জিনজিয়াং সীমান্তে তালেবান, উদ্বিগ্ন চীন


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ২৭ জুলাই ২০২১, ১৪:২৪

আফগানিস্তানের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী অঞ্চল দখলের পর তালেবান এবার চীনের মুসলিম অধ্যুষিত জিনজিয়াং সীমান্তে পৌঁছে গেছে। এতে জিনজিয়াংয়ে স্বাধীনতাকামীরা সশস্ত্র আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ঘটনায় বিচলিত হয়ে পড়েছে চীন।

চীনের জিনজিয়াং উইঘুর স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলটিতে আফগানিস্তান সীমান্তের ওয়াখান করিডোর দিয়ে ইসলামি কট্টরপন্থীরা অনুপ্রবেশ করতে পারে বলে আশঙ্কা জোরদার হচ্ছে। আফগানিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় বাদাখশান প্রদেশ দখলের পর তালেবান চীনের জিনজিয়াং সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় এ আশঙ্কা আরও বাড়ছে।

তবে চীনা পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ইসলামি কট্টরপন্থী দলগুলোর ওয়াখান করিডোর হয়ে জিনজিয়াংয়ে প্রবেশের সম্ভাবনা কম। আফগানিস্তানের পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে তারা মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মাধ্যমে চীনকে হুমকি দিতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, আফগানিস্তান পরিস্থিতি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

আফগানিস্তানের পরিস্থিতি থেকে ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা হুমকির মধ্যে নচেড়ে বসেছে চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা বা এসসিও। এ ইস্যুতে সংস্থাটির আফগানিস্তান কন্টাক্ট গ্রুপের তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান ও উজবেকিস্তান সফর করেছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই।

আফগানিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে সাথে তালেবান তার আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি উন্নতির জন্য নীরবে নিজেদের রূপান্তর করছে। প্রতিবেশী দেশগুলির উদ্বেগকে প্রশমিত করে তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করছে তালেবান। চীনা পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চীন ও রাশিয়া এই অঞ্চলের বড় শক্তি হিসাবে আফগানিস্তান সংকট শান্তিপূর্ণভাবে সমাধানে সব পক্ষকে আরও বেশি সহযোগিতা করবে। এখকার আফগানিস্তান হয়তো চীন ও রাশিয়ার জন্য সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান হয়ে উঠবে না।

এদিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী দ্রুত গতিতে আফগানিস্তান থেকে সরে আসার সঙ্গে সঙ্গে তালেবান দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে বিজয় অর্জন অব্যাহত রেখেছে। এ নিয়ে চীনও উদ্বিগ্ন। তবে কিছু পশ্চিমা গণমাধ্যম তথাকথিত চীনা ভীতিকে আরও বাড়িয়ে তুলছে। তারা বলেছে, জিনজিয়াংয়ে অস্থিতিশীলতার কারণে তালিবানরা এখন চীন সীমান্তে পৌঁছেছে।

ফ্রান্স টোয়েন্টিফোর টিভি চ্যানেল বলেছে, চীন জিনজিয়াংয়ের কাছে তালেবানের উপস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। জিনজিয়াংয়ে চীনের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ এখন পাল্টা আঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তবে চীনের লানঝু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কাও ওয়েই গ্লোবাল টাইমসকে বলেন, তালেবানের উত্থান সত্ত্বেও ইসলামি উগ্রপন্থী দলগুলোর ওয়াখান করিডোর হয়ে চীনে প্রবেশের সম্ভাবনা খুব কমই।

চীনের সিংহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতীয় কৌশল ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক কিয়ান ফেং মনে করেন, চীনের সঙ্গে ওয়াখান সীমান্তযুক্ত করিডোরের অংশটি প্রায় ৯০ কিলোমিটার দীর্ঘ। প্রযুক্তিগতভাবে এখানে নজরদারি করা বা অনুপ্রবেশ বন্ধ করা চীনের পক্ষে কঠিন কোনো কাজ নয়। অন্যদিকে কাও বলেছে, তালেবানরা আজ থেকে বিশ বছর আগে যা ছিল এখন তার চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা।

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তালেবান মুখপাত্র সোহায়েল শাহীন বলেছেন, তারা চীনকে আফগানিস্তানের বন্ধু হিসাবে দেখছেন। তালেবান আশা করছে যে বেইজিংয়ের সাথে আফগানিস্তান পুনর্গঠনে শিগগিরই তারা একযোগে কাজ করবেন। সুহেল আরও বলেন, তালেবান উইঘুর স্বাধীনতাকামীদের আফগানিস্তানে আশ্রয় দেবে না। আল-কায়েদা বা অন্য কোনও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকেও সেখানে কাজ করতে বাধা দেবে তালেবান।

একজন তালেবান প্রতিনিধিও সম্প্রতি রাশিয়া সফরের সময় মস্কোকে আশ্বাস দিয়েছেন যে তারা অন্য দেশে আক্রমণ করার জন্য দেশটিকে প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করতে দেবে না। বিশ্লেষক কাও মনে করেন , এসব অনুমান করা যায় যে, তালেবান নীরবে আফগানিস্তানের একটি রাজনৈতিক সংগঠন হয়ে ওঠার জন্য বদলে যাচ্ছে এবং ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

সাম্প্রতিক এক মার্কিন গোয়েন্দা মূল্যায়নে বলা হয়েছে, আমেরিকান সেনারা চলে যাওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই বর্তমান আফগান সরকারের পতন হতে পারে। গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, আফগানিস্তানের পুরো নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে তালেবান। চীনা বিশ্লেষকরা এর আগে হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, আফগানিস্তানের নিরাপত্তা হুমকি প্রতিবেশী দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়লে উগ্রবাদীরা মধ্য এশিয়ার দেশ এবং পাকিস্তান থেকে চীনে প্রবেশ করতে পারে।

আফগানিস্তানের মার্কিন সেনারা বিগত বছরগুলিতে মধ্য এশিয়ার কয়েকটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর তৎপরতাকে সংকুচিত করেছিল। তাদের কেউ কেউ সিরিয়ায় চলে গেছে। তবে তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতা গ্রহণ করলে আল কায়েদার উত্থান হতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। সম্প্রতি তালেবান হামলার পর বহু আফগান সেনা সীমান্ত অতিক্রম করে তাজিকিস্তানে ঢুুকে পড়ে। এ ঘটনায় তাজিকিস্তান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় রাশিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটের সহায়তা চেয়েছে।

চীনা বিশ্লেষক কাও মনে করেন , আফগানিস্তান সংকট চীনের চেয়েও বড় মাথাব্যথার কারণ রাশিয়ার জন্য। কিছু উগ্রপন্থী গোষ্ঠী রাশিয়ার কাছের দেশগুলোতে অনুপ্রবেশ করতে পারে এবং ছড়িয়ে পড়তে পারে। ককেশাস এবং চেচনিয়াতে এ সংকট দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে সামষ্টিক নিরাপত্তা চুক্তি সংস্থা সিএসটিওর অধীনে মধ্য এশিয়ার নিরাপত্তার জন্য রাশিয়া আরও পাঁচ দেশের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছে।

সাংহাই নিরাপত্তা সংস্থা এসসিওর আফগানিস্তান যোগাযোগ গ্রুপের বৈঠক ২০০৫ সালে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পর্যায়ে উন্নীত করা হয়। এটি আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিযে এসসিও দেশগুলির বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গি এবং আফগানিস্তান পুনর্গঠন পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করে। আফগানিস্তানের ছয় প্রতিবেশী দেশ এসসিওর সদস্য। চীনের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রে নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা দেশ গুলো দায়িত্বহীনভাবে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

চীন ও রাশিয়ার নেতৃত্বে ২০০১ সালে তৈরি হওয়া সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশনে ভারত, পাকিস্তান মধ্যএশিয়ার চারটি দেশ রয়েছে। এগুলো হলো কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান এবং তাজিকিস্তান। এই সংস্থার ৪টি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হলো আফগানিস্তান, মঙ্গোলিয়া, বেলারুশ এবং ইরান। এছাড়া আছে ছয়টি সংলাপ অংশীদার বা ডায়ালগ পার্টনার।

ভারতও আফগানিস্তানে কৌশলগত অবস্থান সংহত করতে চেয়েছিল। এমন অভিযোগ আছে এর মাধ্যমে পাকিস্তানে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির কাছে আফগানিস্তানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল ভারত। এখন আফগানিস্তান যেন ভারতবিরোধী শক্তির আশ্রয়স্থানে পরিণত না হয়, ভারত সেই গ্যারান্টি চাচ্ছে।

সিংহুয়া বিশ^বিদ্যালয়ের বিশ্লেষক কিয়ান ফেং মনে করেন , বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তানে ভারতের সহায়তা ৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভারত কাবুল সরকার, আঞ্চলিক নেতৃবৃন্দ এবং দেশটির নাগরিকদের একাংশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। তবে তালেবানদের সাথে ভারতের সম্পর্ক খারাপ ছিল। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আফগানিস্তানে পাকিস্তানের প্রভাব বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এখন তাই ভারতও তালেবানের সাথে পুনরায় যোগাযোগ শুরু করেছে।

বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ আফগানিস্তান চীনের পুনর্গঠনে জড়িত হওয়াকে নিরুৎসাহিত করছে। তারা বলছে, চীন ও রাশিয়ার পরবর্তী সাম্রাজ্যবাদের কবরস্থান হতে পারে আফগানিস্তান। যুক্তরাষ্ট্রের দ্য হিলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ফলে চীন সেই শূন্যস্থান পূরণ করার পরিকল্পনা করেছে। তাই চীনই হবে আফগান কবরস্থানে প্রবেশের পরবর্তী সাম্রাজ্য।

তবে বিশ্লেষক কাও মনে করেন, চীন এবং রাশিয়া অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিকে সমর্থন করে। এছাড়া সামরিকভাবে জড়িত থাকার চেয়ে অর্থনৈতিক সহায়তার দিকে মনোনিবেশ করবে। এই কারণে চীন ও রাশিয়ার পরনতি এমন হবে না।

বিশ্লেষকরা বলেছেন, চীন ও রাশিয়া উভয়ই জোর দিয়েছে আফগানিস্তানের জনগনই দেশটির ভাগ্য নির্ধারন করুক। সব পক্ষ রাজনৈতিকভাবে সমাধানে আসুক। আমেরিকা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছে। এমনটা যেনো না হয়।

তালেবান ইতোমধ্যে আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে সহায়তার জন্য চীনকে স্বাগত জানিয়েছে। তারা ক্ষমতা গ্রহণ করলে চীন ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলির সাথে স্থিতিশীল সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে বলে পর্যবেক্ষকরা বলেছেন। চীনা বিশ্লেষকরা বলেছেন, এবার তালেবানের আদর্শিক চিন্তা রফতানি করার সম্ভাবনা কম।

চীনা বিশ্লেষকদের মতে, তালেবান ধীরে ধীরে কার্যত একটি আঞ্চলিক সরকারে রূপান্তরিত হয়েছে। উগ্রপন্থী গোষ্ঠীগুলিকে আশ্রয় না দিয়ে তার কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে আগ্রহী। একাজে চীনের সমর্থন তাদের জন্য খুবই জরুরি। পর্যবেক্ষকরা বলেছেন, আমেরিকা আফগানিস্তান পুনর্গঠনের কাজে আর হাত দেবে না। যদিও আফগানিস্তানের মানুষের চলমান ভোগান্তি যুক্তরাষ্ট্রের কারণে হয়েছিল।

তালেবানদের এ-কথাও মনে রাখতে হবে যে, আমেরিকা আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পুরোপুরি ছাড়বে না। তালেবান ভুল করলে সন্ত্রাসবিরোধী লড়াইয়ের নামে এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র আবারও সামরিক উপস্থিতি জোরদার করতে পারে।