রাতের অন্ধকারে কেন ঘাঁটি ছাড়লেন মার্কিন সেনারা?


  • শাহ মুহাম্মদ মোশাহিদ
  • ০৯ জুলাই ২০২১, ১৫:৩১

রাতের অন্ধকারে বাগরাম বিমানঘাঁটি ছেড়ে চলে গেছেন মার্কিন সেনারা। যাওয়ার আগে আফগান সামরিক বাহিনীকেও জানানো হয়নি। এমন অভিযোগই করেছেন জেনারেল আসাদুল্লাহ কোহিস্তানি। মার্কিন সেনাদের ফেলে যাওয়া বাগরাম ঘাঁটির দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি। ভোর রাত তিনটার দিকে কাউকে কিছু না জানিয়েই মার্কিন সেনারা বিমানঘাঁটি থেকে চলে যান। অথচ ঘাঁটির বাইরে থাকা আফগান সেনারা বিষয়টি জানতে পারেন কয়েক ঘণ্টা পর। এই কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ঘাঁটিতে চলে স্থানীয়দের লুটতরাজ।

কাবুল থেকে ৪০ মাইল দূরের গ্রাম বাগরাম। ১৯৫০-এর দশকে এই গ্রামে গড়ে ওঠে একটি বিমানঘাঁটি। আফগানিস্তানকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ঘাঁটিটি তৈরি করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। তবে ১৯৭৯ সালে রাশিয়ার রেড আর্মির আক্রমণের পর এটি চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে। এটি নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে মস্কো-সমর্থিত আফগান সরকার। পরে দখল নেয় মুজাহেদিন প্রশাসন। ১৯৯০-এর দশকে চলে যায় তালেবানদের হাতে। পরের ইতিহাস যুক্তরাষ্ট্রের।

২০০১ সালে আফগানিস্তান দখল নেওয়ার পর থেকে ২০ বছর ঘাঁটিটি ব্যবহার করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

গত ২ রা জুলাই থেকে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে আফগানিস্তান সেনাবাহিনী। তবে আফগান বাহিনীর কমান্ডার কোহিস্তানি শঙ্কা করছেন, তালেবান নিয়ে। মার্কিন বাহিনী চলে যাওয়ার খবর চাওর হওয়ার পর খুব কম সময়ের মধ্যে বেশ কিছু এলাকার দখল নিয়েছে তালেবান। শোনা যাচ্ছে বাগরাম গ্রামের আশপাশেও তাদের উপস্থিতি রয়েছে।

বাগরাম গ্রামের ৩০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই বিমানঘাঁটি। বলা যায় এটি ছোটখাট একটি শহর। এই সামরিক শহরের ভেতর আছে বড়সর দুইটি রানওয়ে। আর একশটিরও বেশি ফাইটার বিমান পার্ক করে রাখার মতো যায়গা। পার্কিং এলাকা যেসব দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত, কোনো বিস্ফোরণ ওইসব দেয়ালের ক্ষতি করতে পারবে না। ঘাঁটিটিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আছে একটি কন্ট্রোল টাওয়ার। বানানো হয়েছে অসংখ্য ভবন। ঘাঁটির ভেতর আছে পঞ্চাশ শয্যার একটি হাসপাতাল। জরুরি সেবার এলাকা। অপারেশন থিয়েটার। দাঁতের চিকিৎসার ব্যবস্থা। ক্লিনিক। আর আছে বন্দিদের জন্য একটি কারাগার। এই কারাগারে এখনো পাঁচ হাজারের মতো বন্দি আছে। এদের অধিকাংশই তালেবান। বাগরাম বিমানঘাঁটির কারাগারটিকে বলা হয় আফগানিস্তানের গুয়ানতানামো।

ঘাঁটিটি এখন আফগান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ধারণা করা হচ্ছে এর ভেতর বন্দিদের উদ্ধার করতে এখানে হামলা চালাতে পারে তালেবান। তিনি দুঃখ করে বলেন, মার্কিন বাহিনী যদি তাদের জানিয়ে ঘাঁটি থেকে সরে যেতো তাহলে এখানে হওয়া লুটপাট ঠেকানো যেতো।

মার্কিন সেনারা সাড়ে তিন মিলিয়ন আইটেম ফেলে গেছে। এর সবগুলো জুড়িয়েছিলো তারাই। এসবের মধ্যে আছে দামি দামি কাঠামো, অস্ত্র, গাড়ি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। আছে হাজার হাজার বোতল পানি। অনেক অনেক এনার্জি ড্রিঙ্কস এবং সামরিক বাহিনীর জন্য রাখা ‘রেডি খাবার।
যখন মার্কিন সেনারা ঘাঁটি থেকে সরে যায়, এর পর পরই বাগরাম গ্রাম থেকে ঘাঁটিতে হামলে পড়েন লুটেরারা। এরা সামনে যা পেয়েছেন। তা নিয়েই ছুট দিয়েছেন। লুট করেছেন অস্ত্রশস্ত্র, আসবাব। লুটেরাদের চোখ ছিলো খাবারের ওপরও। মার্কিন ঘাঁটির খাবারের স্টকে এখনো লুটের চিহ্ন রয়ে গেছে। লুটেরারা কেবল নিয়েই যাননি, বরং ঘাঁটিতে থেকে খেয়েও গেছেন।

গার্ডিয়ানের ফটো ফিচারে বাগরাম ঘাঁটির তিন দিন পরের একটি ছবি প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে একজন আফগান সেনা টহল দিচ্ছেন। তিনি লুটেরাদের ফেলে যাওয়া বোতল ও খালি ক্যান সংগ্রহ করছেন।

মার্কিন সেনাদের সরে যাওয়ার খবর যখন আফগান বাহিনী জানতে পারে, তখন তারা হতভম্ব হয়ে যায়। উৎকণ্ঠায় পড়ে বাগরাম ঘাঁটির দখল নিয়ে। জেনারেল আসাদুল্লাহ কোহিস্তানী ঘাঁটির দখল নেন। আফগান সেনাদের উপস্থিতি টের পেয়ে লুটেরারা পালিয়ে যায়।

এরপর ঘাঁটিতে শুরু হয় জরিপের কাজ। গুনে গুনে দেখা হয় মার্কিন সেনারা কি কি ফেলে গেছেন। গার্ডিয়ানের ফটোফিচারে দেখা গেছে, বিশাল রানওয়ে। ঘাঁটিতে মোট রানওয়ে আছে দুইটি। এর মধ্যে একটি তৈরি করা হয়েছে ২০০৬ সালে। এর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে ৯ কোটি ৬০ লাখ মার্কিন ডলার।

আফগান বাহিনীর সেনারা ঘাঁটিটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন। জিনিসপত্রের হিসাব টুকছেন। আর মার্কিন বাহিনীর সমালোচনা করছেন। তারা বলছেন, রাতের অন্ধকারে সটকে যাওয়াটা কাপুরুষের কাজ।

বিশাল একটি এলাকায় অনেকগুলো গাড়ি পার্কিং করা। এই ছবিটা বাগরাম বিমানঘাঁটির ভেতরের। আর গাড়িগুলো মার্কিন সেনাদের। সবগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি গাড়ি আছে চাবি ছাড়াই স্বয়ংক্রিয়ভাবে স্টার্ট নিতে পারে। মাইন রেজিস্ট্যান্ট অ্যামবুশ প্রোটেকশন গাড়িগুলোও ফেলে গেছে তারা।

স্থানীয় লুটেরারা এইসব গাড়ির ক্ষতি করতে পারেনি, এর আগেই আফগান বাহিনী এদের উচ্ছেদ করে। তবে ব্যারাকের অনেক কিছু নিয়ে গেছে। স্টোরে থাকা তাঁবুগুলোও এখন লুটেরাদের দখলে বলে জানিয়েছেন আফগান সামরিক কর্মকর্তারা।

ত্রিশ বর্গকিলোমিটার এলাকার এই ঘাঁটি নিজেদের দখলে রাখতে পারবে কি না, এ নিয়ে শঙ্কা থাকলেও ছবিতে আফগান সেনাদের অলস চলাফেরা দেখা গেছে। কয়েকজনকে দেখা গেছে জিমের ভেতর বসে খোশগল্প করতে। আবার সুরক্ষা বাহিনীর কয়েকজনকে কড়া নজর রাখতেও দেখা গেছে।

মার্কিন বাহিনীর ফেলে যাওয়া একটি গিটার বাজাতে দেখা গেছে আফগান সেনা নেয়ামতউল্লাহকে। গিটার বাজাতে বাজাতে তিনি কৌতুক করছিলেন। নেয়ামতউল্লাহ বলেন, ‘এক রাতের মধ্যে ওরা ২০ বছরের সুনাম নস্ট করে দিয়েছে। আফগান সেনাদেরকে কিছু না জানিয়েই সরে গেছে ওরা।’
বাগরামের নতুন কমান্ডার কোহিস্তানি জানান, মার্কিনীরা ছোট ছোট অস্ত্র এবং গোলাবারুদও ফেলে গেছে। এসবের কিছু লুটেরারা নিয়ে গেছে। আর লুটেরাদের থেকে সংগ্রহ করছেন ভাঙারি ব্যবসায়ীরা।

অন্য একটি ছবিতে দেখা গেছে ভাঙারির একটি দোকানে দুই পা ছড়িয়ে আরাম করে শুয়ে আছেন দোকানি। তার দোকানভর্তি সেকেন্ডহেন্ড মার্কিন পণ্যে। পণ্যগুলো এসেছে বাগরাম ঘাঁটির ভেতর থেকে। ওগুলোর পসরা সাজিয়ে আরাম করছেন তিনি। ভাঙারির এই দোকানটি ঘাঁটির দেয়ালের বাইরে।

ঘাঁটির ভেতরে-বাইরে থেকে থেকে দেখা যাচ্ছে আফগান সেনাদের সতর্ক পাহারা। কোথাও সাঁজোয়া যান নিয়ে টহল চলছে। কোথাও চলছে অস্ত্র হাতে নিয়ে খোশগল্প। কেউ ফেলে যাওয়া অস্ত্র পরীক্ষা করছেন। কাউকে দেখা যাচ্ছে করিডোর গুছাতে।

বাগরাম বিমানঘাঁটির ভেতর আফগান বাহিনীর চালচিত্র এসবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে ঘাঁটির বাইরে সেনাদের মধ্যে ভর করেছে তালেবান আতঙ্ক। তালেবানের সঙ্গে যুদ্ধরত অনেক সেনা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে পালিয়ে গেছেন তাজিকিস্তানে। তারপরও জেনারেল কোহিস্তানির শক্ত মনোবল। তিনি বলেছেন, বাগরাম ঘাঁটি তালেবানের দখলে যাবে না।

রাতের অন্ধকারে কেন মার্কিন সৈন্যরা ঘাটটি ছেড়ে চলে গেলো তা নিয়ে শুধু আফগানিস্তান নয় বিশ্বজুড়ে চলছে আলোচনা। তালেবানের হামলার ভয়ে কী এই গোপনে চলে যাওয়া নাকি পরাজয়ে লজ্জা ঢাকতেও রাতকেই বেছে নিলো মার্কিন সেনারা। সেটিও একটি বড় প্রশ্ন। বিশ্লেষকরা বলছেন আফগানিস্তানের ইতিহাস এমন যেখানে কোনো বিদেশি শক্তির জেতার কোনো সম্ভাবনা নয়। পরাজয় নিয়তির লিখন।