চীন-ভারত আবার মুখোমুখি, নেপথ্যে যুক্তরাষ্ট্র


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০১ জুলাই ২০২১, ১৩:০২

ভারত অন্তত ৫০ হাজার সেনা চীনা সীমান্তে মোতায়েন করেছে। আগে থেকেই এই সীমান্তে দুই লাখের বেশি সেনা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল। গত বছরের জুনে হিমালয়ে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সংঘর্ষের পর এখন আবার দুই দেশ সীমান্তবর্তী এলাকায় ৪০ শতাংশ সেনা বাড়িয়েছে। গত বছরের সংঘাতে ভারতের প্রায় ২০ জন সেনা নিহত হন। চীনের কতজন সেনা নিহত হয়েছেন, তা নিয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন অসমর্থিত সূত্রে ৫ জন সেনা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

শুধু সেনা সদস্যই নয়, ভারত তার উত্তর সীমান্তে বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমানও পাঠিয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীও ভারত মহাসাগরে চীনের সমুদ্রসীমার নিকটবর্তী এলাকায় যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। চীনের নৌপথের বাণিজ্য ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড নজরদারি করার জন্যই ভারত এ যুদ্ধজাহাজগুলো পাঠিয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগেই ভারত ও চীন উভয়েই ভারত মহাসাগরে যৌথ মহড়া চালিয়েছে।

আবার উত্তেজনা প্রশমনে ভারতের আগ্রহে দুই দেশের কর্মকর্তারা কয়েক দফা আলোচনাও করেন। তখন ভারতের কাছে এমন খবর ছিল, সীমান্তে আধিপত্য বিস্তারে চীন বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে ভারতীয় সীমান্তের কাছে চীন বেশ কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। নেপাল ও তিব্বতের আশপাশেও ট্রেন লাইন নির্মাণ করেছে। এখন হঠাৎ করে ভারত সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ বাড়াচ্ছে।

ভারতের জন্য সুবিধার দিক হলো, ওয়াশিংটনকে বরাবরই নিজেদের পাশে পেয়েছে । আঞ্চলিক পর্যায়ে চীন যেভাবে প্রভাব ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে, ওয়াশিংটন সবসময় তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। চীনকে ঘিরে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের একই স্বার্থ।

ভারত এতদিন ভারত মহাসাগরকে নিজেদের একক কর্তৃত্বাধীন নৌপথ হিসেবে গণ্য করেছে। কিন্তু চীন সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বাস্তবতায় অনেকটাই পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। বাণিজ্য ও সামরিক স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্য চীন ভারত মহাসাগরে প্রবেশ করে এক ধরনের কৌশলী চাপ সৃষ্টি করেছে।

ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্ম্পকের ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক যেমন রয়েছে তেমনি দুই দেশের মধ্যে কিছু বিষয়ে আস্থার সংকটও রয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানের সঙ্গে ওয়াশিংটনের উষ্ণ সম্পর্ক নিয়ে ভারতের বরাবরই আপত্তি ছিল। আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তের পর বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের দিকে অনেকটা ঝুঁকে পড়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিপরীতে, ভারতের বিষয়েও যুক্তরাষ্ট্রের কিছু উদ্বেগ আছে। ভারত যেভাবে রাশিয়া থেকে ক্রমাগতভাবে সামরিক হার্ডওয়্যার কিনছে, তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ভীষণ অসন্তুষ্ট।

ভারত রাশিয়া থেকে এস ফোর হান্ড্রেড এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনার জন্য ৫ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলারের বিশাল একটি চুক্তি করেছে। এ বিষয় নিয়ে নয়াদিল্লী ও ওয়াশিংটনের সম্পর্কে বড়ো আকারের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এরপরও চীন বিরোধী একটি শক্তিশালী মিত্র জোট গড়ার স্বার্থে দুই দেশ পুরনো সব সংশয়কে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে একসাথে কাজ করছে।

চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থান ঠেকাতে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। সম্প্রতি মার্কিণ রণতরী এবং পারমানবিক শক্তিচালিত সুপারক্যারিয়ার ইউএসএস রোনাল্ড রেগান। এক বহর এফ-এইটিন যুদ্ধবিমান নিয়ে ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ ও এ্যাংলো ফ্রেঞ্চ জাগুয়ার জেট মিলে যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। এ সময় ভারতের পক্ষ থেকে রাশিয়া নির্মিত সুখোই থার্টি এমকেআই যুদ্ধবিমানও এ মহড়ায় যোগ দেয়।

মহড়াটি ভারতের দক্ষিন পশ্চিম সাগরের তীর ঘেষে ত্রিভূবণথাপুরামে অনুষ্ঠিত হয়। এ মহড়াটি সাধারণ মানের কোনো মহড়া ছিল না। বরং এ মহড়ায় এডভান্সড পর্যায়ের এয়ার ডিফেন্স মহড়া, ক্রস ডেক হেলিকপ্টার অপারেশন এবং অ্যান্টি সাবমেরিন মহড়াও অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রনালয়ের একটি বিবৃতিতে এসব তথ্য জানানো হয়। সাবমেরিনসহ মহড়ার বিষয়টিকে চীনের জন্য একটি হুমকি হিসেবেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন। কেননা ভারতীয় মহাসাগরে চীনা সাবমেরিন ছাড়া আর কোনো দেশের সাবমেরিনের যাতায়াত লক্ষ্য করা যায় না।

অতি সম্প্রতি, চীনের জরিপ জাহাজ জিয়াং হাং হং জিরোথ্রি পূর্ব ভারতীয় মহাসাগরে একটি জরিপ সম্পন্ন করে। এ ধরনের জরিপ থেকে পাওয়া ডাটা সাধারণত বৈজ্ঞানিক গবেষণার উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হয়। একইসঙ্গে সাবমেরিন যুদ্ধচিত্রের প্রকৃত অবস্থা জানার জন্যেও এ ধরনের জরিপের প্রয়োজন হয়।

বিগত কয়েক বছরে আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের আশপাশে চীনা সাবমেরিনের যাতায়াত ভারতীয় বাহিনীর নজরে এসেছে। আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জ ভারতের আওতাধীন এলাকা, যা মালাক্কা প্রনালীর প্রবেশমুখের একেবারেই কাছে অবস্থিত।

মালাক্কা প্রনালীতে একটি নৌ চেকপয়েন্টও রয়েছে যার মাধ্যমে চীনের আমদানিকৃত জ্বালানী শক্তির ৮০ শতাংশ আনা নেয়া হয়। ভারত মহাসাগর নিয়ে চীনের এই বাড়তি আগ্রহের কারণ হলো চীন এখন থেকেই মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আফ্রিকায় তাদের বাণিজ্য বহরগুলোর যাতায়াতের পথকে নিরাপদ ও নিবিঘ্ন করতে চায়। এক্ষেত্রে ভারতীয় মহাসাগরে নিজেদের বাড়তি উপস্থিতিকে বৈধতা দেয়ার জন্য চীন অ্যান্টি পাইরেসির কথা বলছে। ভারত মহাসাগরে নিজেদের উপস্থিতি স্থায়ীভাবে জানান দেয়ার জন্য চীন দেশের বাইরে জিবুতিতেও ২০১৭ সালে প্রথম একটি সামরিক ঘাটিও স্থাপন করে।

চীন ২০১৫ সালের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা নিয়ে যে শ্বেতপত্র প্রকাশ করে তাতে বলা হয়েছে, ভূমি দিয়েই সমুদ্র পথকে জয় করা যাবে- এ ধরনের প্রথাগত চিন্তা এখন বাদ দেয়া উচিত। বরং সময়ের দাবি অনুযায়ী আমাদেরকে সমুদ্র পথের নিরাপত্তা এবং সাগরগুলোকে আরো বেশি নিরাপদ করার জন্য সচেষ্ট হতে হবে। আমাদের নৌ অধিকারগুলোকে সমুন্নত রাখতে হবে। এ বিষয় নিশ্চিত করার জন্য চীন আগামীতে আন্তর্জাতিক নৌ সহযোগিতা প্রকল্পে অংশ নেবে। নৌখাতে অন্যতম পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই করবে।

নৌপথের বাইরে এসে যদি হিমালয় সীমান্ত নিয়ে ভারত ও চীন উভয়ের মাঝেই দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলে আসছে। ১৯৬২ সালে হিমালায়া সীমান্তকে কেন্দ্র করে দু দেশের মধ্যে পুরো পরিসরে যুদ্ধ হয়। গত বছরের জুনের সংঘাতের পর হিমালয় এখন আরো বেশি অস্থিতিশীল। যেকোনো সময় দু দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘাতও শুরু হয়ে যেতে পারে।

তবে বিশ্লেষকরা সম্ভাব্য সংঘাতের হটস্পট হিসেবে হিমালায়ের চেয়ে ভারত মহাসাগরকেই এগিয়ে রাখছেন। তাদের মতে যুক্তরাষ্ট্র যদি ভারত মহাসাগরে আসে কিংবা নাও আসে তাহলেও ভারত মহাসাগরই এশিয়ার নতুন কোল্ড ওয়ারের ফ্রন্ট লাইন হয়ে যেতে পারে।

চীনের আঞ্চলিক আধিপত্য ঠেকাতে গঠন করা হয়েছে কোয়াদ জোট। এ জোটের সদস্য হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত এবং অস্ট্রেলিয়া। অপরদিকে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র ১৯৯২ সাল থেকেই নিয়মিতভাবে যৌথমহড়ার আয়োজন করে যাচ্ছে। ২০১৬ সালে এসে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘মেজর ডিফেন্স পার্টনার’ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এরপরই ভারত দক্ষিন চীনা সাগরে মার্কিন-জাপান টাস্কফোর্সের সাথে যোগ দিতে একটি নৌবহরও পাঠায়। পরবর্তীতে মালাবার সামরিক মহড়ায় ভারত বেশ কয়েক দফা অংশ নেয়।

এরপর থেকে ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্র সদস্যদের মধ্যে হৃদ্যতা ভিন্ন উচ্চতায় পৌঁছে যায়। ২০২০ সালের মার্চ মাসে কোয়াড জোটের নেতারা নিজেদের মধ্যে একটি টেলিকনফারেন্সে যুক্ত হয়ে কোভিড-নাইনটিন মহামারি মোকাবেলায় করনীয় নিয়ে আলোচনা করেন। কোয়াডের চার সদস্যরাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা ছাড়াও এ কনফারেন্সে নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভিয়েতনামের নেতারাও অংশ নেন।

এ কনফারেন্সের পর আঞ্চলিক উত্তেজনা যথেষ্ট বেড়ে যায়। স্বাস্থ্য ঝুঁকি নিয়ে আলাপ করার জন্য কনফারেন্সটির আয়োজন করা হলেও এর উদ্দেশ্য মোটেও এত সরল ছিল না।

২০০১ সালে ভারত আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জে প্রথম তিন বাহিনীর একটি কমান্ড প্রতিষ্ঠা করে। এদের দায়িত্ব ছিল ভারতের নৌ স্বার্থকে সংরক্ষন করা, ভারতের মূল ভূখণ্ডকে হেফাজত করা এবং চীনের নৌযানগুলোর তৎপরতা তদারকি করা।

আন্দামানের পোর্ট ব্লেয়ারে সশস্ত্র বাহিনীর মূল দফতর চালু করা হয়। এখান থেকে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনী ও কোস্টগার্ডের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রন করা হয়। ভারত এখন অস্ট্রোলিয়ার সাথে কথা বলে কোকো দ্বীপেও প্রবেশের সুযোগ খুঁজছে। এ দ্বীপটি অস্ট্রোলিয়ার নিয়ন্ত্রনে আছে। ভারত এই দ্বীপে একটি নৌঘাঁটি স্থাপন করে পারমানবিক শক্তি চালিত সাবমেরিন মোতায়েন করতে চায়।

ভারতের এত সব তৎপরতার মুখে চীন নিরবে বসে থাকবে এমনটা আশা করা যায় না। গত এপ্রিলে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের মিত্রতার সমালোচনা করা হয়। চীনের মতে ভারত ক্রমশই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থপর ও লোভী দৃষ্টিভঙ্গির ভিকটিমে পরিণত হচ্ছে।

এরপর আন্দামান এবং নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের কাছ দিয়ে সাবমেরিন চালিয়ে ভারত এবং এর মিত্রজোটকে চীন চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। একই সাথে ভারত মহাসাগরেও অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মিশন নিয়ে চীন কাজ করে যাচ্ছে।