মধ্যপ্রাচ্য থেকে কেন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সরাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র?


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ১০ জুলাই ২০২১, ১৫:৩৫

মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ থেকে হঠাৎ করেই সেনাসদস্য ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি-মিসাইল ব্যাটারি’ তুলে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ। যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে এই বার্তা দিতে চায় যে, তারা তেহরানের সঙ্গে বৈরিতার অবসান চাচ্ছে। অন্যদিকে, এসব সেনা ও অত্যাধুনিক মিসাইল-ব্যবস্থা চীন ও রাশিয়াকে লক্ষ্য করে মোতায়েন করা হবে।

পেন্টাগনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাইডেন প্রশাসনের নির্দেশে ইরাক, কুয়েত, জর্ডান এবং সৌদি আরবে মোতায়েন করা আটটি প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি মিসাইল ব্যাটারি ইউনিট তুলে নিচ্ছে পেন্টাগন। এছাড়া সৌদি আরবকে উপহার হিসেবে ‘থাড’ নামে একটি মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে বিবৃতিতে।

প্যাট্রিয়ট অ্যান্টি মিসাইল ব্যাটারির প্রতিটি ইউনিট পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে শতাধিক সেনা সদস্য ও বেসামরিক কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন হয়। এসব সরিয়ে নেওয়ার ফলে অল্প দিনের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের এই চারটি দেশ থেকে হাজারেরও মার্কিন সেনা ও বেসামরিক কর্মীবাহিনী প্রত্যাহার করা হবে। সেগুলো চীন ও রাশিয়াকে লক্ষ্য করে মোতায়েন করা হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইরানের পরমাণু প্রকল্প বিষয়ক আলোচনায় অগ্রগতি এবং চীন ও এশিয়া-প্যাসিফিক এলাকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন হুমকি হিসেবে দেখা দেওয়ায় এই পদক্ষেপ নিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। তাছাড়া মধপ্রাচ্যের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নও এই পদক্ষেপের অন্যতম কারণ।

পেন্টাগনের মুখপাত্র কমান্ডার জেসিকা ম্যাকনাল্টি এই ইমেইলে বার্তাসংস্থা এএফপিকে এ সম্পর্কে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা ও তাদের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাবের প্রেক্ষিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তানীতির সঙ্গে এই পদক্ষেপ সঙ্গতিপূর্ণ হবে বলে বিবেচনা করছে পেন্টাগন।

তিনি বলেন, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন আসছে। সেই অনুযায়ী আমাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থাতেও পরিবর্তন আসা স্বাভাবিক। তবে ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নতুন হুমকি তৈরি হয়, সেক্ষেত্রে ফের সেখানে সেনা মোতায়েন করা হবে।

জেসিকা ম্যাকনাল্টি জানান, মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া মার্কিন সেনাদের একটি অংশকে বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের সামরিক ঘাঁটিতে মোতায়েন করা হবে। বাকিরা দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র বাহিনী কমান্ডের অধীন থাকবেন।

ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সরিয়ে নেওয়ার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আবার স্বাভাবিক সময়ে ফিরতে যাচ্ছে। তবে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে পেন্টাগনের এক কর্মকর্তা বলেন, উপসাগরীয় দেশগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটিগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না। তাই ওই অঞ্চলে এখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রবল সামরিক উপস্থিতি থাকছে।

সৌদি তেল স্থাপনায় ইরানি ড্রোন হামলা এবং ২০২০ সালে ইরাকে ইরান ও তেহরান সমর্থিত মিলিশিয়াদের একের পর এক ড্রোন হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র সৌদি আরবে এসব প্যাট্রিয়ট মিসাইল মোতায়েন করে। যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করেছে যে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার পর ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি সামরিক ঘাঁটিতে ইরানি হামলায় শতাধিক সেনা আহত ও অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কিছুটা রদবদল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সম্প্রতি আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর আগে ইরাক থেকে আড়াই হাজার মার্কিন সেনা সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।

ইয়েমেন থেকে লেবানন, ইরাক থেকে সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশে সৌদি আরবের সঙ্গে ভূরাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে আছে ইরান। এ পরিস্থিতিতে সৌদিকে রক্ষার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন এসব ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও মেরিন কর্পস ইউনিভার্সিটির ওয়ার স্টাডিসের সাবেক অধ্যাপক এডওয়ার্ড এরিকসন তুরস্কের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম টিআরটিকে বলেন, সেনা ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ইরানকে একটি ইতিবাচক রাজনৈতিক বার্তা দিতে চেয়েছে। এর মাধ্যমে ওয়াশিংটন বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে আগ্রহের জানান দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ আমি মনে করি এটা ইরানের প্রতি একটা ইতিবাচক সিগন্যাল। এর মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অধীনে ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে পরমাণু চুক্তিতে প্রত্যাবর্তনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু হলো।’

এরিকসন বলেন, সৌদি আরবে ওই ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন কোনো স্থায়ী উপস্থিতি ছিল না। তাছাড়া প্যাট্রিয়ট ও থাড মিসাইল ব্যবস্থা উপসাগরীয় অঞ্চলে খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। ড্রোন ও নিম্নমানের ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে এগুলো সফলতা দেখাতে পারছে না। ইয়েমেনর হুথিরা সৌদির লক্ষ্যবস্তুতে প্রায়ই ড্রোন হামলা চালায়। এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর। তিনি বলেন, বাইডেন প্রশাসন চায় পরমাণু চুক্তি পুনরায় বাস্তবায়নের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে।

ইসলাম অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক সামি আল আরিয়ান বলেন, ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহার করে যুক্তরাষ্ট্র তেহরানকে এই বার্তা দিতে চায় যে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ইরানকে টার্গেট করার পরিকল্পনা নেই। আশা করা হচ্ছে এতে ইরান পরমাণু চুক্তিতে ফিরতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। যুক্তরাষ্ট্র এ চুক্তিটি করতে আগ্রহী। বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর ইয়েমেনে সৌদি হামলা বন্ধেও কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। আবার ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যেও আলোচনা শুরু হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই সেনা ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রত্যাহারের ঘটনায় এই বার্তাও দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে সৌদি আরবও ইরানের সঙ্গে সরাসরি কিংবা ছায়াযুদ্ধ চায় না। যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সরিয়ে নিলে সৌদির পক্ষে রাশিয়া এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনা সম্ভব নয়। তাতে ওয়াশিংটন ক্ষুব্ধ হয়ে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে। এরিকসন বলেন, সৌদি চাইলেও রাশিয়া বা চীনের দিকে ঝুঁকতে পারবে না।

এদিকে ইসরাইলের নতুন বেনেট সরকারও চায় ইরানের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমিত করে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে। ইরানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ইরানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চাওয়ায় তেল আবিব বাধা হয়ে দাঁড়ালে তাতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইহুদি রাষ্ট্রটির সম্পর্কের টানাপোড়েন সৃষ্টি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও ইসরাইল ইরানের প্রতি নমনীয় মনোভাব দেখালে তেহরানও আগ্রাসী আচরণ পরিহার করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া সত্যিকার অর্থে ইরান ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে সৌদি আরবকে ভয় দেখাতে চায় বলেও মনে হয় না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সরিয়ে নিলেও এ অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্যে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন আসবে না বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র আশাবাদী হয়ে উঠেছে যে ইরানের নতুন কট্টরপন্থী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির পক্ষেই পরমাণু চুক্তিতে ফেরা অধিকতর সহজ। কারণ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি এবং দেশটির শীর্ষ ধর্মীয় নেতা ও স্টাব্লিস্টমেন্টের সঙ্গে রইসির গভীর সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু সংস্কারপন্থী বিদায়ী প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানির সেটা ছিল না। রইসি চাইলেই পাশ্চাত্যের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে সক্ষম হবেন ।
তবে বিশেষজ্ঞ ও পেন্টাগনের কর্মকর্তারা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে সেনা ও ক্ষেপণাস্ত্র সরানোর জন্য শুধু উপসাগরীয় ভূরাজনৈতিক সমীকরণই কাজ করছে না। এটা বরং বৃহত্তর বৈশি^ক চিত্রের অংশ। চীন ও রাশিয়াকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের মরিয়া চেষ্টার অংশ এটা।

চীন ও রাশিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশে^র অন্যান্য অংশে সামরিক উপস্থিতি জোরালো করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। সামী আরিয়ান বলছেন, দক্ষিণ চীন সাগরে মনোনিবেশ করতে চায় ওয়াশিংটন। একই কথা বলেন এরিকসনও। এক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তার সীমাবদ্ধতা জানে। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের হাতে প্যাট্রিয়ট ও থাড ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা খুব বেশি নেই। এগুলো চীন ও উত্তর কোরিয়ার বিরুদ্ধে প্যাসিফিক অঞ্চলে মোতায়েন করা দরকার।

তাই ইরানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যকে অগ্রাধিকার তালিকা থেকে বাদ দিয়ে বাইডেন প্রশাসন চাচ্ছে চীন ও রাশিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মনোযোগ দিতে। যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছে, চীনের উত্থানে বিশে^ তাদের আধিপত্য খর্ব হবে। পাশাপাশি চীনের সহযোগী হিসেবে রাশিয়াকেও হুমকি হিসেবে দেখছে ওয়াশিংটন। সামনের বছরগুলোতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা বাড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে।