পশ্চিম আফ্রিকায় বাড়ছে চীন রাশিয়া তুরস্কের প্রভাব


  • মোতালেব জামালী
  • ২৫ জুলাই ২০২১, ১৪:১৩

মাগরেব নামে পরিচিত উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকার লিবিয়া থেকে মৌরিতানিয়া পর্যন্ত দেশগুলোতে একসময় ইউরোপের আধিপত্য ছিল। এই অঞ্চলের দেশগুলো ছিল ফ্রান্স-ইতালিসহ একাধিক ইউরোপীয় দেশের উপনিবেশ। ঔপনিবেশিক যুগের অবসান ঘটার পরেও এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে এসব দেশের বিরাট প্রভাব থেকে যায়। কিন্তু সেই অবস্থা এখন বদলে যাচ্ছে। প্রভাব বাড়ছে চীন ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর।

আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সের একটি বন্দরে ফ্রান্স থেকে আসা আটা ও ময়দার বস্তার একটি চালান কন্টেইনার থেকে নামানোর সময় ডক শ্রমিকরা সেখানে দুটি মৃত শুকর দেখতে পান। গত ১৭ জুন এ ঘটনা ঘটে। খাদ্যের কন্টেইনারের মধ্যে শুকর রেখে দেওয়ায় স্থানীয় মুসলমানরা ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

বিষয়টি জানার পর আলজেরিয়ার কৃষিমন্ত্রী আল হামিদ হামিদানি আটা ও ময়দা সরবরাহকারী ফরাসি প্রতিষ্ঠানটিকে কালো তালিকাভুক্ত করেন। একইসঙ্গে তিনি ২৭ হাজার টন পণ্যভর্তি কার্গো জাহাজটিকে ফেরত পাঠান এং ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। জাহাজ ফেরত পাঠানো হলেও রুটি বানানোর জন্য আলজিয়ার্সের বেকারি মালিকদেরকে আটা ও ময়দার জন্য খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি।

ঘটনার ঠিক ৫ দিনের মাথায় ফ্রান্স থেকেও অনেক দূরের দেশ রাশিয়া থেকে ২৮ হাজার টন আটা ও ময়দার কন্টেইনারবাহী জাহাজ এসে আলজিয়ার্সের বন্দরে পৌঁছে। গত ৪ বছরের মধ্যে রাশিয়া থেকে পণ্যবাহী কোনো জাহাজের আলজেরিয়ায় আসার প্রথম ঘটনা এটি।

আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে এই ছোট ঘটনার যথেষ্ট তাৎপর্য রয়েছে। এভাবে পশ্চিম আফ্রিকার দেশগুলোতে ইউরোপের দেশগুলো প্রভাব হারাচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। ইউরোপ এমন সব দেশের দিক থেকে এই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, যে দেশগুলো দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে অনুপস্থিত ছিল। আবার কোনো কোনো দেশ নতুন করে এই অঞ্চলে হাজির হচ্ছে। রাশিয়া, তুরস্ক এমনকি চীনের প্রভাব এই অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে। ফলে দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে দাপট খাটানো ইউরোপীয় দেশগুলো বিশেষ করে ফ্রান্সের প্রভাব খর্ব হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা ক্ষেত্রে রাশিয়া, তুরস্ক ও চীনের সাথে প্রতিযোগিতায় ফ্রান্সসহ ইউরোপের দেশগুলো হেরে যাচ্ছে।

মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের নর্থ আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান ইনতিসার ফাকির মনে করেন, ‘সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মাগরেব বা উত্তর-পশ্চিম আফ্রিকা প্রতিযোগিতার একটি ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রতিযোগিতা কেবল খাদ্যশস্যের বাণিজ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তা অস্ত্র, সৈন্য ও রাজনৈতিক প্রভাবের ক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছেছে। নর্থ অফ্রিকা জার্নালের সম্পাদক আরেজকি দাউদ মনে করেন, পশ্চিম আফ্রিকার সাথে সাহেল অঞ্চলকেও বিবেচনায় আনতে হবে। এই অঞ্চলটি ইনফেকশন পয়েন্টে পরিণত হয়েছে। মরক্কো, আলজেরিয়া, লিবিয়ার পাশাপাশি আরও দক্ষিণের দেশ মালি, নাইজার ও শাদে যে সংঘাতময় পরস্থিতি বিরাজ করছে, তা পুরো উত্তর আফ্রিকায় ক্ষমতার ভারসাম্যকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

উনবিংশ শতাব্দী থেকেই মাগরেব অঞ্চল ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো শাসন করেছে। তিউনিশিয়া ও আলজেরিয়া শাসন করেছে ফ্রান্স। এছাড়া দেশটি স্পেনের সাথে মিলে ভাগাভাগি করে মরক্কো শাসন করেছে। বিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে ইতালি লিবিয়ায় অভিযান চালিয়ে দেশটি দখল করে নেয় এবং অটোমান খিলাফতের শাসনের অবসান ঘটায়। উত্তর আফ্রিকার অধিকাংশ দেশ একসময় অটোমান খলিফাদের শাসনাধীনে ছিল।

১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে ধারাবাহিক স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এসব দেশ ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু স্বাধীনতা লাভের পরও সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাথে এসব দেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন অব্যাহত তাকে।

২০১৯ সালে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কোর শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল ফ্রান্স, ইতালি ও স্পেন। মাগরেব অঞ্চলের নিয়মিত মোট ব্যবসা-বাণিজ্যের অর্ধেকেরও বেশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে সম্পাদিত হয়েছে। এই অঞ্চলের জনগণের যোগাযোগ বা সম্পর্কটাও ইউরোপের সাথেই বেশি দেখা যায়। ফ্রান্সে মাগরেবি ভাষার লোকজনের সংখ্যা হবে ৫০ লাখ থেকে ৮০ লাখের মধ্যে। অন্যদিকে আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া, মরক্কো ও মৌরিতানিয়ায় ফরাসি ভাষা এখনও গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু এরপরও দ্রুত পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের নর্থ আফ্রিকা প্রজেক্ট ডাইরেক্টর রিকার্ডো ফাবিয়ানি বলেন, ‘উত্তর আফ্রিকা ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে দীর্ঘদিনের যে সম্পর্ক বা বন্ধন ছিল, তা ছিন্ন হতে শুরু করেছে।

পশ্চিম আফ্রিকায় ইউরোপের দেশগুলো দুর্বল হওয়ার পেছনে রয়েছে দুটো বড় কারণ। একটি হচ্ছে অর্থনৈতিক ও অন্যটি হচ্ছে ভূ-কৌশলগত। অর্থনৈতিক ফ্রন্টে বড় কারণ হচ্ছে ইউরোজোন সংকট। ২০০৯ সালে অর্থনৈতিক মন্দা শুরু হওয়ার কারণে ইউরোপ মাগরেব অঞ্চলে আগের মতো বিনিয়োগ ও আর্থিক সহায়তা করতে পারছে না। অন্যদিকে মাগরেব অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যেও এই ধারণার সৃষ্ট হয়েছে যে, ইউরোপও আর আগের মতো তাদের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। ফলে দুই পক্ষের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন আলগা হতে শুরু করেছে।

ভূ-কৌশলগত কারণে এ অঞ্চলে ইউরোপের দেশগুলোর প্রভাব কমছে। যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আফ্রিকায় দূরত্ব বজায় খুব সামান্য ভুমিকা রাখছে। এ অঞ্চলের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প যে নীতি অনুসরণ করেছেন সেই একই নীতি জো বাইডেনও অনুসরণ করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। পশ্চিম সাহারা, তিউনিশিয়া এমনকি লিবিয়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ কোনো চিন্তা-ভাবনা বা মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া এ অঞ্চলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের তেমন কোনো সংশ্লিষ্টতাও নেই। অন্যদিকে এই শুন্যতা পূরণের সক্ষমতা ইউরোপেরও নেই।

ফলে রাশিয়া, তুরস্ক ও চীনের মতো দেশ এই সুযোগ নিয়ে মাগরেব অঞ্চলে ঢুকে পড়ছে। লিবিয়ায় তুরস্কের সৈন্য অবস্থান করার পাশাপাশি আলজেরিয়া, তিউনিশিয়া ও মরক্কোতে তুরস্কের ব্যবসা-বাণিজ্য ও পণ্যসামগ্রী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তিউনিশিয়ার অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল আননাহাদা পার্টি প্যান-আরব ইসলামি আন্দোলন মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্কিত।

মুসলিম ব্রাদারহুডের প্রতি তুরস্কের সমর্থন রয়েছে। এই সম্পর্ক বা যোগাযোগ মাগরেব অঞ্চলকে আরব বসন্ত পরবর্তী প্রতিযোগিতায় নিয়ে এসেছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্কিত গ্রুপ গুলোকে সমর্থন দিচ্ছে তুরস্ক ও কাতার। অন্যদিকে এদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়িয়েছে মিসর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব।

দুই পক্ষের মধ্যে এই বিরোধের প্রতিফলন দেখা গেছে লিবিয়ায়। সেখানে তুরস্ক সামরিক সহায়তা দিয়ে জাতিসংঘ সমর্থিত ত্রিপোলিভিত্তিক গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে সংযুক্ত আরব আমিরাত জিএনএ সরকারের বিরোধী লিবিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারের বাহিনী ও তার সমর্থিত সরকারকে সামরিক ও আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

মাগরেব অঞ্চলে তুরস্কের টিভি সিরিজগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এছাড়া শিক্ষা কার্যক্রম বিনিময় এবং তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বের স্টাইলও মাগরেব অঞ্চলের মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এরদোয়ান মাগরেব অঞ্চলে একজন আঞ্চলিক নেতা হিসেবে নিজেকে এরইমধ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

রাশিয়াও লিবিয়ায় বড় সামরিক খেলোয়াড় হিসেবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। প্রেসিডেন্ট পুতিন এজন্য কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন। দেশটি সরাসরি সৈন্য না পাঠিয়ে ওয়াগনার গ্রুপ নামে একটি ভাড়াটে মিলিশিয়া বাহিনী দিয়ে কাজটি করছেন। এছাড়া মাগরেব অঞ্চলের দেশগুলোতে রাশিয়া অস্ত্র সরবরাহকারী হিসেবেও নিজের অবস্থান তৈরি করেছে।

আফ্রিকায় আলজেরিয়া হচ্ছে রাশিয়ার বৃহত্তম অস্ত্র ক্রেতা দেশ। আলজেরিয়ায় রয়েছে প্রচুর গ্যাস ও তেলের মজুদ। রাশিয়ার দুটি কোম্পানী গাজপ্রম ও লুকোইলের মাধ্যমে আলজেরিয়ার জ¦ালানি সেক্টরে বিপুল বিনিয়োগ করেছে। রাশিয়া করোনার ভ্যাকসিন কূটনীতিতেও সফলতা দেখিয়েছে। আলজেরিয়া ও তিউনশিয়াসহ এই অঞ্চলের বেশ কয়েকটি দেশে রাশিয়ার উৎপাদিত ভ্যাকসিন ‘স্পুটনিক ফাইভ’ বিক্রি করেছে।

মাগরেব অঞ্চলে ভ্যাকসিন কূটনীতিতে সম্প্রতি জড়িত অন্য দেশটি হচ্ছে চীন। এই অঞ্চলে ব্যবসায় বানিজ্য ও বিনিয়োগে চীনের প্রভাব ক্রমশই বাড়ছ। মিডল ইস্ট ইন্সটিটিউটের নর্থ আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান ইনতিসার ফাকির বলেন, বেইজিং কখনও মানবাধিকার বা কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলে না। কিংবা কোনো দেশের আচরণ নিয়ে সমালোচনাও করে না। কিন্তু দেশটি মাগরেব অঞ্চলে আস্তে আস্তে তার বিনিয়োগের পরিমাণ বাড়াচ্ছে। বিশেষ করে অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ করছে।

আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম মসজিদ নির্মাণে একশ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে চীন। এছাড়াও মরক্কোতে আফ্রিকা মহাদেশের মধ্যে দীর্ঘতম সেতু রাবাত-সেল ব্রিজ নির্মাণে ৩২ দশমিক ৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় করেছে বেইজিং।

চীন নিয়ে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোর মধ্যে কিছুটা ভীতিও কাজ করে। এর কারণ হচ্ছে চীনের ‘ঋণ কূটনীতি’। এই অঞ্চলের কয়েকটি দেশে চীনের ঋণে নির্মিত কয়েকটি প্রকল্পে আর্থিক জটিলতা দেখা দেওয়ার পর এই ঋণ আতঙ্ক তৈরি হয়। কিন্তু তারপরও এই অঞ্চলে চীনের প্রভাব বেড়েই চলেছে।

মাগরেব অঞ্চলে চীন, রাশিয়া ও তুরস্কের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এই অঞ্চলে ইউরোপের দেশগুলোর উপস্থিতিকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। ফলে ফ্রান্সসহ ইউরোপের অন্যান্য দেশ এই অঞ্চল ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে।