পাকিস্তান ছাড়া উপায় নেই পশ্চিমাদের


  • হায়দার সাইফ
  • ১৬ অক্টোবর ২০২১, ১৪:৫৩

পাকিস্তান এশিয়া অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার। যুক্তরাষ্ট্র অতীতে এই প্রবেশপথের সহায়তা নিয়েছে। পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তান আমেরিকান ক্লাবে যোগ দেয়। তখন থেকেই ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছে দুই দেশ। তাদের মধ্যে প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি হয় ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল। পাকিস্তানের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান। আমেরিকার পক্ষে সেলাহাত্তিন রেফেত আরবেল। চুক্তি দুই দেশকে পরস্পরের কাছাকাছি নিয়ে আসে। শুরু হয় উচ্চপর্যায়ের সফর। পারস্পরিক বোঝাপড়ার উন্নতি হয়। আরও নতুন চুক্তির পথ উন্মুক্ত হয়। দ্বিতীয় চুক্তি হয় ১৯৫৯ সালের মার্চে। এই চুক্তির অধীনে সামরিক সহায়তা পেতে শুরু করে পাকিস্তান। কিন্তু এই সম্পর্কে এখন চিড় ধরেছে।

শীতল যুদ্ধকালে পাকিস্তান ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্রের। কমিউনিস্ট হুমকি মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাদের। ম্যানিলা চুক্তি, বাগদাদ চুক্তি, সেন্টো আর সিয়াটো চুক্তির মতো বহু চুক্তি হয়েছে দুই দেশের। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে যুদ্ধ চালিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সেই আফগান যুদ্ধে প্রথম সারিতে ছিল পাকিস্তান। এরপর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানেও ন্যাটোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিল পাকিস্তান।

যুক্তরাষ্ট্রকে আন্তরিকভাবেই সাহায্য করেছে পাকিস্তান। এই অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থকে রক্ষা করেছে তারা। যুক্তরাষ্ট্র যাতে এই অঞ্চলে কৌশলগত লক্ষ্য হাসিল করতে পারে, সেটা নিশ্চিত করেছে পাকিস্তান। মার্কিন নেতারা সেটা ভালো করেই জানে। বিশেষ করে সামরিক কর্তাব্যক্তিদের কাছে সেটা খুবই স্পষ্ট।

চীন-মার্কিন সম্পর্ক নির্মাণেও মধ্যস্থতায় ছিল পাকিস্তান। কাজটা ছিল যথেষ্ট কঠিন। কারণ দুই দেশ ছিল পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বি। শত্রুতাও ছিল তাদের মধ্যে। কিন্তু অসাধ্য সাধন করে পাকিস্তানের নেতারা। সত্তরের দশকে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে। এই সম্পর্ক থেকে দুই দেশই লাভবান হয়েছে।

পশ্চিমের আধুনিক প্রযুক্তি হাতে পেয়ে খুশি হয়েছে চীন। অন্যদিকে, চীনের সস্তা শ্রম আর কাঁচামালের সুবিধা নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের পথে মার্কিন প্রবেশদ্বার ছিল পাকিস্তান। দুই দেশের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের সফর আয়োজনেও ভূমিকা ছিল তাদের। পাকিস্তানের এই ভূমিকার স্বীকৃতিও দিয়েছে চীন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অতীত ভুলে গেছে। তারা ভাবছে যে, পাকিস্তানকে বোকা বানিয়ে উদ্দেশ্য হাসিল করে নিয়েছে তারা।

তবে এখনও ইতিবাচক মনোভাব ধরে রেখেছে পাকিস্তান। চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রুতা প্রতিদিনই বাড়ছে। পাকিস্তান এই দূরত্ব ঘোঁচাতে চায়। দুই পরাশক্তিকে আবার কাছাকাছি নিয়ে আসতে চায়। সেটা করার সক্ষমতা পাকিস্তানের আছে। আশির দশকে আফগানিস্তানে জয় পেতে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছিল পাকিস্তান। ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের পরেও পাকিস্তানের সহায়তা পেয়েছে মার্কিনিরা। পাকিস্তান সবসময় এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রকে কৌশলগত লক্ষ্য হাসিলে সাহায্য করেছে।

তালেবানদের আলোচনার টেবিলে আনতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও পাকিস্তানের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। পাকিস্তান সেখানেও সফল হয়েছে। পাকিস্তান সে সময় আফগানিস্তানে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। তাদের ভূমিকার প্রশংসা করেছে সে সময়ের মার্কিন ও বিশ্ব নেতারা।

সম্প্রতি তালেবানরা দ্বিতীয়বারের মতো ক্ষমতায় এসেছে। তাৎক্ষণিকভাবে আফগানিস্তান ছেড়ে গেছে বহু বিদেশী ও আফগান নাগরিক। তাদের নিরাপদে দেশ ছাড়ার ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছে দেশটি। বহু আমেরিকান আর ইউরোপিয় কূটনীতিকদের উদ্ধারে সাহায্য করেছে পাকিস্তান। পশ্চিমা নাগরিকদের উদ্ধারেও ভূমিকা রেখেছে। ইউরোপিয় ইউনিয়নের প্রায় সবগুলো দেশ এজন্য পাকিস্তানের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে।

তালেবানদের সাথে পশ্চিমের দর কষাকষিতে মধ্যস্থতা করেছে পাকিস্তান। এখন, তাদের সাথে কার্যকর কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়তে সমস্যা হতে পারে। সেখানেও মধ্যস্থতাকারী হিসেবে পাকিস্তানের ভূমিকা কাজে লাগবে।

কাতার বা তুরস্কও হয়তো তালেবানদের সাথে সম্পর্ক গড়তে সাহায্য করতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তান সম্পকের যে গভীরে যেতে পারবে, সেটা অন্য কেউ পারবে না। চীন, ইরান আর রাশিয়ারও গভীর সম্পর্ক রয়েছে তালেবানের সাথে। কিন্তু পশ্চিমাদের সাহায্য করার কোন ইচ্ছা তাদের নেই।

আফগানিস্তানের বর্তমান সমস্যা সমাধানের পথেও পাকিস্তানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। আফগানিস্তানে শান্তির অর্থ হলো বিশ্ব শান্তি। পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো নিজের দেশে স্থায়ী শান্তি আর স্থিতিশীলতা নিয়ে আসা। আফগানিস্তানের সাথে ২৬০০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে পাকিস্তানের। দুই দেশ পর্বতমালা, নদী ভাগাভাগি করেছে। দুই দেশের রয়েছে অভিন্ন সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম, ঐতিহ্য, রীতিনীতি আর উপজাতি ব্যবস্থা। যে কোন দেশের চেয়ে আফগানিস্তানকে অনেক ভালো বুঝতে পারে পাকিস্তান।

আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির হিসেবও পাকিস্তান ভালো বোঝে। সমাধানের পথও বাতলে দিতে পারে তারা। এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানের প্রচেষ্টা আর ভূমিকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকলে তা সম্ভব হবে না। পাকিস্তানের নিজের স্বার্থে আফগানিস্তানে শান্তি ও স্থিতিশীলতা দরকার। আর এজন্য দরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থন।

পাকিস্তানের ব্যাপারে আমেরিকার কিছু অসুবিধাও রয়েছে। ভারতের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক কখনই ভালো যায়নি। কিন্তু ভারত এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে গেছে। পাকিস্তানের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক আর বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। চীনকে তারা ভারত মহাসাগরের সাথে যুক্ত হওয়ার পথ করে দিয়েছে। কারাকোরাম হাইওয়ে আর গোয়াদর বন্দর ব্যবহার করছে চীন। অথচ চীনকে এখন শত্রু বিবেচনা করে যুক্তরাষ্ট্র। সে কারণে পাকিস্তানকেও দূরে সরিয়ে রাখা তাদের জন্য সুবিধাজনক।

মধ্য এশিয়ায় পাকিস্তান এখন আর যুক্তরাষ্ট্রের মনোযোগের কেন্দ্রে নেই। কিন্তু তাকে অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই। পাকিস্তান তাদের পারমানবিক অস্ত্রসম্ভার বাড়াচ্ছে। চীন ও ভারতের সম্পর্ককে জটিল করে তোলার সক্ষমতা তাদের আছে। আর সে কারণেই পাকিস্তানকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্রের।

এখন পশ্চিমারা যা চাইবে, তার সব কিছু পাকিস্তান করবে না। পাকিস্তানকে চীন থেকে বেরিয়ে আসতে বলে লাভ নেই। ভারতের বিরুদ্ধে একটা শক্ত সামরিক জোটে থাকতে চায় পাকিস্তান। চীনা বিনিয়োগও তাদের দরকার। মুসলিম স্বাথেৃর বিরুদ্ধে গিয়ে আমেরিকার দলে ভেড়াও পাকিস্তানের জন্য সম্ভব নয়। পাকিস্তান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের স্বাভাবিক নেতা মনে করে। সেই জায়গাতে তারা মোটেই ছাড় দেবে না।

এই সব বাস্তবতা সত্ত্বেও পাকিস্তান থেকে সহায়তা নিতে পারে পশ্চিমারা। পাকিস্তানের রাজনীতি আগের চেয়ে কিছুটা শান্ত হয়েছে। ক্ষমতায় সামরিক বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপ এখন নেই। চীনের ঘনিষ্ঠ হলেও পশ্চিমে স্বার্থ রয়েছে তাদের।

পাকিস্তান কিছু অর্জনও করতে চায়। আফগানিস্তাননকে স্থিতিশীল রাখা তাদের নিজের স্বার্থেই দরকার। চরমপন্থাকেও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে চায় ইসলামাবাদ। তেহরিক-ই তালেবানের হাতে যত পাকিস্তানি নিহত হয়েছে, তালেবানের হাতে তত আমেরিকান মরেনি। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহায়তারও প্রয়োজন আছে। এটা সত্য যে, পশ্চিমাদের উপরে চীনকে প্রাধান্য দিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু সম্পূর্ণভাবে চীনের পকেট রাষ্ট্র হওয়ার চেয়ে সেটা পশ্চিমের জন্য ভালো।

পশ্চিমের সবচেয়ে বড় অর্জন হবে, যদি পাকিস্তান আর ভারতের সম্পর্ক কিছুটা স্বাভাবিক হয়। তবে সেটা সহজে হবে না। দুই দেশের রাজনীতিক আর সেনারা একে অন্যকে শত্রুজ্ঞান করে। এর থেকে তারা সুবিধা পায়। তবে পাকিস্তান জানে দীর্ঘমেয়াদে তারা ভারতের সাথে লড়তে পারবে না।

আবার হিমালয় সীমান্তে সঙ্ঘাতের পর ভারতেরও একটা উপলব্ধি হয়েছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে শক্তি না দেখিয়ে চীনের মোকাবেলা করা অনেক বেশি দরকার। পশ্চিমারা যদি দীর্ঘমেয়াদি অঞ্চলকে নিরাপদ করতে চায় সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে তাদের দরকার হবে।

পাকিস্তানের পাশেই রয়েছে আফগানিস্তান। আফগানিস্তানের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য, শান্তি আর স্থিতিশীলতা অর্জন করতে না পারলে পুরো অঞ্চল অস্থির হয়ে পড়তে পারে। এ কারনে আফগানিস্তানের নতুন সরকারের প্রতি মানবিক সহায়তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তাদের স্বীকৃতির বিষয়গুলো বিবেচনা করা দরকার। সন্ত্রাসী তালিকা থেকে বাদ দিয়ে এক সাথে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করা দরকার।

আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়কে পাকিস্তানকে সম্পৃক্ত না করলে পরিস্থিতি আরো দ ব্যর্থ জটিল হয়ে পড়তে পারে। আফগানিস্তানের নতুন শাসকরা যদি ব্যর্থ হয় তাহলে দীর্ঘ মেয়াদে আরেকটি যুদ্ধের মধ্যে পড়বে আফগানিস্তান। এতে শুধু পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা নয় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্থ হবে। এমনকি ভারতের নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়তে পারে।