সিরিয়ায় কী করছে রাশিয়া ও চীন

-

  • হায়দার সাইফ
  • ২৪ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৩৬

যুদ্ধের তীব্র সময়টা পেরিয়ে এসেছে সিরিয়া। ধীরে হলেও শান্তি আর স্থিতিশীলতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশটি। সিরিয়া সরকারের আহ্বানে সামরিক শক্তি নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিল রাশিয়া। যুদ্ধের পর অনেক সেনা দেশে ফিরে গেছে। তবে এখনও সিরিয়ায় দুটি পয়েন্টে অবস্থান করছে রাশিয়ান সেনারা। এদিকে, সিরিয়ার সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হলো যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন। কিন্তু পশ্চিমা বা আরব দেশগুলোর সক্ষমতা নেই তাদের সাহায্য করার। সেখানে বরং এগিয়ে এসেছে চীন। প্রাচীন সিল্ক রোড নতুন করে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা চলছে।

সিরিয়ায় এক দশক ধরে যুদ্ধ চলছে। এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি সেটা। যুদ্ধে প্রধান তেলক্ষেত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে সরকার। তেলের যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে, সেটা পূরণে এগিয়ে এসেছে ইরান। লেবানন আর ইরাক থেকেও পাচার হয়ে আসছে কিছু তেল। কিন্তু ইরানে তেলের দর পড়ে গেছে। তাদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা বেড়েছে। আর বিভিন্ন সামরিক চাপ তো আছেই। সব মিলিয়ে ইরান ঠিক মতো তেল সরবরাহ করতে পারছে না।

সিরিয়ার অর্থনীতির জন্য আরেকটি আঘাত হয়েছে লেবাননের আর্থিক সংকট। লেবাননের ব্যাংকগুলোতে যে পুঁজি জমা আছে, তার প্রায় চার ভাগের একভাগই হলো বিভিন্ন সিরীয় কোম্পানির। এর মধ্যে সরকার সংশ্লিষ্ট কোম্পানিও রয়েছে। লেবানন মুদ্রার ওপর নানান বিধিনিষেধ আরোপ রয়েছে। জরুরি পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে মূল্য পরিশোধে তাই সময় লাগছে। এই সব পণ্যের মধ্যে গমও রয়েছে। সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়ায় দামও তাই বেড়ে গেছে গমের।

এই অবস্থায় সিরিয়া সরকারের সামনে একটাই পথ খোলা। তাদেরকে মুদ্রা ছাপতে হবে। ইরানের ঋণের ওপর নির্ভর করতে হবে। আর সিরীয় ব্যবসায়ীদের বাধ্য করতে হবে, যাতে সরকারকে তারা সরাসরি সাহায্য করে। চলতি বছরের শুরুর দিকে পাঁচ হাজার সিরিয় পাউন্ডের ব্যাংক নোট বাজারে ছাড়া হয়েছে। এর আগে বাজারে সর্বোচ্চ ব্যাংক নোট ছিল দুই হাজার পাউন্ডের।

২০১১ সালে তেল উৎপাদনে ৩৩ নম্বরে ছিল সিরিয়া। দক্ষিণ সুদান আর ভিয়েতনামের পরেই ছিল তাদের অবস্থান। ২০১১ সালে বিশ্বের মোট উৎপাদনের দশমিক চার শতাংশ ছিল সিরিয়ার। ২০১২ সালে সেটা কমে দশমিক দুই-পাঁচ শতাংশে নেমে আসে। মধ্যপ্রাচ্যের হিসেবে যুদ্ধের আগেও সিরিয়ার তেল উৎপাদনের পরিমাণ বেশি ছিল না। ২০১১ সালে এই অঞ্চলে তাদের উৎপাদনের হিস্যা ছিল ১ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১২ সালে সেটা কমে দশমিক সাত-পাঁচ শতাংশে নেমে আসে।

২০১৫ সালে সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে রাশিয়া। বাশার আল আসাদই তাদের আমন্ত্রণ করেছিল। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে রাশিয়ার সামরিক উপদেষ্টাদের মোতায়েন করা হয়। এতে পুরো সঙ্ঘাতের গতিই বদলে যায়। আসাদ ক্ষমতায় টিকে যান। আর এই অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হয়ে ওঠে রাশিয়া।

সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের আগে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার খুবই তিক্ততা চলছিল। কারণ ক্রাইমিয়া তখন মাত্র রাশিয়ায় ফিরে গেছে। আর ডোনবাসেও যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে রাশিয়ার যোগাযোগের মাত্রা বদলে যায়। খোদ আমেরিকার সাথে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর সহযোগিতা বাড়তে থাকে। আর ইসরাইলের সাথে অন্য উচ্চতায় চলে যায় মস্কোর সম্পর্ক।

কৌশলগত দিক থেকে দেখলে, সিরিয়া যুদ্ধের সুবিধাভোগী পক্ষগুলোর একটি হলো রাশিয়া। রাশিয়া দ্রুততার সাথে স্বল্প ব্যায়ের সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এই সব অভিযান তাদেরকে এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান শক্তিতে পরিণত করেছে। রাশিয়া সিরিয়া সঙ্ঘাতে জড়ানোর পর ছয় বছর চলে গেছে। এখনও তারা দেশ ছেড়ে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেয়নি। তাছাড়া, সিরিয়া সরকারের উপর রাশিয়ার প্রভাবের বিষয়টিও এখন সবারই জানা।

সিরিয়াতে রাশিয়ার সক্রিয় সামরিক অভিযান স্থায়ী হয়েছিল ৮০৪ দিন। ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর। রাশিয়ার বিমান বাহিনীর হামলায় এক লক্ষ ৩৩ হাজারের বেশি সন্ত্রাসী স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে অবৈধ তেল শোধনাগারও রয়েছে। বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠির ৮৬৫ জন নেতা নিহত হয়েছে। তাদের সেনা মারা গেছে এক লাখ ৩৩ হাজারের মতো।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে খেমেইমিম বিমান ঘাঁটি পরিদর্শন করেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তখন বেশির ভাগ রাশিয়ান সেনাকে দেশে ফেরার নির্দেশ দেন তিনি। ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরের হিসেবে সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার সেনা মারা গেছে ১১২ জন। এর মধ্যে ৩৯ জনই মারা গেছে পরিবহন বিমান এএন-২৬ বিধ্বস্ত হয়ে। আর ২০ জন মারা গেছে আইএল-২০ বিমান ভূপাতিত হয়ে। সিরিয়া বিরোধী গেরিলারা ওই বিমানটি ভূপাতিত করেছিল।

ব্লুমবার্গ ও রয়টার্স জানিয়েছে, যুদ্ধে রাশিয়ার কয়েকশ ভাড়া করা সেনাও মারা গেছে। তবে রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এই তথ্য নিশ্চিত করেনি। সিরিয়াতে এখন দুটো পয়েন্টে অবস্থান করছে রাশিয়া। একটি হলো খেমেমিম বিমান ঘাঁটি। সেখানে রয়েছে বিমান শক্তি। ২০১৮ সালের হিসেবে সেখানে রাশিয়ান বিমান বাহিনীর ২৮টি জঙ্গি বিমান, দশটি পরিবহন ও বিশেষ বিমান, এবং নয়টি হেলিকপ্টার ছিল। রাশিয়ার নৌ শক্তি অবস্থান করছে তারতুস বন্দরের কাছে।

রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পের দেখাশোনা করেন ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ইউরি বরিসভ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তিনি বলেছিলেন, পরবর্তি চার বছরের মধ্যে তারা তারতুসের আধুনিকায়নে ৫০০ মিলিয়ন ডলার ব্যায়ের পরিকল্পনা করছেন।

এই দুই পয়েন্টে রাশিয়ার কী পরিমাণ সামরিক ও বেসামরিক জনবল রয়েছে, সেটার সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানা যায় না। ২০২০ সালে রাশিয়ার সংবিধান সংশোধনের জন্য ভোটগ্রহণ হয়। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের মতে, সিরিয়া থেকে সে সময় ছয় হাজার চারশ ২৪ জন রাশিয়ান ভোট দিয়েছিলেন।

এদিকে, চীন সরকার আবার সব সময় সিরিয় ইস্যুতে শক্তি প্রয়োগের জোরালো বিরোধীতা করেছে। অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে তারা। সিরিয়া পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে চীন সিল্ক রোড উন্নয়নের কথা বলছে। সিরিয়া সরকারও এ ব্যাপারে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সিল্ক রোড উন্নয়নের মাধ্যমে যদি যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠনের কাজ হয়, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক বহু এগিয়ে যাবে।

চীন আর সিরিয়ার বন্ধুত্বের ঐতিহ্য অবশ্য দীর্ঘ। প্রাচীন সিল্ক রোডটি দুই দেশের সম্পর্কের প্রতীক হয়ে আছে। পিপলস রিপাবলিকান অব চীন গঠনের পর প্রথম যে আরব দেশগুলো স্বীকৃতি দিয়েছিল, তার মধ্যে সিরিয়াও ছিল। চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনেও এগিয়ে ছিল দামেস্ক।

২০১১ সালে যখন সিরিয়া সঙ্কটে পড়ে , চীন সরকার তখন জাতিসংঘ সনদ আর আন্তর্জাতিক আইন মেনে সঙ্কট মোকাবেলার কথা বলেছিল। সামরিক সমাধানের তারা তীব্র বিরোধীতা করেছিল। এর একটা কারণ হলো, সামরিক অভিযানের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল সিল্ক রোড ভেঙে দেওয়া।

২০১৮ সালে চীন-সিরিয়ার সম্পর্কের লক্ষ্য বদলে যায়। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ মোকাবেলা থেকে পুনর্গঠনের দিকে নজর সরায় তারা।চীন সরকার নিজেরাই সিরিয়াকে জানায়, যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনে তারা অংশ নিতে চায়। এর মাধ্যমে সিল্ক রোডের পুরনো দিন তারা ফিরিয়ে আনতে চায়। কিন্তু পশ্চিমা-সমর্থিত সন্ত্রাসী গোষ্ঠিগুলো সেখানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের নেতৃত্বাধীন বহুপাক্ষিক শান্তি প্রক্রিয়াতেও তারা অংশ নেয়। পাশাপাশি সিরিয়ার জনগণের জন্য বড় অঙ্কের ফ্রি মানবিক সহায়তাও পাঠায় চীন।

সিরিয়ায় সিল্ক রোডের ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগত গুরুত্ব অনেক। অবকাঠামো নির্মাণ, জ্বালানি ও শিল্প সহযোগিতা, এবং সমুদ্র বন্দর নির্মাণ প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করতে চায় চীন। একই সাথে সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, অনিশ্চয়তার ঝুঁকির দিকগুলোতেও নজর দেওয়া দরকার তাদের।

সিরিয়ায় রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা কতটুকু? তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য পক্ষগুলোর এই অঞ্চলে স্বার্থ রয়েছে। সিরিয়া তার সার্বভৌমত্ব অনেক আগেই হারিয়েছে। সেখানে সরকারের সংশ্লিষ্টতা বা মতামত ছাড়াই নিজেদের মতো করে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে রাশিয়া, তুরস্ক, আর ইরান। তবে এটা বলা যায় যে, আসাদ যুদ্ধে জিতেছেন। কিন্তু শান্তি অর্জন করতে পারেননি। বিরোধীরা হেরে গেছে। কিন্তু তারা শান্তি হারায়নি। বহু সিরিয়ান এমন সব এলাকায় বাস করছেন, যেগুলো সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যেও টিকে থাকার অলৌকিক প্রচেষ্টা জারি রাখবে আসাদ সরকার। তাছাড়া দামেস্কে নতুন নিষেধাজ্ঞা আর ক্ষমতার দ্বন্দ্বও রয়েছে। খুব শিগগিরই পুরো সিরিয় ভূখন্ড একক কর্তৃত্বের অধীনে আসবে না। তাছাড়া ঘরবাড়ি ছাড়া হাজার হাজার শরণার্থীরাও এখনই ঘরে ফিরবে না। সঙ্ঘাত পরবর্তী কালে বড় ধরনের কোনো পুনর্গঠন কর্মসূচিও এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ইউরোপিয়ান বা উপসাগরীয় দেশগুলোর কারোরই সেই আর্থিক সক্ষমতা নেই। আর ঠিক এই পুনর্গঠনের জায়গাতেই সহযোগিতা নিয়ে এগিয়ে এসেছে চীন।

এসব পক্ষের মধ্যে একটা ভারসাম্য এলেই কেবল দুঃসময়ের অতীতটা পেরিয়ে আসতে পারবে সিরিয়া। এগিয়ে যেতে পারবে শান্তি ও সমৃদ্ধির দিকে।