চীনকে মোকাবিলায় আটঘাট বেঁধে নামছে যুক্তরাষ্ট্র


  • মোতালেব জামালী
  • ৩০ জুলাই ২০২১, ১৬:২৮

বাইডেন প্রশাসন বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মার্কিন সামরিক ঘাঁটিগুলো কমিয়ে আনার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। একইসঙ্গে তারা যুদ্ধ প্রস্তুতির যাবতীয় সরঞ্জাম ফারইস্ট বা দূরপ্রাচ্যের দিকে কেন্দ্রিভূত করছে। ওয়াশিংটন মনে করছে, এই পথেই তারা চীনকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করতে পারবে। এশিয়ার দিকে নজর দেওয়ার এই নীতি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলেই গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু এতদিন তা গুরুত্বের সাথে নেওয়া হয়নি। জো বাইডেনের প্রশাসন চীনকে শক্তহাতে মোকাবিলা করার কার্যকর উপায় হিসেবে এখন এই নীতিকেই গুরুত্বের সাথে নিয়েছে।

গত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলে মধ্যপ্রাচ্যের বিশেষ করে উপসাগরীয় অঞ্চলের অনেক বেশি গুরুত্ব ছিল। কিন্তু এখন আর তা থাকছে না। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এই মুহূর্তে চীনকেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করছেন। ফলে চীনের মোকাবিলায় যে সামরিক প্রস্তুতি নেওয়া দরকার তা তিনি নিচ্ছেন। সেই প্রস্তুতির অংশ হিসেবেই তিনি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মার্কিন সামরিক ঘাঁটি গুটিয়ে ফেলছেন। এই কাজটি সম্পন্ন হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র নজর দেবে চীনকেন্দ্রিক অঞ্চলের দিকে।

আফগানিস্তানে রাজনৈতিক স্থিাতিশীলতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অঙ্গিকার পূরণের জন্য দেশটিতে গত ২০ বছর ধরে সামরিক উপস্থিতি বজায় রেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু তাদের সেই মিশন ব্যর্থ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করছে যুক্তরাষ্ট্র। মধ্যপ্রাচ্য ও আফগাস্তিানসহ বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান চালানো ও সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখার সব সিদ্ধান্তই সঠিক ছিল বলে মনে করেন না প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তার মতে, সামরিক ক্ষেত্রে কিছু কিছু ভুল সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। সেই ভুলগুলোই এখন সংশোধন করতে চাচ্ছেন তিনি। এখন থেকে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অভিযান বা উপস্থিাতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে যাতে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয়, তা নিশ্চিত করতে চান প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

বিশ্বব্যাপী সামরিক ঘাঁটি কমানো ও সামরিক সরঞ্জাম প্রত্যাহারের প্রক্রিয়া এরইমধ্যে অনেকখানি এগিয়েছে। এর অংশ হিসেবে জর্ডান, কুয়েত, ইরাক ও সৌদি আরব থেকে ৮টি প্যাট্রিয়ট অ্যান্টিমিসাইল সিস্টেম সরিয়ে আনা হয়েছে। এছাড়াও সৌদি আরব থেকে টার্মিনাল হাই অ্যালটিচুড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) সিস্টেম নামের একটি অ্যান্টিরকেট সিস্টেমও প্রত্যাহার করা হয়েছে। সরানো হচ্ছে কয়েক স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান ও সৌদি আরবে অবস্থান করা ৭০০ মার্কিন সেনাও।

গত ফেব্রুয়ারি মাসেই প্রেসিডেন্ট বাইডেন সারা বিশ্বে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি পর্যালোচনা করার জন্য পেন্টাগনকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন প্রথমদিকে সামরিক উপস্থিতি পর্যালোচনার এই নির্দেশকে সম্ভবত সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পানেনি। এ কারণে তিনি শুরুতে বলেছিলেন, এই পর্যালোচনার অর্থ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও জাতীয় নিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিয়ে সামরিক সম্পদের ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিশ্চিত করা হবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, পুরো বিষয়টিই চীনকে মোকাবিলাকেন্দ্রিক হতে যাচ্ছে। এ-কারণে সামনের দিনগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক কৌশলে আরও নানা ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে।

গত ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে গিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক নীতি পর্যালোচনা করার বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে দেন। তিনি ঘোষণা দেন, চীনই হতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এর অর্থ হচ্ছে, আগামীতে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বৈরিতা চরম আকার ধারণ করবে। চীনের চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্যই প্রেসিডেন্ট বাইডেন তার প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করছেন। কিন্তু এই প্রস্তুতিতে নানা ফাঁক-ফোকর রয়ে যাচ্ছে বলে গত জুন মাসে লয়েড অস্টিনের বক্তব্যেও উদ্ধৃতি দিয়ে পেন্টাগনের একজন কর্মকর্তা জানান। অস্টিন অভিযোগের সুরে বলেছেন, চীনকে মোকাবিলার প্রস্তুতিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার ঘোষণা ও সেই আলোকে বাস্তবে গৃহীত পদক্ষেপের মধ্যে অনেক তফাৎ আমরা দেখতে পাচ্ছি। বেশ কিছু ক্ষেত্রেই মনোযোগের ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অস্টিনের এই বক্তব্যেও সার কথা হচ্ছে, এশিয়ার দিকে মনোযোগ দেওয়ার পরিকল্পনাকে আক্ষরিক অর্থই বাস্তবে রূপ দিতে হবে। বর্তমানে সারাবিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ৮০০ সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এসব ঘাঁটিতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম। পাশাপাশি ১৫০টি দেশে এক লাখ ৬৫ হাজার মার্কিন সেনা অবস্থাান করছে। এসব বিষয়ে বাইডেন প্রশাসনের সামরিক নীতি পর্যালোচনার বিষয়টি গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে সম্পন্ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতি কমানোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজটি শুরু করা হবে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। এই অঞ্চলকে স্থিাতিশীল করার মার্কিন চেষ্টা পুরোপুরিই ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যকে স্থিতিশীল রাখার চেষ্টা করতে গিয়ে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। অনেক সেনা মোতায়েন ও বোমা বর্ষণের কাজটিও করতে হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনো কিছুই কাজে আসেনি। সেটা সামরিক উপস্থিতি কমানোর একটি কারণ। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে তেল ও গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের জন্য দেশটি এখন আর আগের মতো মধ্যপ্রাচ্যের ওপর নির্ভরশীল নয়। এ কারণেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে মধ্যপ্রাচ্যের গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেকটাই কমে গেছে।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। এর মধ্যে কুয়েতে আছে ১৩ হাজার ৫০০, কাতারে আছে ৮ হাজার, সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছে ৩ হাজার ৫০০, জর্ডানে ৩ হাজার ও সৌদি আরবে আছে ২ হাজার ৫০০ সেনা। বাকি সেনাসদস্যরা অন্যান্য দেশে ও সাগরে নৌবাহিনীর জাহাজে অবস্থান করছে।

তবে সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম প্রত্যাহারে বেশ কিছু জটিলতাও আছে। কেননা এতে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে একটি শঙ্কাও কাজ করবে। তবে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ও তার কূটনেতিক টীম মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছেন। তাদেরকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে যে, তাদের দেশ থেকে সামরিক উপস্থিতি কমানো হলেও যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশকে একেবারে পরিত্যাগ করছে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর নিরাপত্তার দিকে যুক্তরাষ্ট্র সবসময়ই নজর রাখবে বলে তাদেরকে আশ্বস্ত করা হচ্ছে।

কিন্তু আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর তালেবান যোদ্ধারা খুব দ্রুতই দেশটির বিভিন্ন এলাকা দখল করে নিচ্ছে। এখন আফগান সরকার এটা অনুধাবন করতে পারছে যে, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হলে তালেবানকে নিজেদেরই মোকাবেলা করতে হবে। আফগানিস্তানের এ বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলতে পারে। তবে সেই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দূর করার জন্য বাইডেন প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। সৌদি সরকার প্রতিবেশী দেশ ইয়েমেনে ইরানের সাথে গত ৮ বছর ধরে প্রক্সিযুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। মার্কিন কূটনীতিকরা সৌদি সরকারের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। তারা বলছেন, মার্কিন সেনা প্রত্যাহার সৌদি মার্কিন জোটকে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না।

গত শীতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন সৌদি বাহিনীর যে কোনো হামলা বা সামরিক আভিযানে যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন দেওয়া বন্ধ করার ঘোষণা দেন। তবে বাইডেন প্রশাসন মার্কিন বেসামরিক ঠিকাদারদের মাধ্যমে ইয়েমেন অভিযানে ব্যবহৃত সৌদি যুদ্ধ বিমানগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ কাজগুলো করিয়ে দিচ্ছে। এছাড়া মার্কিন নিরাপত্তা সংস্থাগুলো ইয়েমেন সংক্রান্ত বিভিন্ন গোয়েন্দা তথ্য সৌদি আরবকে সরবরাহ করছে। বাইডেনের নতুন সামরিক নীতির সমর্থকরা বলছেন, এইটুকু সহযোগিতা না দেওয়া হলে সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলবে। কেননা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সৌদি আরব এখনও যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের মানবাধিকার লংঘনসহ বেশকিছু অনৈতিক কাজের বিষয়েও ছাড় দেওয়ার মানসিকতা দেখাচ্ছে। এটিও সৌদি সরকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের একটি গ্রিন সিগন্যাল হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।

উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্যান্য মিত্র দেশ বিশেষ করে তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ উপকূলীয় ছোট দেশগুলো তাদের নিরাপত্তার জন্য অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল। কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ এই অঞ্চলের দেশগুলো প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে শঙ্কিত ছিল। এরপর ইরাক ও বর্তমানে ইরান নিয়ে নিরাপত্তা শঙ্কার মধ্যে আছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের হুমকির মুখে নিরাপত্তা দিতেই যুক্তরাষ্ট্র এসব দেশে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করে।

কিন্তু বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর এসব দেশকে এই ধারণা দিতে চেষ্টা করেন যে, শত্রুতা নয় বরং ইরানের সাথে এসব দেশের প্রতিবেশিসুলভ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। তাহলে নিরাপত্তার জন্য তাদেরকে আর যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অতটা নির্ভরশীল থাকতে হবে না। একইসঙ্গে তিনি ইরানের হুমকি কমাতে তিনি দেশটির সাথে পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি একটি চুক্তিতে আসতে সক্ষম হন।

কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে ইরানের সাথে স্বাক্ষরিত চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসেন। বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর ইরানের সাথে আবারো আলোচনা শুরু করেন। তার উদ্দেশ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা কমিয়ে আনা। আবার একইসঙ্গে এশিয়ার দিকে অধিকতর নজর দেওয়া। কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও সৌদি আরব এখন এই শঙ্কার মধ্যে আছে যে, এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতিতে ইরান আরও বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠবে। এসব দেশের শঙ্কার কারণেই বাইডেন এসব দেশে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। গত এপ্রিলে তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাতের কাছে স্টিলথ জঙ্গি বিমানসহ ২৩ বিলিয়ন ডলারের যুদ্ধাস্ত্র বিক্রির অনুমোদন দেন।

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চীফস অব স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক মিলি আভাস দিয়েছেন যে, তিনি মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের বড় সামরিক উপস্থিতির সমর্থক নন। তবে এসব দেশে ছোট্ট আকারের স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি বজয় রাখার বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের মিত্র দেশগুলোকে নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছুটা হলেও আশ্বস্ত করা সম্ভব হবে।