সিরিয়ার মাটিতে রাশিয়া-আমিরাতের যৌথ পদক্ষেপ


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০২ আগস্ট ২০২১, ১৫:০১

মোহাম্মদ বিন জায়েদের চিন্তাধারার আলোকে সংযুক্ত আরব আমিরাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চাভিলাষী পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেছে। এক যুগ আগে আরব বসন্তের সূচনা হওয়ার পর আবুধাবি এখন মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার অনেক দেশের ক্ষমতার পালাবদলের নেপথ্যে ক্রীড়নকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আরব আমিরাত ২০১১ সালের পর থেকে সৌদি আরবের সাথে মিলে একসাথে কৌশল প্রনয়ণ করে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে। আবুধাবি ও রিয়াদের সংহতি প্রতিষ্ঠার মূল কারণ ছিল, উভয় দেশই আরব বসন্তের চেতনাবিরোধী। উভয় দেশই ইসলামি সংগঠনগুলোকে নিজেদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে বিবেচনা করে।

এই মুহূর্তে বাহরাইনের রাজপরিবারকেও সৌদি আরব ও আমিরাত ব্যাপক সমর্থন দিয়েছে। যদিও বাহরাইনের এ শাসকমহলের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ রয়েছে। মিসরেও ২০১৩ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর জেনারেল সিসি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করার পরও আমিরাত ও রিয়াদ তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। আবার লিবিয়াতেও জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত সরকারের বদলে জেনারেল খলিফা হাফতারকেই সাহায্য করা হয়েছে। ২০১৫ সালের ইয়েমেনে অপারেশন ডিসাইসিভ স্টোর্ম এবং ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত কাতার অবরোধেও দুই দেশ একইরকম ভূমিকা পালন করেছে। মিসরের ইখওয়ানসহ বিভিন্ন দেশের ইসলামি সংগঠনগুলোকেও সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আবুধাবি ও রিয়াদ সংজ্ঞায়িত করেছে। সর্বশেষ তিউনিসিয়াতেও ক্ষমতার পালাবদল ও নীরব অভ্যুত্থানের বিষয়ে আরব আমিরাতের ভূমিকা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সৌদি আরবও তিউনিশিয়ার প্রেসিডেন্ট কয়েস সাইদকে অভিনন্দন জানিয়ে তার সাম্প্রতিক অভ্যুত্থানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছে।

তবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবের সম্পর্কে কিছু টানাপড়েনও দেখা দিয়েছে। আবুধাবি যেমন তার মতো করে মধ্যপ্রাচ্য নীতি অবলম্বন করেছে, সৌদি আরবও তাই। দুই দেশই নিজেদেরকে একে অপরের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করছে। সৌদি আরবের যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানের বিষয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতিবাচক মানসিকতা এবং সৌদি প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের ক্রমাগত অভিযোগের ইস্যুতেও আমিরাত তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। যদিও রিয়াদ ও আবুধাবি এখনো মধ্যপ্রাচ্যে একই ধরনের বিষয় ও সংগঠনকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে, তারপরও তাদের কৌশলগুলো আলাদা। কেননা তাদের অগ্রাধিকার, দৃষ্টিভঙ্গি, কৌশল এবং স্বার্থের ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে।

সৌদি কাতারের সম্পর্ক উন্নয়ন, ইরানের সাথে সৌদি কর্মকর্তাদের বৈঠক, সৌদি টিভিতে হামাস নেতার সাক্ষাতকার প্রচার, ইয়েমেনের ট্রানজিশনাল কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা এবং আব্রাহাম চুক্তির বাস্তবায়ন নিয়েও সৌদি আরবের সাথে আমিরাতের দূরত্ব বেড়েছে। নতুন করে আরব আমিরাত একটি চাল চেলেছে সিরিয়া এবং এর প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের বিষয়ে।

সিরিয়া যুদ্ধের প্রথম কয়েক বছরে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবের কৌশল একই ছিল। উভয় দেশই আসাদ সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বরং আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদেরকে নানাভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করে। ২০১৪ সালে সৌদি আরব ও আবুধাবি মিলে আরও কিছু পশ্চিমা দেশের সহায়তায় ৪৯টি আসাদবিরোধী ব্রিগেডকে আর্থিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আসাদের বিরুদ্ধে একটি সাউদার্ন ফ্রন্ট চালু করার চেষ্টা করে। একই বছর আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী এবং দুবাইয়ের শাসক মোহাম্মেদ বিন রাশীদ আল মাকতুম মন্তব্য করেন যে, আসাদের বিদায় হতে বেশ সময় লাগবে। কিন্তু যেভাবে তিনি তার দেশের লোকজনকেই হত্যা করছেন, যদি তা অব্যাহত রাখেন, তাহলে আজ হোক বা কাল- তাকে চলে যেতেই হবে। কিন্তু মাকতুম এ কথা বললেও আরব আমিরাত তার অবস্থান খুব বেশি ধরে রাখেনি। সৌদি আরব, কাতার বা তুরস্ক যেমন সিরিয়ার বিষয়ে একই নীতি অবলম্বন করেছে, আমিরাত কখনও তা করেনি। কারণ, আরব আমিরাতের ভয় ছিল, যদি আসাদ বিদায়ও নেয়, হয়তো তার বদলে ক্ষমতায় কোনো ইসলামপন্থী দল চলে আসবে। মোহাম্মদ বিন জায়েদ সবচেয়ে বেশি ভয় পান ইসলামি দলগুলোকে। কারণ তিনি জানেন, কেবলমাত্র এই দলই মধ্যপ্রাচ্য থেকে রাজতান্ত্রিক স্বৈরশাসন ব্যবস্থা উৎখাতের কথা বলে এবং সেই সামর্থ্যও রাখে।

অন্যদিকে, রাশিয়া শুরু থেকেই সিরিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখায় এবং আসাদ প্রশাসন ও সামরিক বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনী একটা সময়ে শক্তিশালী হয়ে যায় এবং আইএস এবং অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাগুলো পুনরায় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। সৌদি আরব এবং যুক্তরাষ্ট্র সম্মত না হলেও আবুধাবিই একটা পর্যায়ে সিরিয়ায় মস্কোর সক্রিয়তার পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন ব্যক্ত করে।

রাশিয়ার বিমান বাহিনী যেভাবে হামলার পর হামলা চালিয়ে সিরিয়ার বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছিল, আরব আমিরাত তাকেও সমর্থন করে এবং জানায়, আবুধাবি এবং মস্কোর শত্রু এবং মিত্র- অন্তত সিরিয়ার ক্ষেত্রে এখন একই। মূলত সিরিয়ায় রাশিয়ার সক্রিয় ভূমিকাই আরব আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে তুরুপের তাসের কাজ করে। রাশিয়াকে সক্রিয় দেখার পর থেকেই আরব আমিরাত দামেস্কের সাথে তাল মিলিয়ে পররাষ্ট্র কৌশল প্রয়োগ করতে শুরু করে যা বিভিন্ন পশ্চিমা দেশকে বিব্রত করে এবং রাশিয়া ও তার মিত্রদের জন্য স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

এরপর ২০১৬ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাত সিরিয়ায় আসাদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ইঙ্গিত দেয়। আমিরাত এমনটা করেছিল কারণ তারা চাইছিল আসাদ যেন ইরানের ওপর থেকে নির্ভরশীলতা কমিয়ে তাদের ওপর আস্থা রাখেন। কিন্তু আমিরাত এমন ইঙ্গিত দেওয়ার সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র তাতে সম্মত হয়নি। কিন্তু আবুধাবি এই আপত্তির পরও সিরিয়া নীতিতে তার দৃষ্টিভঙ্গি সমুন্নত রাখে।

২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে সংযুক্ত আরব আমিরাত দামেস্কে তার কূটনৈতিক মিশন চালু করে। পরবর্তীতে দামেস্কে কর্মরত আমিরাতি কর্মকর্তারাও আসাদের সাহসিকতা ও প্রজ্ঞার ভূয়সী প্রশংসা করে কয়েকদফা বক্তব্য প্রদান করেন। ২০১৯ সালের গোড়ার দিকে আরব আমিরাত সিরিয়ায় সরাসরি বিমান পরিচালনা শুরু করে এবং সিরিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কও পুনরায় চালু হয়। এমনকি আমেরিকার আপত্তিকে তোয়াক্কা না করে সিরিয়ার ৪০ জন ব্যবসায়ীকে ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে আমিরাত নিজ দেশে লালগালিচা সম্বর্ধনা দেয়, যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ওয়াশিংটনের স্যাংকশন তালিকাতেও শামিল ছিল।

২০২০ সালে কোভিড মহামারি আসার পর মোহাম্মাদ বিন জায়েদের সাথে প্রেসিডেন্ট আসাদের কথা বলার পর আমিরাত সিরিয়াকে বিপুল পরিমাণে চিকিৎসাসামগ্রী প্রদান করে। আরও বেশ কিছু কারণে সিরিয়ার বিষয়ে আরব আমিরাতের এই ইউটার্নটি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। যেমন- প্রথমত, আরব আমিরাত প্রতিটি আরব দেশের সাথে আরব আমিরাতের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পর্ক রাখতে চায়।

মধ্যপ্রাচ্যে কোনোভাবেই তুরস্কের নিও-অটোম্যান এজেন্ডা বাস্তবায়ন দেখতে চায় না আমিরাত। বরং আবুধাবি এখন উত্তর সিরিয়ায় তুরস্কের দৌরাত্ম্য কমাতে আসাদ প্রশাসনকে নিজেদের কাজের সহযোগী হিসেবেই বিবেচনা করে। দ্বিতীয়ত, আরব আমিরাত সিরিয়াতে সক্রিয়তা বাড়িয়ে সিরিয়ায় ইরানের প্রভাব হ্রাস করে সিরিয়াকে পুনরায় আরব বিশ্বের প্রভাবসীমার আওতায় শামিল করতে চায়। ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর থেকেই সিরিয়ার আসাদের সাথে ইরানের সম্পর্ক হুট করে অনেক গভীর হয়ে যায়। এই পরিস্থিতির অবসান চায় আমিরাত। আমিরাতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনওয়ার গারগেশও মনে করেন, তুরস্ক ও ইরানের প্রভাববলয় থেকে সিরিয়াকে বের করে নিয়ে আসার জন্যই আরব আমিরাত সিরিয়ার সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করেছে। এ-কারণেই আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরানো একসময় আমিরাতের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত এজেন্ডা হলেও বর্তমানে ইরান ও তুরস্ককে সরানোই তাদের মূল এজেন্ডায় পরিণত হয়েছে।

তৃতীয় কারণটি হলো আবুধাবি মেনে নিয়েছে যে, সিরিয়ার এই দীর্ঘমেয়াাদ যুদ্ধে কার্যত আসাদ প্রশাসনই জয় লাভ করেছে। তাই সিরিয়ার সাথে সম্পর্ক চালু করাকে দেশটি সময়ের অপরিহার্য বাস্তবতা বলেই গণ্য করছে। এই মুহূর্তে তাই বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়াকে আবুধাবি মৃতপ্রায় ঘোড়ার পক্ষে দাঁড়ানো হিসেবেই মূল্যায়ন করছে। চতুর্থত, আমিরাতের নেতা ও বিনিয়োগকারীরা সিরিয়ায় বিনিয়োগ করার ভালো সম্ভাবনা দেখছেন। কেননা, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি গড়তে সবমিলিয়ে কয়েক বিলিয়ন ডলারের প্রয়োজন। আবুধাবি যদি এক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে তাহলে তা কোনো নিছক সহায়তা হিসেবে হবে নয়, বরং এর মাধ্যমে সিরিয়ার প্রশাসনের ওপর আমিরাতের একটি স্থায়ী প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হবে।

যদিও সিরিয়ার মাটিতে এ ধরনের আমিরাতি বিনিয়োগ ঠেকানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যে কায়েসার অ্যাক্ট নামক একটি অবরোধ আরোপ করেছে, আমিরাত তারপরও জানিয়ে দিয়েছে, তারা সিরিয়াতে কাজ করতে চায় এবং আশা করে, যুক্তরাষ্ট্র খুব শীঘ্রই এ সংক্রান্ত অবরোধ তুলে নেবে। সিরিয়ার বিষয়ে আমিরাতের বাড়তি আগ্রহের আরেকটি বড় কারণ রাশিয়া।

২০১৫ সালে যখন রাশিয়া সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তখন থেকেই আমিরাত আশাবাদী ছিল যে, সিরিয়া বোধয় ইরানের ওপর থেকে ভরসা কমিয়ে বরং মস্কোর ব্যাপারেই বেশি মনোনিবেশ করবে। রাশিয়ার প্রতি সিরিয়াকে আরও বেশি দুর্বল করার জন্য আরব আমিরাত পরোক্ষ কূটনৈতিক কৌশলও প্রণয়ন করে। আমিরাত যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে অনুরোধ করে যাতে তারা রাশিয়ার ওপর থেকে কিছু অবরোধ তুলে নেয়। তাহলে এর প্রভাব হিসেবে এই অঞ্চলে ইরান আরও বেশি কোণঠাসা হয়ে পড়বে।

আমিরাতের হঠাৎ এই আসাদমুখী কৌশলে রিয়াদের সাথে যেমন দূরত্ব তৈরি হয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও। ট্রাম্পের মতো প্রেসিডেন্ট বাইডেনও জানিয়েছেন, তার প্রশাসন আসাদকে অবৈধ শাসক বলেই মনে করে। তারপরও আমিরাত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যাতে আসাদকে আবার আরব বিশ্বের মূলকাঠামোর আওতায় স্বীকৃতি দেওয়া যায়। যদিও আরব আমিরাত ও জিসিসি দেশগুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা থাকায় তারা সরাসরি সিরিয়ায় অর্থনৈতিক ও ব্যবসায়িক বিনিয়োগ করতে পারবে না, তবে বোঝাই যাচ্ছে, আমিরাত পরোক্ষভাবে এই কার্যক্রমগুলো সিরিয়ায় ঠিকই শুরু করে দেবে।

কাতার যদিও এ-ক্ষেত্রে পশ্চিমা ব্লকের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সহমত পোষণ করেছে, কিন্তু আমিরাতের সাথে সিরিয়া ইস্যুতে ইতোমধ্যেই মস্কো ও বেইজিংয়ের চিন্তার ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আবুধাবি বিশ্বাস করে, সিরিয়ার জন্য এখন আসাদ আর কোনো বোঝা নয় বরং আসাদকে দিয়েই আগামীর সিরিয়ায় কার্যকর উন্নয়ন করা সম্ভব হবে।