নতুন তিন বিপদে নয়াদিল্লি


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০১ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪১

চীনের মতো বৃহৎ সামরিক শক্তির সামনে এমনিতেই অনেকটা অসহায় ছিল ভারত। তার সঙ্গে ছিল পাকিস্তানের সঙ্গে বৈরিতা। এই দুটি দেশের সঙ্গে সামরিক সংঘাতে বিপন্ন ছিল ভারত। কিন্তু সম্প্রতি ভারতের সেই বিপন্ন অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। মড়ার ওপর খাড়ার ঘা হিসেবে ভারতের সামনে এসেছে আরও তিন বিপদ। এগুলো হলো- আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল, করোনায় বিপর্যস্ত ভারতের অর্থনৈতিক সংকট এবং নয়াদিল্লিকে কোণঠাসা করে কোয়াডের পরিবর্তে অকাস জোট গঠন।

ভারত ও চীনের মধ্যে অর্ধশতাব্দীর সবচেয়ে মারাত্মক সংঘর্ষ হয় গত বছর। এরপর থেকেই ভারতের সামরিক বাহিনী হিমালয় পর্বতের উঁচুতে ৫০০ মাইল বিস্তৃত সীমান্তকে শক্তিশালী করার জন্য জরুরি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।

গত এক বছরে ভারত বিতর্কিত পূর্ব লাদাখ অঞ্চলে সেনার সংখ্যা তিনগুণ বাড়িয়ে ৫০ হাজারে উন্নীত করেছে। শীতকালের বেশিরভাগ সময় এ অঞ্চলটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর আগেই হিমাঙ্কের নীচের তাপমাত্রা এবং ১৫ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থানরত সেনাদের জন্য খাদ্য এবং অন্যান্য সামগ্রী মজুদ করতে মরিয়া চেষ্টা চলেছে। ভারত ঘোষণা করেছে, তারা সেনাবাহিনীর একটি সম্পূর্ণ স্ট্রাইক কোর অর্থাৎ আরো হাজার হাজার সৈন্যের আক্রমণাত্মক বাহিনী পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বিতর্কিত সীমান্তে পুনর্বিন্যাস করবে।

ভারতের সামরিক বাহিনী এখন একটি কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি। দেশটি প্রায় দুই দশক ধরে আশঙ্কা করছে তারা চীন ও পাকিস্তানের মতো শত্রু প্রতিবেশীদের সঙ্গে দুই-ফ্রন্টে সংঘর্ষে আটকে আছে। এই তিনটি প্রতিবেশী দেশই পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী। এর মধ্যে চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ভারতের বড় মাথাব্যথার কারণ।

ভারতের জন্য হালে আরও দুশ্চিন্তার কারণ দেশটি ক্রমেই প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অকাস চুক্তি ভারতকে আরও বেশি বিপদে ফেলেছে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানকে নিয়ে যে কোয়াড জোট গঠিত হয়েছিল তা এখন কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। ভারত তার নিরাপত্তার জন্য কোয়াডের ওপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।

অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ ভারতের প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে চীন বিনিয়োগ এবং নিজেদের অবস্থান সংহত করেছে। তালেবানের আফগানিস্তানে বিজয় ভারতের জন্য একটি বিশাল ধাক্কা। আগে ভারত আফতানিস্তানকে আঞ্চলিক মিত্র হিসেবে দেখেছে। কিন্তু তালেবান সরকার তাদের বৈরি বলেই মনে হচ্ছে। অন্যদিকে ভারতের শত্রু চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক ঊষ্ণ।

ভারত ও চীনের মধ্যে শেষ পর্যন্ত সর্বাত্মক যুদ্ধ নাও হতে পারে। কিন্তু সীমান্তে ভারতের সামরিক প্রস্তুতি দেশটির আর্থিক রক্তক্ষরণ ঘটাচ্ছে। করোনাভাইরাস মহামারি ভারতের অর্থনৈতিক মন্দাকে আরও গভীর করেছে। ভারতের সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়ন কঠিন হয়ে পড়েছে অর্থ সংকটের কারণে।

ভারত ও চীনের মধ্যে বিশ্বাসের ভাঙন এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে গত বছর সীমান্তে মারাত্মক সংঘষে বহু ভারতীয় সেনা নিহতের পর পর থেকে বারবার আলোচনা হলেও উত্তেজনা কমেনি। মনে হচ্ছে উভয় দেশই যুদ্ধে না জড়ালেও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে থাকবে।

আর এ পরিস্থিতিতে চীন সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কারণ চীনা সামরিক বাহিনী অনেক আধুনিক ও সুসজ্জিত। তাদের অর্থের অভাব নেই। ভারতের তুলনায় পাঁচগুণ বড় অর্থনীতির দেশ চীনও এই অঞ্চলে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করছে দিল্লির প্রভাব ঠেকাতে।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক প্রধান জেনারেল বেদ প্রকাশ মালিক বলেন, গত বছর গালওয়ান উপত্যকায় সংঘর্ষে অন্তত ২০ জন ভারতীয় সেনা এবং চারজন চীনা সৈন্য মারা যায়। এই ঘটনা ভারতের হিসাবকে মৌলিকভাবে বদলে দিয়েছে। জেনারেল মালিক বলেন, ‘গালওয়ান আরেকটি বার্তা বহন দিয়েছে যে চীন তার স্বাক্ষরিত চুক্তিগুলিকে সম্মান করছে না। আমার মনে হয় গালওয়ানের সবচেয়ে ভারতের বড় ক্ষতি ২০ সেনাকে হারানো নয়। বরং বড় ক্ষতি হলো চীন ভারতের বিশ^াস ভেঙে দিয়েছে।’

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেনাবাহিনীতে সংস্কার দ্রুত করার চেষ্টা করছেন। সীমান্তে সংঘর্ষের পর তার সরকার গত বছর সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত জরুরি তহবিল দিয়েছে। কিন্তু মন্থর অর্থনীতি ভারতের সীমাবদ্ধতাগুলিকে প্রকট করে তুলেছে। মোদির নতুন প্রতিরক্ষা বাজেটে সেই বার্তা স্পষ্ট ছিল। সামরিক বাহিনীর জন্য ভারত সরকার ব্যয় বেশি বাড়ানোর ক্ষমতা রাখে না। বাজেটে যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বেশি অর্থ বরাদ্দ করা হলেও প্রতিরক্ষা খাতে সামগ্রিক বরাদ্দ ক্রমাগত হ্রাস পাচ্ছে। কারণ দেশটির জিডিপি ও সরকারি ব্যয় কমে যাচ্ছে। অথচ হিমালয় অঞ্চলে এই ধরনের সৈন্যের উপস্থিতি বজায় রাখা একটি বিশাল লজিস্টিক ব্যাপার। শুধু সৈন্য দিয়ে সীমানা সুরক্ষিত করা যায় না।

দীর্ঘদিন ধরে সম্পদের অভাব রয়েছে ভারতের সামরিক বাহিনীর। প্রতিরক্ষা ব্যয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ চলে যায় রুটিন খরচে। এর মধ্যে রয়েছে পেনশন, বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণ। ২০২০ সালে চীনের সামরিক বাহিনীর বাজেট ছিল অন্তত ২৫২ বিলিয়ন ডলার। বিপরীতে ভারতের বরাদ্দ ছিল ৭৩ বিলিয়ন ডলার যা চীনের মাত্র এক চতুর্থাংশ। চীন সীমান্তবর্তী ভারতের নর্দার্ন কমান্ডের নেতৃত্ব দানকারী অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল ডিএস হুডা বলেন, আসল বিষয় হল যে আগামী কয়েক বছরেও ভারতের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য অতিরিক্ত বাজেট সহায়তা আসার সম্ভাবনা নেই।

১৯৬২ সালে একটি বড় যুদ্ধে ভারত চীনের কাছে শোচনীয়ভাবে হেরে যায়। এরপর থেকে ভারত এবং চীন মূলত আলোচনা এবং চুক্তির মাধ্যমে বিরোধ নিয়ন্ত্রণ করেছে। তারপরও মাঝে মাঝেই উত্তেজনা বেড়ে যায়। কারণ দুই দেশ তাদের ২ হাজার ১০০ মাইল সীমান্ত নির্ধারণে এখনো একমত হতে পারেনি। দুই দেশের সীমান্ত প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা হিসাবে পরিচিত। ভারতীয় কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের চীনা প্রতিপক্ষ সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে অনিচ্ছুক। এর মাধ্যমে তারা ভারতকে চাপে রাখতে চায়।

গত বছরের সংঘর্ষ নরেন্দ্র মোদির জন্য ছিল একটি বিরাট ধাক্কা। তিনি দীর্ঘদিন চীনের সঙ্গে সমঝোতা তৈরিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। মোদি ভেবেছিলেন দুই দেশের সহযোগিতামূলক সম্পর্ক ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাহায্য করবে। পাশাপাশি এটি সংঘাতের হুমকিকেও হ্রাস করবে।

মোদি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দুই দেশের নেতারা প্রায় ২০ বার সাক্ষাৎ করেছেন। এমনকি ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে ৭৩ দিনের উত্তেজনার পরও মোদি সেই প্রচেষ্টা বাদ দেননি।

দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নত করতে চীনে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের তিনটি ভারত সফরের সময় মোদি তার সঙ্গে একই দোলনায় চড়েছেন এবং তাকে তাজা নারকেল পরিবেশন করেছেন। আবার মোদির পাঁচটি চীন ভ্রমণের একটিতে জিনপিং তাকে ১৯৭০ এর দশকের একটি বলিউড গান বাজিয়ে একটি চীনা দল নিয়ে স্বাগত জানান। তখন মোদি সহাস্যে হাততালি দিয়েছিলেন। সেই গানটির কথা ছিল, ‘তুমি, তুমিই সেই হৃদয় যাকে নিজের করে নিয়েছে।’

কিন্তু ভারতীয় সামরিক নেতৃত্ব মোদির চেয়ে বেশি সতর্ক ছিল। ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে থেকেই উদীয়মান চীনের বিরুদ্ধে তারা সতর্ক। তার পরও পূর্ব লাদাখে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভীষণ দুর্বল। কারণ সেখানে চীনের আঞ্চলিক সুবিধা রয়েছে। তিব্বতের মালভূমির কারণে চীনা সেনাদের যাতায়াত অনেক সহজ। পাশাপাশি ভারত সীমান্তে ভাল অবকাঠামোও গড়ে তুলেছে চীন।

২০০৬ সাল থেকে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে, ভারত সরকার তার অবস্থান উন্নত করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিল। চীন সীমান্তের কাছাকাছি হাজার হাজার মাইল রাস্তা নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে। সেনাবাহিনীর নতুন বিভাগ তৈরি করেছে। এমনকি চীন সীমান্তের জন্য একটি মাউনটেইন স্ট্রাইক ফোর্স তৈরির আদেশও দিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতের কাগুজে উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা দুষ্প্রাপ্য সম্পদের বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। মাউনটেইন স্ট্রাইক ফোর্সের ভবন অর্ধেক তৈরির পর কাজ বন্ধ হয়ে আছে। এর কারণ কিন্তু এটা নয় যে, চীনের কাছ থেকে হুমকি কমে গেছে। কারণ হলো ভারতীয় বাহিনীর অর্থ নেই।

ভারতের একটি সুবিধাজনক দিক হলো তার সৈন্যদের পর্বতের উচ্চতার লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কয়েক দশক ধরে ভারতীয় সামরিক বাহিনী পাহাড়ে বিশাল লজিস্টিক অপারেশন চালিয়ে আসছে। প্রতিদিন শত শত টন ম্যাটরিয়াল পরিবহন করে যা পাকিস্তান ও চীনের বিরুদ্ধে ৭৫ হাজার সৈন্যকে রক্ষা করে। শীতের ছয় মাসের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী মজুদ করে রাখে। কারণ এ সময় অনেক রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। পৃথিবীর ছাদের যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে পরিচিত সিয়াচেন হিমবাহে ভারতীয় বাহিনী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে পাকিস্তানের সাথে মুখোমুখি অবস্থান বজায় রেখেছে।

কিন্তু দুই ফ্রন্টে ভারতের বর্ধিত উপস্থিতি টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে। চীন সীমান্তে সেনা বাড়াতে হলে ভারতের রিজার্ভ সৈন্যের টান পড়ে। আবার পাকিস্তান সীমান্ত থেকেও সেনা সরিয়ে নিতে হয়। দুটোই কৌশলগত দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ।

আবার সর্বোচ্চ উচ্চতায় হঠাৎ সেনা মোতায়েন করতে গেলে পরিবহন খরচ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। যেমন সমতল ভূমিতে সেনা চৌকি তৈরির তুলনায় পূর্ব লাদাখে খরচ পাঁচ গুণ বেশি।

ভারতীয় যুদ্ধ কলেজের সঙ্গে যুক্ত সাবেক মেজর জেনারেল বীরেন্দ্র সিং ধানোয়া বলেন, এমন নয় যে সিয়াচেনের মতো জায়গায় সেনারা ১৫ দিনের জন্য টহল দিতে যায় আবার ফিরে আসে। তারা তাদের আর্কটিক তাঁবু পিঠে নিয়ে অনেক সময় চিরদিনের জন্য বিদায় নেয়। এতে অর্থনৈতিকভাবে দেশের অনেক ক্ষতি হয়।

ভারতের সঙ্গে উত্তরাঞ্চলীয় সীমান্ত নিয়ে চীনের উত্তেজনা যখন চলছে, তখন ‘এশিয়ার ন্যাটো’ হিসেবে পরিচিত কোয়াড নিরাপত্তা ইস্যু থেকে সরে গেছে। ফলে এ জোটে থেকে ভারতের লাভ কতটুকু সেই প্রশ্নও উঠছে।

চীনকে চাপে রাখতে কিছুদিন আগেও যুক্তরাষ্ট ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল। কিন্তু অকাস চুক্তির মানে হলো সেই জায়গাটি এখন আর থাকছে না। চীনকে চাপে রাখার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এত দিন যেভাবে কোয়াডের সদস্য হিসেবে ভারতকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে, সেই জায়গাটি এখন নড়বড়ে হয়ে গেছে।

ভারত- প্রশান্ত মহাসাগর আদতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতার ক্ষেত্র। এই প্রতিদ্বদ্বিতা মূলত নৌ এলাকাভিত্তিক। ভারতের সামরিক শক্তি নৌভিত্তিক নয়, তাই কোয়াডে ভারতের উপস্থিতি নৌশক্তিতে বলীয়ান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খুব একটা উপকারে আসবে না। আবার ভারতের সঙ্গে চীনের উত্তেজনা চলে মূলত স্থলসীমানায়। অরুণাচল প্রদেশের মতো পার্বত্য এলাকায় কোয়াডের অন্য মিত্ররা ভারতকে কোনো সহায়তাই করতে পারবে না।

বিশ্লেষকরা বলছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত সরকার কোয়াড ইস্যুতে ভুল করেছে। ভারত নিজেকে চীনের হাত থেকে বাঁচাতে কোয়াডের কাছে যতটা সহযোগিতা আশা করেছিল, সেই আশা ক্রমে ফিকে হয়ে আসছে।