মিয়ানমারে জমে উঠেছে দুই পরাশক্তির খেলা


  • মোতালেব জামালী
  • ১৯ জুন ২০২১, ০৮:৪২

মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বেপরোয়া ভাব দিনদিন বেড়েই চলেছে। জান্তা সরকারের নির্বিচার হত্যা, নির্যাতন-নিপীড়ন ও গ্রেফতারের কারণে দেশটির হাজার হাজার মানুষ প্রতিবেশী দেশ থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারের সীমান্তে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এর ফলে দেশটির রোহিঙ্গা মুসলমানদের দেশত্যাগের মতোই নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে মানবিক সংকট। লাখ লাখ মানুষ দেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে চাচ্ছে। অপরদিকে, মিয়ানমারে পরাশক্তিগুলোর প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা চলছে। চীন প্রকাশ্যে সামরিক জান্তা সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন জান্তা-বিরোধীদের নানাভাবে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে।

মিয়ানমারের জেনারেল মিন অং হ্লাইং সামরিক সরকারের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে চীন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। একইসাথে সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভরত জনগণের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। প্রভাবশালী অপর দুই দেশ ভারত ও জাপান নীরব রয়েছে।

এই দুই দেশের নীরবতার কারণ হিসাবে বলা হচ্ছে, তারা মিয়ানমারকে চীনের দিকে আরও বেশি ঠেলে দিতে চায় না। সীমান্তবর্তী দেশ থাইল্যান্ড প্রয়োজনীয় গ্যাস আমদানির জন্য মিয়ানমারের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল। এ কারণে দেশটি মিয়ানমারের জান্তা সরকারের নিন্দা বা সমালোচনা কোনোটাই করার সাহস পাচ্ছে না। দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা বা আসিয়ানের অন্য সদস্য দেশগুলো আবারো প্রমাণ করেছে যে, আঞ্চলিক কোনো সমস্যা সমাধানে এই সংস্থা সম্পূর্ণরূপে অক্ষম।

গত ১ ফেব্রুয়ারি জেনারেল মিন অং হ্লাইং ও তার সহযোগীরা গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর বাইরের দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া ছিল এমন বিভক্ত। মিয়ানমারকে কেন্দ্র করে যে বিরাট খেলা জমে উঠেছে তার ফলাফল কী হবে, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট, এখানেও চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পরস্পরের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় তা আঞ্চলিক সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেবে। পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব-সংঘাতের বাইরেও জাপান, ভারতসহ এ অঞ্চলের দেশগুলো চায় না, মিয়ানমারে চীনের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাক।

অর্থনৈতিক ও আর্থিকভাবে মিয়ানমার বর্তমানে ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। যে সব পশ্চিমা বিনিয়োগকারী মিয়ানমারে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের আশায় বিনিয়োগে আগহী হয়ে এসেছিল, তারা এখন নিরাশ হয়ে চলে যাচ্ছে। মিয়ানমারে চলমান সংকটে পুরোপুরিভাবে নিজের লাভ দেখছে চীন। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই মিয়ানমারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উন্না মং মং লিউইনকে সম্প্রতি আশ^স্ত করেছেন, মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের পরিস্থিতির পরিবর্তন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

গত এপ্রিলে ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় আসিয়ানের সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধি ও জান্তা সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর মধ্যে বৈঠকে ৫ দফার ভিত্তিতে যে সমঝোতা হয়েছিল তা এখন কার্যত মৃত। ৫ দফার ওই সমঝোতায় জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে শিশুসহ কয়েকশ শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারিকে সৈন্যদের গুলি করে হত্যার যেমন করা সমালোচনা হয়। তেমনি কিছু বিক্ষোভকারীর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সৈন্যদের ওপর হামলার চেষ্টারও সমালোচনা করা হয়েছে।

আসিয়ানের অবস্থান কোনোভাবেই মিয়ানমারের সংকট নিরসনের জন্য যথেষ্ট নয়। তারপরও চীনা কর্মকর্তারা জান্তা সরকারকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আসিয়ানের পক্ষ থেকে কূটনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের। ব্রুনাইয়ের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ইরিওয়ান ইউসুফ ও আসিয়ানের সেক্রেটারি জেনারেল লিম জক হোই কে আসিয়ানের পক্ষ থেকে মিয়ানমারে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু তারা জান্তা সরকারের প্রতিনিধিদের সাথে গল্প-গুজব করা ছাড়া কার্যকর কোনো কিছুই করতে পারেননি।

এই বৈঠকের পর আসিয়ানের ওয়েবসাইটে সংগঠনর পক্ষ থেকে যে বিবৃতি প্রকাশ করা হয়, তাতে জান্তা সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর মিয়ানমার সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণের কথা উল্লেখ করা হয়েছিল। কার্যত এটা ছিল আসিয়ানের পক্ষ থেকে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থান ও জান্তা সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করার মতো বিষয়। পরে অবশ্য এই বিবৃতি আসিয়ানের ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে ফেলা হয়।

আসিয়ান শুধু মিয়ানমারের জনগণের দুর্দশা লাঘবে ব্যর্থ হয়নি সংগঠনটি জান্তা সরকারের প্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর ফাঁদে পড়েছে। আসিয়ান মূলত এই অঞ্চলের অগণতান্ত্রিক দেশগুলোর একটি জোট। এটি দুটি নীতিতে চলে। একটি হচ্ছে কোনো দেশে হস্তক্ষেপ না করা এবং ঐকমত্য। এই দুই নীতির কারণে আসিয়ান আঞ্চলিক সংকট নিরসনে সংস্থাটি অকার্যকর ও ক্ষমতাহীন সংগঠনে পরিণত হয়েছে।

আসিয়ানে কেবলমাত্র ইন্দোনেশিয়াই মিয়ানমারের সংকট নিরসনে কিছুটা আগ্রহ দেখিয়েছে। বিষয়টিকে তারা বৃহত্তর পরিসরেও নিয়ে যাচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি গত ২ জুন ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রধান জোসেপ বোরেলের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকের পর তিনি বলেন, মিয়ানমারে সাধারণ মানুষকে হত্যা বন্ধ ও ৪ হাজারের বেশি রাজবন্দিকে মুক্তির দাবি জানাতে তার দেশ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, চীনের পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভর করে আসিয়ানের ভূমিকা। চীন চাইছে না বলেই আসিয়ান মিয়ানমারের ব্য্যাপারে কোনো ভূমিকা পালন করছে না। তবে মিয়ানমারে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও গৃহযুদ্ধ জোরালো হয়ে উঠায় চীন কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন। কারণ মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে জাতিগত বিদ্রোহি বাহিনী ছাড়াও সাধারণ মানুষ এখন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে।

স্থানীয়ভাবে গড়ে উঠা সশস্ত্র গ্রুপগুলো এখন জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। এই গৃহযুদ্ধ মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ছে। জান্তা সরকারের প্রতি সমর্থনের কারণে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে চীনা প্রতিষ্ঠানে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। ফলে জান্তা সরকারের সাথে কাজ করা চীনের জন্যও অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

চীনের ভূকৌশলগত স্বার্থের কারণে মিয়ানমারে যারাই যখন ক্ষমতায় থাকুক তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে চীন। জেনারেল মিন অং হ্ল্ইাং এর জান্ত সরকার দেশটিতে খুবই অজনপ্রিয় হলেও তাদেরকেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে চীন। মিয়ানমারে অভ্যুত্থান পরবর্তী রাজনৈতিক বিভাজনে যুক্তরাষ্ট্র চীনের বিপরতি মেরুতে অবস্থান নিয়েছে।

চীন আশংকা করছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চলমান বিরোধের কারণে দেশটি যে কোনো সময় দক্ষিণ চীন সাগর ও মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনের পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারই হচ্ছে একমাত্র প্রতিবেশি দেশ যাদের মাধ্যমে চীন সরাসরি ভারত মহাসাগরে গিয়ে পৌছতে পারবে। এই সুবিধা দক্ষিণ চীন সাগরের বিরোধপূর্ণ এলাকা ও মালাক্কা প্রণালীর চেকপয়েন্ট এড়িয়ে চীনকে জ¦ালানী তেল ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করতে সহায়তা করছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন মিয়ানমারের ওপর শুধু অবরোধ আরোপ করে বসে নেই। বিরোধীদের নানাভাবে সংগঠিত করছে। চলতি জুন মাসের শুরুতেই ইউএস এজেন্সি ফর গ্লোবাল মিডিয়া বা ইউএসএজিএম ঘোষণা করেছে , তাদের দুটি মিডিয়া নেটওয়ার্ক ভয়েস অব আমেরিকা ও রেডিও ফ্রি এশিয়া শিগগিরই মিয়ানমারের জন্য দুটি ভিডিও চ্যানেল চালু করবে। চ্যানেল দুটি ২৪ ঘন্টা সম্প্রচার করবে।

জান্তা সরকার দেশে অনেকগুলো মিডিয়া ও মোবাইল ফোন সেবা বন্ধ করে দেয়ার কারণে ইউএসএজিএম এ দুটি ভিডিও চ্যানেল চালু করবে বলে জানায়। মিয়ানমারের ভিতরে এবং দেশের বাইরে অবস্থানরত দেশটির সুশীল সমাজের সংগঠনকেও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন দিয়ে যাবে।

তবে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, নাগরিক সমাজের বিরোধিতা কিংবা সশস্ত্র লড়াই মিয়ানমারে সামরিক জান্তার পতন ঘটাতে পারবে না। কেবলমাত্র সামরিক বাহিনীর মধ্যে ফাটল বা বিভাজনই জান্তার পতন ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে সে ধরনের কোনো লক্ষণ এখনও পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের কৌশলগত স্বার্থ সংরক্ষলে কী ধরনের ভূমিকা গ্রহণ করবে, তার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।