যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের রাজনীতি : একই মুদ্রার দুই পিঠ


  • মোতালেব জামালী
  • ০৭ নভেম্বর ২০২১, ১৯:০৪

পশ্চিমা বিশ্বের দৃঢ় বিশ্বাস হচ্ছে, গণতন্ত্রই হলো শাসনব্যবস্থার সর্বোত্তম পন্থা। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের রাজনীতির সাম্প্রতিক দৃশ্যপট পশ্চিমাদের সেই বিশ্বাসকে বড় ধরনের পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দিয়েছে। বর্তমানে এই দুটি দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চেহারা ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে শুরু করেছে। বর্তমানে দেশ দুটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূল কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে কাউকে ক্ষমতায় বসানো কিংবা কাউকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার মূলনীতি হচ্ছে- জনগণকে তাদের প্রয়োজনীয় সেবা দেওয়া, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এসব ধারণা ক্রমেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের রাজনীতি ও সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।

ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ১৯৪৮ সালে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রই অবৈধ এই দেশটিকে টিকিয়ে রেখেছে। সর্বোচ্চ সামরিক ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে দেশটিকে শক্তিশালী করে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিজেদের লাঠিয়াল হিসেবে তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৮৫ সালে থেকে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে বার্ষিক তিন বিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা দিয়ে আসছে। ১৯৭৬ সালে থেকে ২০০৪ সালে পর্যন্ত ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তাপ্রাপ্ত দেশগুলোর শীর্ষে ছিল।

সামরিক ও আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থনও পেয়েছে ইসরায়েল। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে উত্থাপিত যে কোনো প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি এ পর্যন্ত ইসরায়েলের পক্ষে ৪২ বার এই ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট কংগ্রেসের দুই কক্ষ প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটের সদস্যরাও চোখ বন্ধ করে ইসরায়েলের সব অন্যায় আচরণ ও কর্মকাণ্ডকে সমর্থন দিয়ে থাকে। নিজেরা সব সময় মানবাধিকারের কথা বললেও ফিলিস্তিনিদের ক্ষেত্রে তারা সব আন্তর্জাতিক রীতি-নীতি ও আইন-কানুনের কথা ভুলে যায়।

অধিকৃত গাজা ও পশ্চিম তীরে নারী ও শিশুসহ সাধারণ ফিলিস্তিনিদের নির্বিচারে হত্যা, বাড়িঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও অবকাঠামোসহ সব কিছুই ইসরায়েল ধ্বংস করছে যুগ যুগ ধরে। কিন্তু মানবতা ও মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা যুক্তরাষ্ট্র এ বিষয়ে টু শব্দটিও করে না। বরং দেশটির প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সব কর্মকর্তাই শুধু এ কথাই বলেন যে, ইসরায়েলের টিকে থাকার অধিকার রয়েছে। শুধু ফিলিস্তিনিদের টিকে থাকার ও বেঁচে থাকার অধিকার নেই বলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল মনে করে থাকে। সব বিষয়ে দুই দেশের মধ্যে এতো ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকায় দুই দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও একই পথে ধাবিত হচ্ছে।

আরব আমেরিকান ইন্সটিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও বিশ্লেষক ড. জেমস জগবি প্রায় ৪০ বছর আগে তার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মার্কিন কংগ্রেস সদস্যের সঙ্গে আলোচনার কথা স্মরণ করেছেন। তিনি বলেন, সে সময় তার সাথে আলোচনার সময় আমি জানতে পেরেছিলাম কংগ্রেসের সদস্যরা কীভাবে ইসরায়েলকে নিঃর্শত সমর্থন দিতে কংগ্রেসে প্রস্তাবে ভোট দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে তারা আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতি এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতিকেও নির্দ্বিধায় অবজ্ঞা করে থাকে। কীভাবে ইসরায়েলের সুবিধা হতে পারে, তারা শুধু কংগ্রেসে সেই নীতি গ্রহণের বিষয়টি নিয়েই চিন্তা করেন। অন্য কোনো কিছুই তাদের বিবেচনায় থাকে না।

ড. জেমস জগবি মনে করেন , ইসরায়েলের অনেক নীতি নিয়ে মার্কিন রাজনীতিক ও কংগ্রেস সদস্যরা বিব্রত বোধ করেন। কিন্তু এ বিষয়ে তারা প্রকাশ্যে কোনো কিছু বলতে চান না। ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ সমর্থক এসব কংগ্রেস সদস্য জানেন যে, তারা যে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিচ্ছেন বা সমর্থন করছেন, তা আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সাংঘর্ষিক। এমনকি তা যুক্তরাষ্ট্রের অনুসৃত নীতিমালারও পরিপন্থী। কিন্তু তারপরও তারা ইসরায়েলের পক্ষে আনা সেই প্রস্তাবে চোখ বন্ধ করে ভোট দিয়ে থাকেন।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ও কংগ্রেসে ইসরায়েলি লবি এতটাই শক্তিশালী যে, এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। ড. জগবি বলেন, আমি অনেক কংগ্রেস সদস্যকে একথা বলতে শুনেছি যে, ‘সামনে আমার নির্বাচন রয়েছে। কাজেই আমি এ বিষয়ে মুখ খুলতে পারব না। তাহলে আমাকে নির্বাচনে হারতে হবে।’ অর্থাৎ তারা অন্যায় কাজ করছেন জেনে বুঝেও ইসরায়েলকে সমর্থন করে যান।

এভাবেই ইসরায়েলি লবি বা ককাসের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিক ও আইনপ্রণেতারা নিজেদের স্বত্বা বিকিয়ে দিয়েছেন ইহুদি লবির কাছে। তারা নিজেদের নির্বাচন ও পুনর্নির্বাচনের বাইরে আর কারও স্বার্থের কথা বিবেচনা করেন না। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থও তখন তাদের কাছে গৌণ হয়ে পড়ে।

তবে কিছু কংগ্রেস সদস্য আছেন, যারা নীতির বাইরে গিয়ে কোনো কিছু করার পক্ষে নন। কিন্তু এদের সংখ্যা খুবই কম। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যই হচ্ছেন ইসরায়েলের একনিষ্ঠ সমর্থক। রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক দুই দলেই এই সদস্যরা রয়েছেন। নির্বাচনের সময় তারা ইসরায়েলি লবি ও বড় বড় ইহুদি ব্যবসায়ীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ বা চাঁদা নিয়ে থাকেন। এই কালো টাকার বিনিময়ে তারা ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করেন। এখন এটাই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার চরিত্র হয়ে উঠেছে।

এ ধরনের পরিস্থিতির ফলে কংগ্রেসও দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়ছে। কংগ্রেস এখন এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে, রোগ-ব্যাধি কিংবা বন্দুক হামলা থেকে জীবন বাঁচাতে আইন পাশ করতে পারছে না, পরিবেশ রক্ষায় কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না। এমনকি নির্বাচনে ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতেও ব্যর্থ হচ্ছে।

কংগ্রেসের অনেক সদস্যই জনগণের অধিকার রক্ষায় কাজ করার পরিবর্তে কীভাবে তাদের প্রতিপক্ষের ক্ষতি করা যাবে, কীভাবে নির্বাচনের জন্য বেশি চাঁদা তোলা যাবে, তা নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকেন। এছাড়া এসব সদস্য সেই সব লবিস্টকে সন্তুষ্ট করার জন্য তৎপর থাকেন, যারা তাদের পুনর্নির্বাচনে মোটা অংকের চাঁদা দেবে কিংবা তার বিরুদ্ধে খাটবে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথাই ধরা যাক। তিনি বারবার দাবি করেছেন যে, ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনিই বিজয়ী হয়েছেন। কিন্তু তার বিজয়কে ছিনতাই করেছেন ডেমোক্র্যাটরা। তারা ভোট কারচুপি ও জালিয়াতির মাধ্যমে তাকে হারিয়ে দিয়েছে। রিপাবলিকান পার্টির দুই তৃতীয়াংশ ভোটারই ট্রাম্পের এই দাবিকে বিশ্বাস করেন। এই প্রবণতা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

অনেক রিপাবলিকান প্রার্থীই এমনভাবে প্রচারণা চালাচ্ছেন, এমন সব কথা বলছেন যাতে ট্রাম্প ও তার অনুসারীদের সমর্থন পাওয়া যায়। নির্বাচনে নিজের পরাজয় নিয়ে ট্রাম্প যে দাবি তুলেছেন, তারা সেটাকেই সমর্থন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। অথচ ওই নির্বাচনে ট্রাম্প জেতেননি। এ ধরনের তৎপরতার মাধ্যমে তারা কার্যত নির্বাচন ব্যবস্থাকেই বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন।

রিপাবলিকানরা যে সব রাজ্যের আইনসভা ও নির্বাহী বিভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে, সেখানে তারা এমন আইন পাস করার চেষ্টা করছে, যেটা দিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা ও ভোট প্রক্রিয়ার ওপর দলীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায়। অথচ মার্কিন কংগ্রেস ভোটারদের অধিকার রক্ষায় আইন পাস করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে আমেরিকান গণতন্ত্র ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে।

ইসরায়েলের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। লক্ষ্য যখন হয়ে দাঁড়ায় বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষমতায় ফেরা ঠেকানো, তখন নীতি ও সুশাসনের প্রসঙ্গটি একপাশে পড়ে থাকে। ইসরায়েল নিজেকে মধ্যপ্রাচ্যের একমাত্র গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করে থাকে। কিন্তু ৫০ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনির ভূখণ্ড দখল করা এবং নিজের দেশের ২০ লাখ ফিলিস্তিনি নাগরিকের সাথে কী আচরণ করা হচ্ছে, তা সবাই দেখছেন। তারপরও ইসরায়েল নিজেকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবি করলে এটা গণতন্ত্রের সাথে তামাশা করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

যে কোয়ালিশন সরকার নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পেরেছে সেখানে ডান, মধ্য ও বামপন্থী দল রয়েছে। আছে আরব ইসলামপন্থী দলও। মূলত কট্টর ইহুদি জাতীয়তাবাদী দলগুলোই এই কোয়ালিশনের শরিক হয়ে এক ছাদের নিচে এসেছে। কিন্তু এই কোয়ালিশনের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে নেতানিয়াহুকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখা। এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন করা বা সমুন্নত রাখার কোনো বিষয় নেই।

অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ করার সরকারি নীতি অব্যাহত রাখা হয়। বায়তুল মোকাদ্দাস মসজিদে মুসলমানদের অধিকার খর্ব করা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইহুদি বসতি স্থাপনকারিদের নৃশংসতার বিষয়ে আরব ও বামপন্থী দলগুলোকে মুখ বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয় তখন এ ধরনের কোয়ালিশন গঠন করা তামাশা ছাড়া আর কিছু নয়। সুশাসনের নীতি আরও কার্যকর করার জন্য যে এই কোয়ালিশন গঠন করা হয়নি, তা সহজেই বোঝা যায়।

যুক্তরাষ্ট্র এতদিন নেতানিয়াহুকে যেভাকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, ঠিক একইভাবে তার উত্তরসুরী প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটকেও সমর্থন দিচ্ছে। তার সরকারকে বিব্রত না করার জন্য বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করার পরিকল্পনা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো সমালোচনা করছে না।

যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য দেশের আইনের শাসন, মানবাধিকার ও বিচার ব্যবস্থা নিয়ে সব সময়ই কথা বলে থাক। কিন্তু ইসরায়েলের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সব সময়ই চুপ করে থাকে। সে কারণেই পর্যক্ষেকরা একথা বলেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের রাজনীতি একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।