তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থানে মিসরের প্রতিধ্বনি


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৮ জুলাই ২০২১, ১৫:১৫

অনেকটা নাটকীয়ভাবেই তিউনিসিয়ার সর্বময় ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে স্বৈরশাসকরূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট কায়িস সায়িদ। তিনি সংসদ ভেঙে দিয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন। জারি করেছেন কারফিউ। তার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখালে সেনাবাহিনী তাদের ওপর গুলি চালাবে বলে হুঙ্কার দিয়েছেন। তিউনিসিয়ার এ ঘটনাপ্রবাহ ২০১৩ সালে মিসরের সামরিক অভ্যুত্থানের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। বস্তুত, মিসরের মতোই এবার আরেক স্বৈরশাসকের খপ্পরে পড়লেন তিউনিসিয়ার জনগণ।

২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব বসন্ত শুরু হয়েছিল তিউনিসিয়ায়। মোহাম্মদ বুয়াজিজি নামের এক সবজি বিক্রেতা অর্থনৈতিক সংকটে নিজের শরীরে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করলে বিক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে দেশটিতে। এর জেরে কিছুদিনের মধ্যেই পতন হয় স্বৈরশাসক জয়নুল আবেদীন বেন আলীর। এরপর থেকে নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে দেশটিতে এতদিন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল, ছিল একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান।

কিন্তু করোনাভাইরাস সংকট ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে তিউনিসিয়াজুড়ে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার পর ২৫ জুলাই গভীর রাতে প্রধানমন্ত্রী হিশাম মেশিশিকে বরখাস্ত করে পার্লামেন্ট স্থগিত করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট। তিনি ডিক্রি বলে দেশ পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছেন। দেশটির প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তার এ পদক্ষেপকে অভ্যুত্থান বলে অভিহিত করেছে। তার এসব পদক্ষেপের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

এক দশক আগে আরব বসন্তের ফলে শুধু তিউনিসিয়াই একমাত্র গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। এরপর মিসর, লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ায় বিপ্লব সংগঠিত হলেও তার সুফল জনগণ পায়নি। মিসরে এক প্রতি-বিপ্লবে দেশটি আবার অন্ধকার যুগে ফিরে গেছে।

তিউনিসিয়র প্রধান রাজনৈতিক দল এন্নাহাদা প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে ‘গণতন্ত্র ও সংবিধানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান’ বলে মন্তব্য করেছে। এটাকে প্রত্যেক তিউনিসিয়াবাসীর সঙ্গে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ বলে অভিহিতি করে দলটি প্রেসিডেন্টকে অবিলম্বে তার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবি জানিয়েছে। দেশটির দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক দলও প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপের কড়া সমালোচনা করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও একে একটা অভ্যুত্থান হিসেবেই দেখছে।

পার্লামেন্টের স্পিকার ও উদার ইসলামপন্থী দল এন্নাহদার প্রধান রশিদ ঘানুশি প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে প্রতিহত করতে জনগণকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তবে টেলিভিশনে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট সায়িদ যে কোনো সহিংস প্রতিবাদের বিরদ্ধে হুঁশিয়ারি জানিয়ে বলেছেন, যারা অস্ত্র নিয়ে নামার কথা ভাবছেন তাদের সতর্ক করে বলছি, যে কেউ একটি গুলি ছুড়লে সশস্ত্রবাহিনী গুলি ছুড়ে তার জবাব দেবে।

তার এ বিবৃতির কয়েক ঘণ্টা পর সামরিক বাহিনীর গাড়ি পার্লামেন্ট ভবন ঘিরে ফেলে। সেনাবাহিনী রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশন ভবনের দখল নিয়ে নেয়। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী তিউনিসে আলজাজিরার কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে সেটি বন্ধ করে দিয়েছে। আলজাজিরাকে এন্নাহদার প্রতি সহানভূতিশীল বলে মনে করা হয়।

৬৭ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট – কায়িস সায়িদ একজন সংংবিধান বিশেষজ্ঞ। দেশটির বর্তমান সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম তিনি। ২০১৯ সালে স্বতন্ত্র প্রাথী হিসেবে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হয়ে তিনি একে বিপ্লব বলে মন্তব্য করেছিলেন। জয়ী হওয়ার পর থেকেই তিনি তার ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। তিনি পরপর দুই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছেন। সাংবিধানিক ক্ষমতার বাইরে গিয়ে মন্ত্রীদের শপথ পড়াতে অস্বীকার করেছেন। এবার তিনি অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ছাড়লেন। ফলে ভোটে জয়ী হওয়ার পর তিনি একে বিপ্লব বলে আখ্যা দিলেও শেষ পর্যন্ত তিনি প্রতি-বিপ্লব ঘটালেন।

কয়েক বছর ধরে চলা অচলাবস্থা, ক্রমহ্রাসমান রাষ্ট্রীয় পরিষেবা ও বাড়তে থাকা বেকারত্বের কারণে অনেক তিউনিসীয় তাদের রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি ক্ষুব্ধ। এরপর গত বছর কোভিড-১৯ মহামারী শুরু হওয়ার পর দেশটির অর্থনীতি টালমাটাল হয়ে ওঠে।

তিউনিসিয়ায় বিপ্লবের পর আশা করা হয়েছিল বিপ্লবের ফলে আরও বেশি চাকরি ও কাজের সুযোগ সৃষ্টি হবে। তবে তা হয়নি। এক দশক পরে তিউনিসিয়া একটি গভীর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়েছে এবং আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়াবহ করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সাথে লড়াই করছে। দেশটির জনসংখ্যা এক কোটি ২০ লাখ হলেও মারা গেছে ১৮ হাজার মানুষ। করোনায় মৃত্যুহারে বিশ্বে উপরের সারিতে আছে দেশটি।

কিন্তু এসব সমস্যার জন্য শুধু এন্নাহদাকে দায়ী করলে ভুল হবে। সেখানে অন্য দলও ক্ষমতা ছিল। এককভাবে এন্নাহদা দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়নি। বরং সবচেয়ে জনপ্রিয এই দলটিকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে এবং ব্যর্থ করে দিতে নানামুখী চেষ্টা চলেছে। তাছাড়া তিউনিসিয়াকে মোকাবিলা করতে হয়েছে কয়েকটি বড় ধরনের জঙ্গী হামলা। ২০১৫ সালে পর্যটন কেন্দ্রে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার পর দেশটির পর্যটনে খাতে ধস নামে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভূতপূর্ণ করোনা সংকট। তাই শুধু এন্নাহদাকে এককভাবে ব্যর্থতার দায় দেওয়া সমীচীন নয়।

তা সত্ত্বেও এবারের বিক্ষোভে এন্নাহদা পার্টির কার্যালয়গুলো ভাংচুর করা হয়। গাফসা শহরের এক বিক্ষোভকারী বলেন, প্রেসিডেন্ট সত্যিকারের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। তবে একই শহরের আরেক বাসিন্দা বলেছেন, আহাম্মদরা আরেক নতুন স্বৈরশাসকের জšে§াৎসব করছে।

আরব বসন্তের আগে নিষিদ্ধ থাকা এন্নাহদা ২০১১ সালের পর থেকে তিউনিসিয়ার সবচেয়ে সফল দলে পরিণত হয় এবং ক্ষমতাসীন জোট সরকারের তারা বড় অংশীদার ছিল। দেশটির সবচেযে জনপ্রিয় দল এটি।

এন্নাহদা এক বিবৃতিতে বলেছে, আরব বসন্তের একমাত্র সফল গল্প তিউনিসিয়া। এখানেই সেই গল্পের ইতি ঘটবে না। দলটি পার্লামেন্ট পুনর্বহালে গণতন্ত্রের সমর্থক বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা চেয়েছে।

২০১৪ সালের সংবিধান অনুযায়ী দেশটির ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ও সংসদ নির্বাচন পৃথকভাবে অনুষ্ঠিত হয়। প্রেসিডেন্ট সামরিক বাহিনী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। সরকার পরিচালনার দায়িত্ব সংসদের ওপর।

বেন আলীর পতনের পর প্রথম সংসদ নির্বাচনে এবং গত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে এন্নাহদা। এন্নাহদার প্রধান রশিদ ঘানুচি পার্লামেন্ট স্থগিতের সিদ্ধান্তকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে এর কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তাকে সংসদে প্রবেশ করতে দেয়নি নিরাপত্তা বাহিনী।

তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট বিক্ষোভের অজুহাতে দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ক্ষমতা দখল করেছেন। একই অজুহাতে ক্ষমতা দখল করেছিলেন মিসরের স্বৈরশাসক আবদেল ফাত্তাহ আল সিসি। সিসির ক্ষমতা দখলের পথ উন্মুক্ত করতে ওই বিক্ষোভ নাটক সাজানো হয়েছিল। সিসির ক্ষমতা দখলে দেশটির অনেকেই উল্লাস করেছিল। এখন তাদের ওপরও নির্যাতনের স্টিম রোলার চালাচ্ছেন সিসি।

একই ঘটনা ঘটছে তিউনিসিয়ায়। সেখানেও কথিত বিক্ষোভের জেরে ক্ষমতা গ্রাস করেছেন প্রেসিডেন্ট। এতে অনেককেই উল্লাস করতে দেখা গেছে। খুব সম্ভবত অচিরেই এই উল্লাসরত জনতার ওপর সেনাদেরকে গুলি করতে দেখা যাবে।

তিউনিসিয়ার এ ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিগুলোর বিভাজন আবারও বাড়বে। স্বভাবতই মিসর, সৌদি আরব ও আরব আমিরাত তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্টের অসাংবিধানিক পদক্ষেপকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে স্বাগত জানাবে। অন্যদিকে তুরস্ক ও কাতার এর বিরোধিতা করবে।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মুখপাত্র ফাহরেট্টিন আলতুন ইতিমধ্যেই এক বিবৃতিতে বলেছেন, আঙ্কারা সব সময় গণতন্ত্র ও জনগণের পক্ষে। অবিলম্বে দেশটিতে গণতন্ত্র পুনর্বহাল করতে হবে। অন্যদিকে সৌদি আরব প্রেসিডেন্টের পদক্ষেপকে পরোক্ষভাবে স্বাগত জানিয়েছে।

তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থানে বিপাকে পড়েছে পশ্চিমা বিশ্ব। তারা একে সমর্থন দেবে, না বিরোধিতা করবে, সে সিদ্ধান্ত তাৎক্ষণিকভাবে নিতে পারেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি দেশটিতে গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে। অন্য দেশগুলো অভ্যুত্থানের নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।

তিউনিসিয়ার অভ্যুত্থান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। তিনি বিশ্বে গণতান্ত্রিক শাসনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানানোর কথা ঘোষণা করেছেন। অভ্যুত্থানের পর শুরুতে যুক্তরাষ্ট্র নমনীয় সুরে বিবৃতি দিলেও পরে কড়া অবস্থান ব্যক্ত করে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নেড প্রাইস এক বিবৃতিতে দেশটিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্রুত পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা তিউনিসিয়ায় গণতান্ত্রিক শাসনের পক্ষেই অবস্থান করবেন।

ওয়াশিংটনে আমেরিকান ইউনির্ভাটির অধ্যাপক উইলিয়াম লরেন্স আলজাজিরাকে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট যেসব পদক্ষেপ নিয়েছেন তার সাংবিধানিক বৈধতা নেই। তিনি সর্বময় ক্ষমতা গ্রহণ করতে পারেন না। তিউনিসিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মুন্সেফ মারজুকি বলেছেন, দেশটিতে যা ঘটল তা স্পষ্টতই একটি অভ্যুত্থান। তিউনিসিয়ার সংবিধানে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেওয়া হয়েছে। প্রেসিডেন্ট বলতে পারেন না যে আমি সব ক্ষমতা নিয়ে নিলাম।