যেভাবে ইসলামপন্থী হয়ে উঠলেন ইমরান খান


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৬ মে ২০২২, ২০:১৬
এক সময় পাশ্চাত্যের সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত পাকিস্তানের জনপ্রিয় রাজনীতিক ইমরান খান এখন পুরোদস্তুর একজন ইসলামপন্থী। তার এই রূপান্তর অকল্পনীয়। এতে রক্ষণশীল পাকিস্তান সমাজে তার জনপ্রিয়তা তুঙ্গে পৌঁছেছে। তবে রাজনৈতিক ইসলামের বৈরি শক্তি তাকে ক্ষমতাচ্যুত করায় পরোক্ষ ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন তার রাজনৈতিক দলকেও নিষিদ্ধ করা হতে পারে এমন শঙ্কাও আছে। ইমরান খানের রাজনৈতিক রূপান্তরের নানা দিক তুলে ধরেছেন ইলিয়াস হোসেন। বলা হয়, ৪০ বছর বয়সের পর অনেক মানুষের জীবনেই লক্ষণীয় পরিবর্তন আসে। ইমরান খানের ক্ষেত্রেও হয়তো তাই ঘটেছে। ৪০ বছর বয়সে তিনি রাজনীতির মাঠে নামার ঘোষণা দেন। এরপর পাশ্চাত্যে শিক্ষিত ইমরান ধীরে ধীরে ইসলামী ভাবধারার দিকে ঝুঁকে পড়েন। এখন তিনি প্রতিটি জনসভায় পবিত্র কুরআন ও হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে থাকেন। সারা বিশে^র নিপীড়িত মুসলিমদের পক্ষেও জোরালো অবস্থান নিয়েছেন তিনি। ইমরান খানের প্রচেষ্টায় জাতিসংঘে ইসলামোফোবিয়া দিবস পালনের প্রস্তাব পাস হয়েছে। আরবের বহু শাসক পাকিস্তানকে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির জন্য চাপ দিলেও ইমরান তা সরাসরি নাকচ করে দিয়েছেন। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও ফিলিস্তিনে ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিবৃতি দিয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালে জাতিসংঘে ঐতিহাসিক প্রথম ভাষণে কাশ্মীরের ভারতের নিমর্মতা ও নরেন্দ্র মোদি সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। তার ক্ষুরধার যুক্তিপূূর্ণ ভাষণ বিশ^ব্যাপী প্রশংসিত হয়। তার সেই ভাষণ শুরু করেছিলেন বিসমিল্লিাহির রহমানির রাহিম এবং ‘ইয়াক্যানাবুদু ওই ইয়াকানাসতাইয়ন’ বলে। তবে ইমরান খানের অতীত জীবন কিন্তু বস্তুবাদী ছিল। পাকিস্তানকে ১৯৯২ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক ইমরান ২০১৮ সালে দুর্নীতিমুক্ত, সমৃদ্ধ, বিশ্বের কাছে শ্রদ্ধা পাওয়ার মতো দেশ গড়ার স্বপ্ন হাজির করে বিপুল সংখ্যক মানুষের মন জয় করে নিয়েছিলেন। সুদর্শন ও ক্যারিশমাটিক ইমরান প্রথম বিশ্ববাসীর নজরে আসেন গত শতকের সত্তরের দশকের শুরুর দিকে আগ্রাসী ফাস্ট বোলার হিসেবে। একসময় তিনি বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার এবং ক্রিকেটপাগল পাকিস্তানের বীর হয়ে ওঠেন। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপে খেয়ালি একদল খেলোয়াড়ের অধিনায়ক ছিলেন তিনি। যাদের শিরোপা জেতার সম্ভাবনা ছিল না। ইমরান সে সময় তার দলের খেলোয়াড়দেরকে ‘কোণঠাসা বাঘের মতো লড়তে’ অনুপ্রাণিত করেছিলেন। ওই বছরই ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়ে নানান জনকল্যানমূলক কাজে নেমে পড়েন ইমরান। মায়ের নামে ক্যান্সার হাসপাতাল বানাতে তোলেন আড়াই কোটি ডলার। সেখানে বিনামূল্যে সেবা পায় ৭০ শতাংশ ক্যান্সার রোগী। আর ১৯৯৬ সালে গড়েন রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই দল। ব্যক্তিগতভাবে ইমরানের ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকলেও পিটিআইয়ের শুরুটা ছিল বিবর্ণ। ইমরানের আসন ছাড়া ১৭ বছর তারা পার্লামেন্টের আর কোনো আসনই জিততে পারেনি দলটি। এর চার বছর পর ২০১১ সালে ইমরানের জনসমাবেশগুলোতে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়। ব্যাপক দুর্নীতি, বিদ্যুৎ ঘাটতি, শিক্ষায় সংকট, বেকারত্ব সমস্যা জর্জরিত পাকিস্তানিরা পিটিআই নেতাকে নিয়ে আশায় বুক বাধতে শুরু করেন। পরের বছরগুলোতে তার সমর্থন হু হু করে বাড়তে থাকে। বিদেশে লেখাপড়া করা অনেক প্রবাসী পাকিস্তানি বিদেশের কাজ ছেড়ে দেশে এসে ইমরানের সঙ্গে যোগ দেন। নির্বাচনী প্রচারণায় পপ গায়ক ও অভিনেতাদের উপস্থিতি তাকে তরুণদের মধ্যেও ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে। ২০১৮ সালে এক জনসভায় ইমরান বলেছিলেন, তার লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তানকে ‘অল্প ধনী আর ব্যাপক দরিদ্রের দেশ’ থেকে ‘বিশ্বের কাছে মানবিক, ন্যায়বিচারের ইসলামি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ওই বছরই তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে বসতে পেরেছিলেন। ১৯৫২ সালে জন্ম নেওয়া ইমরান আহমেদ খান নিয়াজীর বাবা ছিলেন নির্মাণ প্রকৌশলী। পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লাহোরে চার বোনের সঙ্গে বড় হওয়া ইমরান ছোটবেলায় নিজেকে গুটিয়ে রাখতেই পছন্দ করতেন। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন, রাজনীতি আর অর্থনীতিতে ডিগ্রি নেওয়া ইমরান ক্রিকেট ক্যারিয়ারে প্লেবয় ইমেজ গড়ে তুলেছিলেন। সুদর্শন ইমরানের সঙ্গে অনেক অভিজাত, ধনী ও তারকা নারীদের প্রেমের গুঞ্জন ছিল। ‘ক্যারিশমাটিক ইমেজের’ জন্য নারীরা তার প্রতি দারুণভাবে আকৃষ্ট হতেন। ক্রিকেট মাঠে অসাধারণ পারফমেন্স আর লন্ডনের নাইটক্লাবগুলিতে নানা কা-ের কারণে হরহামেশা খবরেরও শিরোনাম হতেন ইমরান। ধনকুবের জেমস গোল্ডস্মিথের মেয়ে জেমিমাকে ১৯৯৫ সালে বিয়ে করেন তিনি। ৯ বছর পর তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। ওই ঘরে ইমরানের দুটি ছেলে আছে। দ্বিতীয়বার ইমরান বিয়ে করেছিলেন টিভি সাংবাদিক রেহাম নায়ারকে, সেটিও টেকেনি। ইমরানের বর্তমান স্ত্রী বুশরা বিবি একজন আধ্যাত্মিক নারী বা পীর। ত্রয়োদশ শতকের এক মাজারে দুজনের পরিচয় হয়। সুফিবাদের প্রতি ইমরান আকর্ষণের বিষয়টিও এই ঘটনায় বোঝা যায়। ক্ষমতায় বসার পর ইমরান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে রাজনৈতিক প্রভাবের চেয়ে যোগ্যতাকে বেশি মূল্য দিয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন আমলাতন্ত্র ও সরকারি চাকরিতে নিয়োগে সংস্কার আনতে। নাগরিকরা যেন যে কোনো বিষয়ে সহজে অভিযোগ জানাতে পারে তার ব্যবস্থা করেছিলেন। একটি প্রদেশে দরিদ্রদের জন্য সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রকল্পও চালু করেছিলেন। প্রকল্পটি ধীরে ধীরে সারা দেশে কার্যকর করারও ইচ্ছা ছিল তার। দশকের পর দশক ধরে দেশটিতে বন ধ্বংসের মচ্ছব চলেছিল, তার বিপরীতে পিটিআই সরকার এক হাজার কোটি গাছ লাগানোর একটি প্রকল্পও শুরু করেছিল। রুগ্ন অর্থনীতিকে সবল করতে ইমরান তার বেশকিছু নীতি নিয়েছিলেন, পাকিস্তানের জন্য বাগিয়ে নিয়েছিলেন আইএমএফের ‘বেইল আউট’। কর আদায় বাড়াতে উচ্চাকাঙ্খী কিছু লক্ষ্যও ঠিক করেছিলেন তিনি। কিন্তু তার দুর্নীতিবিরোধী অভিযান খুব একটা বড় সফলতা আনতে পারেনি। তবে তিনি নিজের স্বচ্ছ ও সৎ ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন, যা পাকিস্তানে বিরল। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে করোনা মোকাবিলায় পাকিস্তান সবার আগে সাফল্য পায় ইমরান খানের নেতৃত্বে। তিনি মহামারিকালে জনগণকে বিপুলভাবে অর্থ সহায়তা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, ইমরান খান বুঝতে পেরেছিলেন যে জবাবদিহিতা, সুশাসন, নির্বাচনী সংস্কার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরনের স্লোগান জনগণকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি জনসাধারণকে আকৃষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক সমাবেশে ধর্মীয় প্রচার শুরু করেন। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন সম্পর্কে পাকিস্তানিদের সচেতন করার জন্য রহমাতুল্লিল আলামিন কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেন। তার এই ইসলামপন্থী অবস্থান তাকে নিজের অনুসারী, এমনকি ইসলামপন্থী দলগুলোর সমর্থকদের মধ্যেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে। এসব পদক্ষেপে মূলধারার ইসলামপন্থী দলগুলো চাপে পড়ে যায়। ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগে চাপে থাকা ইসলামপন্থী দলগুলোও সমর্থন দেয়। এখন তার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় দলকে নিষিদ্ধ করার একটি প্রচেষ্টাও এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইমরান খান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, তার দল পিটিআইকে বিদেশী তহবিল মামলার মাধ্যমে তাকে রাজনীতি থেকে বিতারনের ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন দলটির বিরুদ্ধে বিদেশী তহবিল মামলার শুনানি শুরু করেছে। কমিশনের অভিযোগ, পিটিআই বিদেশী নাগরিক এবং সংস্থা থেকে তহবিল পেয়েছে এবং কয়েক ডজন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট গোপন করেছে। ইমরান খান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানের ভ’খন্ডে আমেরিকার ড্রোন হামলার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। আমেরিকার ওয়ার অন টেরর যুদ্ধে পাকিস্তানের যোগদানেরও সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে যোগ দেওয়ায় ৮০ হাজার পাকিস্তানিকে শহীদ হতে হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও ইমরান খান মাথা নোয়াননি। এক জনসভায় তিনি বলেছেন, ‘আমি কোনো দেশের বিরুদ্ধে নই। আমি ভারত বিরোধী নই, ইউরোপ বিরোধী বা আমেরিকা বিরোধী নই। আমি সকল জাতিকে সম্মান করি । আমি সকল জাতির বন্ধু, কিন্তু কারো দাস নই। আমরা স্বাধীন এবং আমরা চিরকাল মুক্ত থাকব। আমি মানবতার সাথে আছি এবং আমার নেতা হলেন হযরত মুহাম্মদ সাঃ। ইমরান আরও বলেছেন, তিনি আমেরিকান এবং ইউরোপীয়দের অন্য পাকিস্তানি রাজনীতিবিদদের চেয়ে ভাল বোঝেন। কোনো নেতা তাদের দেশের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখলে পশ্চিমারা তাকে চাপ দেয়, কিন্তু সম্মান করে। কিন্তু আপনি যখন তাদের জুতা পালিশ করেন, তারা আপনাকে সম্মান করে না। আমি তাদের বুট পালিশ করতে আগ্রহী নই। নিজ দেশে ক্ষমতাধর সেনাবাহিনী, আন্তর্জাতিক শক্তি ও তাদের অনুগত পাকিস্তানি রাজনীতিকরা ইমরান খানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সক্ষম হলেও নিজ দেশের জনগণের কাছে তিনি এখন অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিক। যুক্তরাষ্ট্রের পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে দেখা যায়, তিনি বর্তমানে ৬৮ শতাংশ পাকিস্তানির সমর্থন পাচ্ছেন। যা তাকে দেশটির সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনীতিবিদের মর্যাদা দিয়েছে। গত বছরও তার সমর্থন ছিল ৫২ শতাংশ। ইসলামের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় গবেষণা সংস্থা দ্য মুসলিম ফাইভ হান্ড্রেড তাকে বিশে^র অন্যতম শীর্ষস্থানীয় মুসলিম ব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যা দিয়েছে।