মারিউপোল বিজয় বদলে দেবে যুদ্ধের গতি

-

  • মেহেদী হাসান
  • ২৩ এপ্রিল ২০২২, ১৫:২৬

ইউক্রেন যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিজয় বন্দর নগরী মারিউপোল দখল। মারিউপোল দখলের ফলে এখন স্থলপথে ক্রিমিয়া উপদ্বীপ সরাসরি যুক্ত হল রাজধানী মস্কোর সাথে। পুরো আজভ সাগরে প্রতিষ্টিত হয়েছে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রন। মারিউপোলের পর রাশিয়ার এখন লক্ষ্য ইউক্রেনের ওড়েশা বন্দরনগরী দখল করা। এর মাধ্যমে কৃষ্ণ সাগরের ৬০ ভাগের বেশি উপকূল রেখার ওপর নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠিত হবে রাশিয়ার। একই সাথে কৃষ্ণ সাগরের বিশাল সমুদ্র অঞ্চল এবং সমুদ্র সম্পদের ওপরও রাশিয়ার নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা হবে। 


রাশিয়ার মারিউপোল দখলের ফলে ইউক্রেন হারাল তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বন্দর এবং বিশাল শিল্প এলাকা। ইউক্রেনের জন্য বড় আঘাত এটি। মারিউপোল আজভ সাগর অঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূূর্ণ বন্দর। ইউক্রেনের স্টিল, কয়লা এবং শস্যের প্রধান রপ্তানি বন্দর। মারিউপোলে আছে ইউরোপের সবচেয়ে বড় স্টিল কারখানা আজভোস্টাল। ৪ বর্গমাইল এলাকাজুড়ে অবস্থিত এ শিল্প কমপ্লেক্্র।
ইউক্রেনের দক্ষিন এবং পূর্বাঞ্চল দখল মানে পুরো আজভ সাগরের সমুদ্র সম্পদ এবং কৃষ্ণ সাগরের অধিকাংশ সমুদ্র সম্পদের ওপর রাশিয়ার আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া। মারিউপোলের পর রাশিয়ার টার্গেট হবে ওডেশা বন্দরের নিয়ন্ত্রন নেয়া। ওডেশা বন্দরের অবস্থান কৃষ্ণ সাগরের তীরে ইউক্রেনের দক্ষিন-পশ্চিমে।
ক্রিমিয়া উপদ্বীপ আগেই রাশিয়ার দখলে রয়েছে । এখন মারিউপোলের পর ওডেশা বন্দর দখল করতে পারলে ইউক্রেন সমুদ্র যোগাযোগ ও সমুদ্র বানিজ্য থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। ভূখন্ডের সাথে সাথে ইউক্রেন হারাবে বিশাল সমুদ্র এলাকা ও সমুদ্র সম্পদ। ইউক্রেন পরিণত হবে একটি স্থলবেষ্টিত রাষ্ট্রে। পঙ্গু হয়ে পড়বে দেশটির অর্থনীতিসহ বিভিন্ন খাত।


মারিউপোল কৌশলগতভাবে রাশিয়ার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক শহর। মারিউপোল বন্দর ক্রিমিয়ার সাথে হাইওয়ের মাধ্যমে যুক্ত। মারিউপোলের উত্তরে ডোনেটস্ক এবং লুহানস্কও রাশিয়ার দখলে। ফলে রাশিয়া এখন লুহানস্ক-ডোনেটস্ক-মারিউপোল হয়ে সরাসরি স্থলপথে পৌছে যেতে পারবে গুরুত্বপূর্ণ ক্রিমিয়া উপদ্বীপে।


ইউক্রেনের নাৎসী বাহিনী বা আজভ ব্রিগেডের মূল ঘাটি মারিউপোলে। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য নাৎসীপন্থী আজভ বাহিনী নির্মুল করা ও ইউক্রেন আর্মিকে নাৎসীমুক্ত করা। মারিউপোল দখলের মাধ্যমে রাশিয়ার অভিযানের অন্যতম এই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে। পশ্চিমাদের আশঙ্কা আজভ মিলিশিয়া বাহিনীর যোদ্ধাদের গ্রেফতার করতে পারলে রাশিয়া তাদেরকে দিয়ে মস্কোর রেড স্কোয়ারে প্যারেড করাতে পারে ৯ মে। এতে মনোবল চাঙ্গা হবে রাশিয়ার জনগনের। আজভ বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে রাশিয়ায়। কারন তারা ডোনেটস্ক এবং লুহানস্কে হাজার হাজার জাতিগত রাশিয়ানদের হত্যা করেছে।


মারিউপোলের পতন এবং আজভ বাহিনীর ধ্বংস হবে ইউক্রেনের জন্য বড় ধরনের আঘাত। যা সামলানো কিয়েভের পক্ষে কঠিন। কৃষ্ণ সাগরের তীরে ইউক্রেনের গোটা দক্ষিন অঞ্চলকে পুতিন নভোরাশিয়া বা নতুন রাশিয়া হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকেন। আঠারো শতকের শেষ দিকে তুরস্কের অটোম্যানদের কাছ থেকে এ অঞ্চল রাশিয়ান সা¤্রাজ্যের অধীনে আসে। পুতিনের লক্ষ্য এই অঞ্চলকে পুনরায় রাশিয়ার সাথে যুক্ত করে কৃষ্ণ সাগরের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা।


মারিউপোল রাশিয়া দখলে নিলেও শহরটি মূলত মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে রাশিয়ান আর্মি। পশ্চিমা গণমাধ্যমে একে এখন মৃত নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। মারিউপোল ধ্বংসের মাধ্যমে রাশিয়া ইউক্রেনকে বার্তা দিয়েছে প্রতিরোধ করতে চাইলে এভাবে ধ্বংস করা হবে অন্যান্য অঞ্চলকেও।
২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ান অভিযান শুরুর পর সবচেয়ে বেশি ধ্বংসের শিকার হয়েছে মারিউপোল। কারন রাশিয়া মরিয়া ছিল কৌশলগতভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এ অঞ্চলটি দখলের জন্য।
মারিউপোলে যুদ্ধে রাশিয়া মোতায়েন করেছে ৬ হাজারের বেশি সেনা। মারিউপোল বিজয়ের পর রাশিয়া সেখানে ১ হাজার সেনা মোতায়েন রাখবে। বাকী সেনা ইউক্রেনের অন্য অঞ্চল দখল অভিযানে যোগ দেবে। ধারনা করা হচ্ছে মারিউপোলের পর রাশিয়া এখন আরেক বন্দরনগরী ওডেসা দখলে অভিযান জোরদার করবে। মারিউপোল দখলের ফলে রাশিয়ার জন্য সহজ হবে ইউক্রেনের অন্যান্য অঞ্চল দখল করা।


রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করলেও রাশিয়ার স্থল ভুমি থেকে এটি বিচ্ছিন্ন ছিল। কারন ক্রিমিয়ার তিন দিকে কৃষ্ণ সাগর। উত্তরে ইউক্রেনে মূল ভূখন্ডের সাথে যুক্ত। ফলে বিমান আর কৃষ্ণ সাগরই ছিল ক্রিমিয়ার সাথে রাশিয়ার যোগাযোগ মূল মাধ্যম। আর কৃষ্ণ সাগরে আসতে হলে রাশিয়াকে পাড়ি দিতে হতো হাজার হাজার মাইলের ব্যারেন্ট সাগর, বাল্টিক সাগর, উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর, ভূমধ্য সাগর এবং তুরস্কের বসফোরাস প্রণালী। এছাড়া যুদ্ধের সময় তুরস্কের নিয়ন্ত্রনে থাকা বসফোরাস প্রণালী বন্ধ করে দেয়ায় ঝুকিও আছে।


ক্রিমিয়ার সাথে সড়ক যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে রাশিয়া ২০১৬ সালে কার্চ প্রণালীর ওপর সড়ক ও রেল ব্রিজ নির্মান শুরু করে। অবিশ্বাস্য দ্রুততায় মাত্র দুই বছরের মাধ্যমে রাশিয়া শেষ করে ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ইউরোপের সবচেয়ে বড় ব্রিজ নির্মানের কাজ। কার্চ প্রনালীর ওপর এ ব্রিজ ক্রিমিয়াকে যুক্ত করেছে রাশিয়ার দক্ষিনে ক্রাসনোদার অঞ্চলকে।
মারিউপোল দখলের ফলে এখন ক্রিমিয়ার ওপর রাশিয়ার পূর্ণ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও তা ধরে রাখা আরো সহজ হবে। মারিউপোলের অবস্থান আজভ সাগরের তীরে ইউক্রেনের দক্ষিন পূর্বে। মারিউপুল এখন কমপক্ষে তিনটি পথে ক্রিমিয়াকে যুক্ত করবে রাজধানী মস্কোর সাথে।


ক্রিমিয়া থেকে একটি হাইওয়ে চলে গেছে উত্তরে মেলিতোপোলে। মেলিতোপোল থেকে এ হাইওয়ে চলে গেছে সোজা পূর্বে মারিউপোল হয়ে রাশিয়ার দক্ষিনে রোস্তভ শহর পর্যস্ত। রোস্তভ দীর্ঘ এক হাইওয়ের মাধ্যমে সরাসরি যুক্ত রাজাধানী মস্কোর সাথে। ফলে রাশিয়া রোস্তভ শহর থেকে মাত্র ৬শ কিলোমিটার দূরত্ব অতিক্রম করে পৌছে যেতে পারবে ক্রিমিয়া উপদ্বীপে। মারিউপোল থেকে ক্রিমিয়ার দূরত্ব ৪২০ কিলোমিটার এবং রোস্তভের দূরত্ব ১২০ কিলোমিটার।
এ ছাড়া মারিউপোল হয়ে ডোনেটস্ক এবং লুহানস্কের মধ্য দিয়ে ক্রিমিয়ার সাথে প্রতিষ্ঠিত হবে ল্যান্ড করিডোর। লুহানস্ক যুক্ত রোস্তভ-মস্কো হাইওয়ের সাথে। এভাবে ডনবাস রাজ্যের মধ্য দিয়ে ক্রিমিয়া ও মারিউপোল যুক্ত হবে রাজধানী মস্কোর সাথে।
অপর দিকে মেলিতোপোল থেকে আরেকটি বিশাল হাইওয়ে সোজা উত্তরে জাপোরিজিয়িা-নিপ্রো হয়ে খারকিভের সাথে মিলেছে। খারকিভের অবস্থান রাশিয়ার সীমান্তের বেলগোরডের কাছে । বেলগোরড স্থলপথে সরাসরি যুক্ত রাজধানী মস্কোর সাথে।

রাশিয়া যদি খারকিভ, নিপ্রো এবং জাপোরিজিয়ার নিয়ন্ত্রন নিতে পারে তাহলে এ অঞ্চল দিয়েও মারিউপোলের সাহায্যে ক্রিমিয়া যুক্ত হবে মস্কোর সাথে। এক কথায় রাজধানী মস্কোর সাথে ক্রিমিয়ার যোগাযোগের ক্ষেত্রে জংশনের ভূমিকা পালন করবে মারিউপোল বন্দর। নিপ্র নদী ইউক্রেনকে সোজা পূর্ব পশ্চিমে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। চেরনিহিভ, নিপ্রো, জাপোরিজিয়িা, খারকিভ, মেলিতোপোল, সুমি, ডনবাস, মারিউপোল এসব শহর নিপ্রো নদীর পূর্বে অবস্থিত। ক্রিমিয়ার ওপর স্থলপথে যোগাযোগ এবং পূর্ন আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে রাশিয়া মেলিতোপোল, জোপোরিজিয়িা, নিপ্রো, খারকিভ এবং ইউক্রেনের আরেক বন্দর ওডেসা দখলে নিতে চায়। ইউক্রেন এ যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়ার কাছে হারাতে পারে নিপ্রো নদীর পূর্বে গোটা পূর্ব ও দক্ষিন ইউক্রেন।

রুশ-তুর্কি যুদ্ধে ১৭৮৩ সালে অটোম্যানদের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখলে নেয় রুশরা। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন সোশালিস্ট রিপাবলিকের সাথে যুক্ত করেন। ইউক্রেন তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলে স্বাধীনতা লাভ করে ইউক্রেন। একই সাথে ক্রিমিয়াও চলে যায় ইউক্রেনের সাথে। কিন্তু সোভিয়েতের কৃষ্ণ সাগর নৌ বহর ক্রিমিয়ায় অবস্থানের অনুমতি পায় ইউক্রেনের কাছ থেকে। রাশিয়ান কৃষ্ণ সাগর নৌ বহর এবং ইউক্রেন নেভি সদর দফতরের অবস্থান করে ক্রিমিয়ায়। পরবর্তীতে ইউক্রেনে রাশিয়ান বিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে তারা ক্রিমিয়ায় রাশিয়ান নৌ বহর রাখার অনুমতি বাতিল করে। ইউক্রেনের সাথে রাশিয়ার দ্বন্দ্বের অন্যতম কারন এটি।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএর মদদে পতন ঘটে রাশিয়ানপন্থী ইউক্রেন সরকারের। প্রতিষ্ঠিত হয় যুক্তরাষ্ট্রপন্থী সরকার। এরপরই রাশিয়া দখল করে নেয় ক্রিমিয়া। ক্রিমিয়ার আয়তন ২৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। জনসংখ্যা ২৪ লাখ।


ইউক্রেন অভিযানের পূর্বেই রাশিয়া ঘোষণা দিয়েছে ক্রিমিয়া কখনো আর ইউক্রেন ফিরে পাবে না। ইউক্রেন যদি ক্রিমিয়া দখলের অভিযান চালায় তাহলে রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। কেবল ক্রিমিয়া নয় বরং গোটা দক্ষিন-পূর্ব ইউক্রেন এখন রাশিয়ার অধীনে চলে যেতে পারে। যার মধ্যে মরিউপোল ও ওডেশার মতো বন্দরও যোগ হতে যাচ্ছে।