, ইউক্রেন অভিযানের সময় প্রেসিডেন্ট পুতিন যে কৌশলে অগ্রসর হয়েছেন বসনিয়ার ক্ষেত্রেও তিনি একই কৌশল নেবেন কিনা?
ডোডিকের নেতৃত্বে রিপাবলিকা ¯্রপস্কা এখন বসনিয়ার বেশিরভাগ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। স্থগিত করা হয়েছে ২০০টির বেশি আইন ও আইনী প্রক্রিয়া। যদিও রিপাবলিকা ¯্রপস্কা বসনিয়ার মোট ভূখন্ডের অর্ধেকের চেয়েও ছোট- এরপরও তারা এখন নিজস্ব সামরিক বাহিনী গড়ে তুলতে চাইছে।


১৯৯৫ সালে ডেটন চুক্তির মাধ্যমে ফেডারেশন অব বসনিয়া এবং হার্জেগোভিনা নামে এই কাঠামোটির সৃষ্টি হয়েছিল। যেখানে মুসলিম বসনিয়াক, সার্ব এবং ক্রোয়েশিয়ানরা একই ভূখন্ডে বসবাস করে আসছে। সম আইন ও অন্যান্য সুবিধা ভোগ করে আসছে। কিন্তু ডোডিক মূলত এই কাঠামো ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েই অগ্রসর হচ্ছেন।
সারায়েভোতে একটি হত্যাকান্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। তিন প্রজন্ম পরে এসেও দেখা যাচ্ছে যে, এই অঞ্চলে সকল রক্তপাতের কেন্দ্রবিন্দুই হলো সারায়েভো। আবার সারায়েভোর ঘটনাবলীকে কেন্দ্র করেই শেষ পর্যন্ত যুগোশ্লোভিয়ায় চুড়ান্ত ভাঙ্গন হয়। কিন্তু ডোডিকেরা মতো বেপরওয়া মানুষগুলো ইতিহাসের এই কালো অধ্যায়গুলো থেকে কোনো কিছুই শিক্ষা নেয়নি।


ইতোমধ্যেই অপারেশন ইইউ ফর আলথিয়ার মাধ্যমে ইউরোপীয় সেনাবাহিনী বলকান অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি দ্বিগুন করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ডোডিক ও ¯্রপস্কার অন্যান্য নেতার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করেছে। চলমান পরিস্থিতিতে হার্জেগোভিনায় থাকা ক্রোয়েশিয়ার জনগোষ্ঠী কিছুটা সমস্যায় পড়েছে। কারণ তাদের নেতা ড্রাগান কোভিচও ডোডিকের সাথে মিলে বিদ্যমান ফেডারেশনকে ভাঙ্গার মিশনে নেমেছে। ক্রোয়েশিয়ার ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন ইতোমধ্যেই ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতরে কভিচের এসব তৎপরতার পক্ষে লবিং শুরু করেছে।


ডোডিক পুতিনের হাতে থাকা একমাত্র অস্ত্র নয়। তবে তার ভূমিকা গুরুপূর্ন। কারণ তার অবস্থান ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমানা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে। কট্টর জাতীয়তাবাদী মানসিকতার এই সার্বীয় নেতা এখন পুতিনের সাথে সর্ম্পকের জেরেই আগুন নিয়ে খেলার সাহস করছেন।
পুতিনের সাথে ডোডিকের সর্বশেষ দেখা হয় গত ডিসেম্বরে। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লেভরভ ও রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ইগোর কালাবুচভ তাকে নিয়মিতভাবে নির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন। কালাবুচভ ইতোমধ্যেই হুমকি দিয়ে বলেছেন, বসনিয়া যদি মনে করে যে, তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে আর আমরা বসে বসে দেখবো- তাহলে তারা ভুলের মধ্যে আছে। আমরা ইতোমধ্যেই ইউক্রেনের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। এরকম আরো কোনো হুমকিও যদি আমাদের সামনে আসে তাহলে আমরা আবারও একই কৌশলে তাদেরকে শিক্ষা দেবো।


ডোডিক সার্বিয়ার বর্তমান কাঠামোর জন্যেও একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার ভিউকিচ মনে করেন, ডোডিক অনেক গর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত নিজস্ব সেনাবাহিনী গঠনের দিকে এগুবেন না। ভিউকিচ নিজেও পুতিনের ঘনিষ্ঠজন। তবে, সম্প্রতি জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইউক্রেন অভিযানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ায় ক্রেমলিনের কিছুটা রোষানলে পড়েছেন।
ভিউকিচের কার্যক্রম বরাবরই অপরিস্কার। অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতার এই মানুষটির কৌশল আগে থেকে বোঝা যায় না। তবে, তিনি বেশ শক্ত হাতেই দেশ পরিচালনা করছেন। মস্কোর সাথে সম্পর্ক ভালো হলেও সার্বিয়াও বহুদিন ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়ার দৌড়ে রয়েছে। ওয়াশিংটনও সার্বিয়ার বিষয়ে ইতিবাচক। কারন তাদের বিবেচনায় গোটা বলকান অঞ্চলে শুধুমাত্র সার্বিয়াতেই স্থিতিশীলতা রয়েছে।


সম্প্রতি ভিউকিচ প্রেসিডেন্ট পদে পুন:নির্বাচিত হয়ে আসার পর থেকে ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র তাকে চাপ দিচ্ছে যাতে তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিষয়ে পরিস্কার অবস্থান নেন। কিন্তু ভিউকিচ এখনো নিরব রয়েছেন। কিছুদিন আগে তিনি চীন থেকে এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমও ক্রয় করেছেন। তিনি বলকানকে এখনই অশান্ত করতে চাইছেন না। একইভাবে রাশিয়ার বন্ধুত্বও তিনি হারাতে চান না।


জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে আগামীতে সাবেক সার্বীয় প্রদেশ কসোভোকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ভিউকিচ চাইছেন রাশিয়া যেন তখন তার পাশে থাকে এবং কসোভোর স্বীকৃতি পাওয়ার বিরুদ্ধে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে।
পুতিন যেমন আগের সেভিয়েত ইউনিয়নের কাঠামো ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন দেখেন ঠিক একইভাবে ভিউকিচও স্লোভাদান মিলোসোভিচের প্রতিষ্ঠিত বৃহত্তর সার্বিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে আগ্রহী। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, সার্বীয়দের জনগনের অধিকাংশই চায় না তাদের দেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিক। তাদের আশংকা এতে করে তাদের দেশ বড়ো আকারের ঝুঁকির মুখে পড়বে।


অন্যদিকে, বসনিয়া ইতোমধ্যেই ঝুতিতে পড়ে গেছে। কারণ ডোডিক ইউক্রেনে মস্কোর জালানো আগুনকে বসনিয়া পর্যন্ত টেনে নিয়ে আসতে চাইছেন। ইতোমধ্যেই ¯্রাপস্কা এবং বসনিয়ার মাটিতে রাশিয়ার গোয়েন্দা সংস্থার এজেন্টদের লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে বলকান অঞ্চলটি ধীরে ধীরে যেন অশান্ত ও নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে।
অনেকে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোর ভূমিকার দিকেও তাকিয়ে আছেন। ম্যাক্রো বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার মেয়াদ শেষ হওয়ার মাত্র দুই মাস সময় বাকি আছে। ম্যাক্রো বরাবরই পশ্চিম বলকানকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বলয়ের ভেতর আনতে আগ্রহী। কিন্তু দুই মাসের মধ্যে তিনি তা করতে পারবেন কিনা তা দেখার বিষয়।