ওআইসি কেন কার্যকারিতা হারাচ্ছে?


  • মোতালেব জামালী
  • ২৩ জুলাই ২০২১, ১৪:২৩

বিশ্বের চারটি মহাদেশের ৫৭টি দেশ নিয়ে গঠিত হয়েছে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কোঅপারেশন বা ওআইসি। আগে এর নাম ছিল অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স। পরে নাম পরিবর্তন করা হয়। জাতিসংঘের পর এটি বিশ্বের আন্তঃসরকার পর্যায়ের দ্বিতীয় বৃহত্তম সংগঠন। এই ৫৭টি দেশের মধ্যে ৪৯টিই হচ্ছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৫৭টি দেশের মোট জনসংখ্যা হচ্ছে ১৮০ কোটি।

ওআইসির পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে যে, সংগঠনটি মুসলিম বিশ্বের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর। জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নে ওআইসির স্থায়ী প্রতিনিধি রয়েছে। ১৯৬৯ সালের ২১ আগস্ট আল-আকসা মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেওয়ার পর জেরুজালেমের সাবেক মুফতি আমিন আল হোসেইনি বলেন, এই অগ্নিকাণ্ড ইহুদিদের দুষ্কর্মের ফল। তিনি এ বিষয়টি নিয়ে মুসলিম দেশগুলোর রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদেরকে একটি শীর্ষ সম্মেলন করার আহ্বান জানান। আগুনে মসজিদের পুরনো কাঠের ছাদের একটি অংশ এবং ৮০০ বছরের পুরনো ডেস্কটপ পুড়ে যায়। ইসরায়েল দাবি করে যে, মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত অস্ট্রেলিয়ান উগ্রপন্থী এক খ্রিষ্টান এই অগ্নিকাণ্ডের জন্য দায়ী।

১৯৬৯ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর মরক্কোর রাজধানী রাবাতে ২৪টি মুসলিম দেশের প্রতিনিধিরা সমবেত হন। তাদের বেশিরভাগই ছিলেন রাষ্ট্রপ্রধান। এই সম্মেলনে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয়। প্রস্তাবে বলা হয়, ‘ইসলামের মহান শিক্ষার আলোকে মুসলিম দেশগুলোর সরকারগুলো তাদের অর্থনৈতিক, বৈজ্ঞানিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে ঘনিষ্ঠ সহযেগিতা ও পারস্পারিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করবেন।

এর ছয় মাস পর ১৯৭০ সালে মার্চে সৌদি আরবের জেদ্দায় মুসলিম দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রথম ইসলামি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৭২ সালে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স বা ওআইসি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আল-আকসা মসজিদে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাকে ওআইসি প্রতিষ্ঠার প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে।

ওআইসির সনদ অনুযায়ী সংগঠনটি ইসলামি সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যবোধকে ধারণ ও এর প্রসারে কাজ করবে। সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সংহতি বাড়াতে কাজ করে যাবে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে। আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা সমুন্নত রাখবে।

১৯৯০ সালের ৫ আগস্ট ৪৫টি সদস্য দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ইসলামে মানবাধিকারের ওপর কায়রো ঘোষণা গ্রহণ করেন। এর লক্ষ্য হচ্ছে সদস্য দেশগুলোতে শরিয়া বা কোরআনের আইনের আলোকে মানবাধিকারকে সমুন্নত রাখা।

এরপর ২০০৮ সালে ওআইসি তার সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে সংশোধন করে। সংশোধিত সনদে সব সদস্য রাষ্ট্রে মানবাধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয়। সংশোধিত সনদে কায়রো ঘোষণায় গৃহীত ইসলামে মানবাধিকারের কথা সম্পূর্ণভাবে বাদ দেয়া হয়। এছাড়া মানবাধিকারের বিষয়ে জাতিসঙ্ঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক আইনের প্রতি সমর্থনের কথা উল্লেখ করা হয়।

ওআইসির সনদে সদস্য দেশগুলোর জাতীয় সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার সুরক্ষা ও নিরাপত্তার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এতে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য ও সংহতির বন্ধন জোরালো করার কথাও বলা হয়েছে। ইসলামি মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখা, সকল ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি, ইসলামি স্থাপনা ও নিদর্শণগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও নির্যাতিত মুসলিম সমাজের সহায়তায় সদস্য দেশগুলোর এগিয়ে যাওয়ার কথাও ওআইসির সনদে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

কিন্তু ওআইসির সনদে যেসব কথা উল্লেখ করা হয়েছে বাস্তবে তার কতটুকু প্রয়োগ হচ্ছে কিংবা মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন সংকটে ওআইসি কতটুকু ভূমিকা পালন করতে পারছে তা নিয়েই এখন প্রশ্ন উঠেছে।

অতিসম্প্রতি ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে ১১ দিনের যুদ্ধ প্রত্যক্ষ্য করেছে বিশ্ব। ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় নির্বিচার বিমান হামলা চালিয়েছে। এতে ৩৫ জন নারী ও ৫৯টি শিশুসহ দুই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে প্রায় দেড় হাজার। গাজার অবরুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের বর্বরতার বিরুদ্ধে সারা বিশ্বে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন। তারা ইসরায়েলি বর্বরতার নিন্দা ও দেশটির প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নিঃশর্ত সমর্থন বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

১১ দিন পর ইসরায়েল সরকার ও হামাসের মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু সঙ্ঘাত বন্ধে মুসলিমবিশ্বের মুখপাত্র ওআইসি কী ভূমিকা পালন করেছে, ফিলিস্তিনিদের সাহায্যে কতটুকু এগিয়ে এসেছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংগঠনটি হালকাভাবে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেনি।

একইভাবে ভারত অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের সাধারণ মানুষের ওপর ভারতীয় বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধেও ওআইসির কোন জোরালো ভূমিকা নেই। সংগঠনটির ভূমিকা কেবল প্রস্তব গ্রহণ ও বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। গত বছর নাইজারে ওআইসির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের ৪৭তম বৈঠকে কাশ্মিরের জনগণের অধিকারের প্রতি ওআইসির সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়।

প্রস্তাবে ভারত সরকার একতরফাভাবে জম্মু ও কাশ্মিরের সাংবিধানিক মর্যাদার যে পরিবর্তন করেছে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। একইসঙ্গে অধিকৃত জম্মু ও কাশ্মিরের ব্যাপারে ভারতের অবৈধ পদক্ষেপ বাতিল করে পূর্বাবস্থা বহাল করার দাবি জানানো হয়।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ফিলিস্তিন ও কাশ্মিরের ব্যাপারে ওআইসির গৃহীত প্রস্তাবের ব্যাপারে কোন নজর দিচ্ছে বলে মনে হয় না। ফিলিস্তিন ও কাশ্মির ইস্যু দুটি বর্তমানে বিশ্বের নানা সমস্যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। দুটি ভূখণ্ডেই মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন হচ্ছে। ওআইসির সনদে মুসলিম ওম্মাহর স্বার্থ সংরক্ষণে ওআইসির দৃঢ় ভূমিকা পালন করার করার যে কথা বলা হয়েছে, সংগঠনটি এই দুটি জ¦লন্ত ইস্যুতে কতটুকু পালন করতে পেরেছে সেই প্রশ্ন দিন দিন জোরালো হচ্ছে।

মুসলিম বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন ইস্যুতে ওআইসির কাকার্যকর ভূমিকা নিয়ে সংগঠটির ভিতরেই নানা প্রশ্ন রয়েছে। প্রায় বছর খানের আগে মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে প্রভাবশালী কয়েকটি মুসলিম দেশ বিশেষ করে তুরস্ক, ইরান ও ইন্দোনেশিয়া ওআইসির ভূকিা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে। এসব দেশ ওআইসি’র বিকল্প সংগঠন গড়ে তোলারও হুমকি দেয়। ওআইসিতে বিরোধের এ এ বিষয়টি নিয়ে ইলেকট্রনিক ও সোস্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়।

ওআইসির অনেক সদস্য দেশ অনুন্নত। অনেক দেশে সুশাসন নেই। কয়েকটি দেশ অস্থিতিশীলতা, সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের কবলে পড়েছে। ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য মতে, ওআইসি’র ৭-১০টি সদস্য দেশ সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি জটিল সমস্যা। সঙ্ঘাতে দেশটিতে হাজার হাজার মনুষ নিহত হয়েছে। বাড়ীঘর হারিয়ে লাখ লাখ মানুষ অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছে।

ওআইসি’র অকার্যকর ভূমিকার বেশ কিছু কারণও রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ হচ্ছে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে বিরোধ। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই দেশ দুটির মধ্যে বৈরিতা শুরু হয়। এই বৈরিতার প্রভাব ওআইসিতেও পড়েছে। এই অঞ্চলের নেতৃত্ব নিয়ে দেশ দুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জড়িয়ে পড়েছে। এছাড়া ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়েও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে নানা সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। এছাড়া সংগঠনটির অনেক সদস্য দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণ ও অন্তর্ভুক্তিকরণ প্রক্রিয়া খুবই দুর্বল। এ কারণে এসব দেশে অস্থিতিশীলতা বেড়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ২০১১ সালের ‘আরব বসন্ত’ এর বড় উদাহরণ।

সৌদি আরব ওআইসিতে নেতৃত্ব সংহত করেছে। এর বড় কারণ হচ্চে ওআইসির সদর দফতর ও এর বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের দফতর সৌদি আরবে। ইরানের সাথে সৌদি আরবের দ্বন্দ্বের এটিও একটি কারণ। এই দ্বন্দ্বের কারণে অতীতে জেদ্দায় ওাাইসির বৈঠকে যোগ দিতে ইরানি প্রতিনিধি দলকে ভিসা দেয়নি সৌদি আরব।

মুসলিম বিশ্বে বিভাজন ও স্বার্থের সঙ্ঘাত ওআইসির অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হওয়ার আরেকটি বড় কারণ। বর্তমানে অনেক মুসলিম দেশ ওআইসির সনদ ও নীতিমালা অনুসরণের পরিবর্তে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের লক্ষ্যে কাজ করে থাকে। গত বছর সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন ও মরক্কো ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দেয়। মুসলিম দেশগুলোর এ ধরনের উদ্যোগ ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ওআইসির এজেন্ডাকে দুর্বল করে দিচ্ছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ওআইসিকে কার্যকর সংগঠনে পরিণত করতে হলে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে বিরোধের অবসান ঘটাতে হবে। বিশেষ করে ইরান-সৌদি দ্বন্দ্ব না মিটলে ওআইসির কার্যকর ভূমিকা পালন কখনও সম্ভব হবে না। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের পরিবর্তে মুসলিম উম্মাহর স্বার্থের কথা চিন্তা করে সব দেশ ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ নিলেই কেবল ওআইসি তার প্রকৃত ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।

বিশ্বায়নের এই যুগে আন্তঃসরকার ধরনের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা কেউই অস্বীকার করতে পারে না। এ ধরনের একটি সংগঠন বিভিন্নভাবে সদস্য দেশগুলোর উপকার করতে পারে। ওআইসিকে এ ধরনের একটি সংগঠনে পরিণত করা গেলে এটিও মুসলিম উম্মাহর কল্যাণে বড় ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।