যুদ্ধবিরতি চুক্তি ও নতুন সরকার গঠনের পর লিবিয়ায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও দেশটিতে এখনও অবস্থান করছে বিদেশি মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধারা। এখনই তাদের যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন পক্ষের হয়ে এই যোদ্ধাদের মাধ্যমেই উত্তর আফ্রিকার দেশটিতে প্রভাব বিস্তার করে আছে বিদেশি শক্তিগুলো।
পাঁচ মাসের আলোচনার পর চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জেনেভায় জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে লিবিয়ায় আরেকটি ট্রানজিশনাল গভর্নমেন্ট বা অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। গত অক্টোবরে একটি আনুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতির ধারাবাহিকতায় এই অগ্রগতি হয়। নতুন এই সরকারের কাজ লিবিয়ার ইনস্টিটিউশনগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করা, নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং এক দশকের যুদ্ধে বিধ্বস্ত দেশটিতে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করা। দীর্ঘ এই যুদ্ধের কারণে অনেক বিদেশি শক্তি লিবিয়াতেই শুধু নয়, পুরো উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পেয়েছে।
জেনেভার ওই বৈঠকে দেশটির ৭৪ জন ডেলিকেটের ভোটাভূটি প্রথমবারের মতো লিবিয়া পরিস্থিতির একটি কূটনৈতিক সমাধানের দ্বার উন্মুক্ত করে দেয়। তবে এর বাইরে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়ে গেছে, যা দেশটির ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তায় ফেলে দিতে পারে।
জাতিসঙ্ঘের সমর্থনে গত বছরের অক্টোবরে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারির মধ্যে লিবিয়া থেকে সব বিদেশি যোদ্ধার চলে যাওয়ার কথা ছিলো। ওই চুক্তিতে মূলত বিদেশি মার্সেনারি বা ভাড়াটে যোদ্ধাদের লিবিয়া ত্যাগের বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। বিভিন্ন হিসাব মতে, দেশটিতে তখনো পর্যন্ত অবস্থান করা বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধার সংখ্যা ১০ থেকে ২০ হাজার। যারা রাশিয়া, সিরিয়া, সুদান, চাঁদ সহ আরো কয়েকটি দেশের নাগরিক। তবে তা সত্ত্বেও চুক্তিটি লিবিয়ার দীর্ঘ সমস্যার সমাধানে খুব বেশি স্পষ্ট পথনির্দেশ করতে পারেনি।
লিবিয়ার সঙ্ঘাতে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো বিদেশি শক্তি। ফ্রান্স, রাশিয়া, তুরস্ক, ইতালি ও সংযুক্ত আরব আমিরাত তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এই দেশগুলোই সেখানে ভাড়েট যোদ্ধা পাঠানোর নেপথ্য শক্তি হিসেবে কাজ করছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। চুক্তির পর এই যোদ্ধাদের প্রত্যাহারে প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয়াও হয়েছিল; কিন্তু ডেটলাইনের পর কয়েক মাস কেটে গেলেও এ ব্যাপারে কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেই। যার ফলে এই বিষয়টিই লিবিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আলোচনার পথে একটি বাধা হয়ে আছে।
গত জানুয়ারির শেষ দিকেও মার্সেনারি গ্রুপ ওয়াগনারের তিনশো যোদ্ধাকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছে রাশিয়া। সিরত নগরীরর কাছে আল জুফরা বিমান ঘাঁটির নিরাপত্তা বাড়ানোর কাজে যোগ দিয়েছে ওই যোদ্ধারা। ঘাঁটির চারদিকে কয়েক কিলোমিটার পরিখা খনন করা হয়েছে রাশিয়ার তত্ত্বাবধানে, আরো অনেক নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রায় দুর্গে রূপ দিয়েছে ঘাঁটিটিকে। ঘাঁটিটি খলিফা হাফতারের বাহিনী লিবিয়ান ন্যাশনাল ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে আছে। অন্য পক্ষের হামলা থেকে তাদের নিরাপদ রাখতেই মস্কো এতকিছু করেছে।
সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, লিবিয়া থেকে সহসা বড় ধরনের মার্সেনারি প্রত্যাহারের উদ্যোগ কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা নেই। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ও লিবিয়া বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি রিচার্ড নরল্যান্ড অনেকবার বলেছেন- ভাড়াটে সৈন্যদের উপস্থিতির অজুহাতে নির্বাচন পেছানোর দরকার নেই । এই কথার তাৎপর্য আছে। অন্তত ২০২১ সালের মাঝে বিদেশি যোদ্ধাদের কেউ লিবিয়া ছাড়বে না সেই সম্ভাবনা প্রবল।
লিবিয়া নিয়ে বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগের পেছনে আরো কিছু কারণ আছে। লিবিয়ার ভবিষ্যত নিয়ে কূটনীতিকদের যে প্রত্যাশা, বাস্তবে পরিস্থিতি তার চেয়ে অনেক আলাদা। যুদ্ধবিরতি চুক্তি ও ত্রিপোলিতে নতুন একটি মন্ত্রীসভা গঠন সত্ত্বেও দেশটির পূর্ব ও পশ্চিম- উভয় অংশেই এখনো গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে ভাড়াটে যোদ্ধারা।
চাঁদের প্রেসিডেন্ট ইদ্রিস দেবীর নিহত হওয়া ও এর সমসাময়িক কিছু ঘটনা প্রমাণ করে চাঁদের ভাড়াটে যোদ্ধাদের সাথে সংযোগ আছে লিবিয়ার বিদ্রোহী নেতা খলিফা হাফতারের। হাফতার আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সমর্থন পাওয়ার পরও এই সংযোগ কমেনি, বরং আরো জোড়ালো হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।
ভাড়াটে যোদ্ধা ও তাদের পাশাপাশি ড্রোনের মতো উচ্চ প্রযুক্তির যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যবহৃত হওয়া এই যুদ্ধকে আরো দীর্ঘায়িত করতে পারে। ত্রিপোলি ভিত্তিক গভর্নমেন্ট অব ন্যাশনাল অ্যাকর্ড বা জিএনএ সরকারও তুরস্কের সেনাদের সহায়তা নিচ্ছে। তুর্কি ড্রোনও তাদের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে। জিএনএ সরকার সিরিয়ার ভাড়াটে যোদ্ধাদের ব্যবহার করছে বলেও জানা যাচ্ছে।
হাফতার বাহিনী তো রাশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের জোগাড় করা প্রাইভেট সোলজারদের নিয়ে কাজ করছে। গত দুই তিন বছর ধরে তারা এই যোদ্ধাদের ওপর নির্ভর করেই টিকে আছে। খলিফা হাফতারের ওপর রাশিয়া, আরব আমিরাত ও মিসরের সমর্থনের বড় একটি উপাদান হয়ে আছে রাশিয়ার মার্সেনারি সাপ্লায়ার গ্রুপ ওয়াগনার। সংস্থাটি মস্কোর সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর সাথে সংযুক্ত বলে জানা যাচ্ছে। ২০১৯ সালে রাজধানী ত্রিপোলি অভিমুখে হাফতার বাহিনীর সামরিক অভিযানে এই যোদ্ধারা মূল ভুমিকা পালন করেছে। এবং বর্তমানে সিরত শহর ও জুফরা বিমান ঘাঁটির নিরাপত্তাও দিচ্ছে এই বাহিনী।
২০১৮ সালের অক্টোবরে মস্কোয় ওয়াগনার গ্রুপের প্রধান ইয়েভজেনি প্রিগোঝিনের সাথে বৈঠক করেছেন জেনারেল হাফতার। একই মাসে লিবিয়ায় মোতায়েন করা হয় ওয়াগনারের যোদ্ধাদের। শোনা যায়, সুদানের মার্সেনারি গ্রুপগুলোর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। তাদের অস্ত্র এবং বেতনও দেয় আরব দেশটি।
সম্প্রতি মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্রে ওয়াগনার গ্রুপের যোদ্ধাদের হাতে বেসামরিক নাগরিকদের নিহত হওয়ার ঘটনার পর আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা বিশ্বব্যাপী ভাড়াটে যোদ্ধা ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান প্রবণতার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রুশ ভাড়াটে যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে একই ধরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে লিবিয়াতেও।
জেনারেল হাফতারের হয়ে ওয়াগনারের যোদ্ধারা এক সময় নিয়ন্ত্রণ করতো এমন এলাকায় গণকবর ও টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া গেছে। সিরিয়াতেও তাদের বিরুদ্ধে একই ধরণের অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু এত কিছুর পরেও লিবিয়া থেকে ভাড়াটে যোদ্ধাদের অপসারণের বিষয়ে পশ্চিমাদের সহযোগিতা পাওয়া যাবে বলে যারা আশা করে আছেন তাদের হতাশ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে ৩ হাজার রুশ মার্সেনারিকে লিবিয়া থেকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে খুব বেশি পদক্ষেপ নেবে বলে মনে হয় না।
লিবিয়ায় বহুধাপের ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগীতা চলছে। রাশিয়াপন্থীরা সিরত নগরী দখলে রেখেছে, ওই এলাকায় যুদ্ধবিরতি চুক্তিও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এরপরও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন দেশটিতে রাশিয়ার চেয়ে তুরস্কের প্রভাব নিয়ে বেশি চিন্তিত। তুরস্ক দেশটিতে সরকারিভাবে জাতিসঙ্ঘের স্বীকৃত সরকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, যেটি সব ধরণের আন্তর্জাতিক বিধিসম্মত। আর রাশিয়া সেখানে ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের মাধ্যমে অঘোষিতভাবে প্রভাব বিস্তার করছে। পশ্চিমারা মনে হচ্ছে দুটি বিষয়কে এক পাল্লায় মাপছে।
লিবিয়া পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট যে, হাফতার বাহিনীর হয়ে সেখানে রুশ ও আফ্রিকান ভাড়াটে যোদ্ধারা আরো অনেকদিন থাকছে। নিয়মিত সেনাবাহিনী রাখার চেয়ে এই যোদ্ধাদের পুষতে খরচ কম হয় সেটাই শুধু নয়, বরং জেনারেল হাফতারের টিকে থাকার জন্য এরা জরুরী। ফ্রান্সসহ অনেক দেশ লিবিয়ায় প্রভাব বজায় রাখতে পারছে এদের মাধ্যমেই।
এর আগে হাফতার বাহিনীর ত্রিপোলি অভিযানের সময় প্যারিস নিরব ছিলো। প্রতিবেশী দেশ চাঁদের সাথে জেনারেল হাফতারের সম্পর্ক এবং চাঁদের বিদ্রোহীদের রাশিয়ার অস্ত্র দেয়া সম্পর্কেও ফ্রান্সের সরকার কখনোই কিছু বলেনি।
তাই বোঝা যাচ্ছে লিবিয়ার গৃহযুদ্ধে জড়িত বিদেশি পক্ষগুলোর কেউই সেখান থেকে সরে আসতে চাইবে না। আবার যেহেতু পশ্চিমাদের চাপও নেই, তাই দেশটি থেকে ভাড়াটে যোদ্ধাদের সহসা ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না। কারণ এই যোদ্ধারাই এখন সব পক্ষের কাছে প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার।
কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন কূটনৈতিক পদক্ষেপের চেষ্টা করা হলেও লিবিয়ার গৃহযুদ্ধ যে সহসা বন্ধ হচ্ছে না সেটি এখন স্পষ্ট। উল্টো বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে সৈন্যদের তৎপরতা বৃদ্ধির চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাফতার বাহিনী আবারো দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করছে । তেমনটা হলে লিবিয়ায় ক্ষমতা দখল ও বিদেশিদের প্রভাব বিস্তারের লড়াই আরো তীব্র হবে শীঘ্রই। এবং এই লড়াইয়ে বড় ভুমিকা রাখবে বিদেশি ভাড়াটে যোদ্ধারা।