রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র!


  • মেহেদী হাসান
  • ১৬ জুন ২০২১, ১৪:৫১

পশ্চিমা অনেক গণমাধ্যমে খবর বের হচ্ছে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এসব খবরে বলা হয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে রাশিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অবনতির প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এখন রাশিয়ার সাথে সঙ্ঘর্ষে যেতে চাইছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে ইউরোপ জুড়ে ন্যাটোর মহড়া, রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখল, ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার ব্যাপক সেনা সমাবেশ, দুই দেশের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের মজুদ বৃদ্ধির প্রতিযোগিতার ঘটনাকে সামনে আনা হচ্ছে। তবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতির খবরকে অনেকে ইহুদি নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রপাগান্ডা এবং উসকানি হিসেবে মনে করেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, রাশিয়ান ফেডারেশনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের সম্ভাবনা এখন অনেকটা অকল্পনীয়। এমন পরিস্থিতির পরিণতি হবে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ এবং আক্রমণকারীর জন্য চরম আত্মঘাতি। রাশিয়া আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তার দিকে ছুটে আসা যে কোনো মিসাইলকে গণ্য করবে পারমাণবিক বোমা বহনকারী মিসাইল হিসেবে। এর জবাবও দেবে পারমাণবিক বোমা হামলার মাধ্যমে। বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর যে কোনো দেশের আক্রমণ বিশ্বযুদ্ধের রূপ নেবে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র বাল্টিক অঞ্চল, কৃষ্ণসাগর, আর্কটিক সাগর, পূর্বে রাশিয়ান ফেডারেশন সীমান্ত অঞ্চলে অভিযানের মাধ্যমে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযানে নামতে পারে। তবে এসব খবরের প্রতিক্রিয়ায় বিশ্লেষকের বলছেন, কৃষ্ণসাগর, ইউক্রেন বা অন্য কোনো ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জড়ানোর সম্ভাবনা কম। কারণ, আরেকটি বিশ্বযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয় যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ। যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ইউরোপের দেশগুলোর সীমান্তে রাশিয়ার আগ্রাসন এবং দখল নীরবে দেখা ছাড়া উপায় নেই।

আবার অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যেভাবে সমরাস্ত্র উদ্ভাবন ও সংগ্রহের প্রতিযোগিতায় নেমেছে তা বড় ধরনের যুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিপুল অস্ত্র মজুদের শেষ পরিণতি হলো যুদ্ধ।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গত মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে ন্যাটোর ইতিহাসের অন্যতম বড় সামরিক মহড়া। ন্যাটো বলছে জোটের কোনো সদস্য দেশ যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তাৎক্ষনিকভাবে সে দেশ রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণ এ মহড়ার লক্ষ্য। ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দখলের পর পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো রাশিয়ার অভিযানের শঙ্কায় রয়েছে। রাশিয়ার আগ্রাসন মোকাবেলায় এস্তোনিয়া, লাটভিয়া এবং লিথুনিয়া সরকার নিজেদের মধ্যে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তুলতে সম্মত হয়েছে । এ নিয়ে তিন দেশের পক্ষ থেকে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করা হয়েছে।

রাশিয়ার সীমান্তজুড়ে ন্যাটোর মহড়া চলাকালে সার্বিয়া এবং রাশিয়া বেলগ্রেডের কাছে ৫ দিনব্যাপী যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করে। প্রতিবেশি বিভিন্ন বলকান রাষ্ট্রে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে চলমান বড় ধরনের মহড়ার জবাবে রাশিয়া ও সার্বিয়া এ যৌথ মহড়া শুরু করে। ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে রাশিয়া এ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে চলছে ।

মস্কোর দক্ষিন অংশের আকাশ এবং স্থলসীমান্ত দিয়ে যেনো শত্রু প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য রাশিয়া ক্রিমিয়াকে শক্ত দুর্গ হিসেবে গড়ে তুলছে। ক্রিমিয়ার কারণে কৃষ্ণ সাগর অঞ্চল দিয়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযান চালানো এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়িয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের দি ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ম্যগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা ছিল কালিনিনগ্রাদে আক্রমণ করার। বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার একটি প্রদেশ। রাশিয়ার মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এ প্রদেশের অবস্থান পোল্যান্ড এবং লিথুনিয়ার মাঝখানে।

ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্র এয়ার ফোর্সের কমান্ডার জেনারেল জেফরি এল হারিগিয়ান বলেছেন, বহুমুখী অপারেশনের জন্য কালিনিনগ্রাদ শহর এবং গ্যারিসন প্রধান লক্ষ্য স্থল হতে পারে। ব্রেকিং ডিফেন্স এর ডেপুটি এডিটর সিডনি জে ফ্রিডবার্গ মনে করেন , আকাশ, স্থল, সাগর এবং সাইবার সব দিক দিয়ে কালিনিনগ্রাদে। একসাথে হামলা হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র বা তার মিত্ররা যদি রাশিয়ার এ প্রদেশে হামলা চালায় সেক্ষেত্রে রাশিয়াও পাল্টা মিসাইল হামলা চালাবে। এই হামলা হতে পারে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রে এবং তার ইউরোপীয় মিত্র দেশগুলোতে। বিশ্লেষকদের মতে রাশিয়া অপ্রতিরোধ্য হাইপারসনিক মিসাইল আক্রমণের মাধ্যমে যারা যুদ্ধের ড্রাম বাজাবে তাদের যুদ্ধের স্বাদ রাশিয়া মিটিয়ে দিতে সক্ষম।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল রাশিয়ার কাতিউশা রকেট। বর্তমানে রাশিয়ার কাছে আছে শব্দের চেয়ে ২৭ গুন গতির এভানগার্ড হাইপারসনিক মিসাইল। পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম এ মিসাইল প্রতিরোধ ব্যবস্থা কোনো দেশের কাছে নেই।

নিউ ইস্টার্ণ আউটকুল ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাশিয়ায় অভিযানের প্রস্তুতির বিষয়টি এখন আর ইউরোপীয় ইউনিয়নের কার্পেটের নিচে নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ফরেন অ্যাফেয়ার্স কাউন্সিলের মিটিংয়ে অংশ নেয় ইইউ এর প্রতিরক্ষা মন্ত্রীরা। কানাডা, নরওয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধে এ বৈঠকটি হয়। এতে সিদ্ধান্ত হয় এসব দেশ পারমান্যান্ট স্ট্রাকচার কোঅপারেশনে যোগ দেবে। যা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিরাপত্তা এবং প্রতিরক্ষা প্রকল্প মিলিটারি মোবিলিটির অংশ।

এই পরিকল্পনার আওতায় পূর্ব ইউরোপে রোড, ব্রিজ এবং রেল নেটওয়ার্ক উন্নত করা হবে যাতে ভবিষ্যতে বৃহৎ আকারের ভারী সমরাস্ত্র বহন করা যায় । মিলিটারি মোবিলিটির এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে জার্মানি।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে অনেক বিশ্লেষকের মতে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ন্যাটো মিত্র বর্তমানে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে টিকে থাকার অবস্থায় নেয়। রাশিয়ান ফেডারেশনে ন্যাটোর যে কোনো হামলা হবে আত্মঘাতি। কারণ গ্রাউন্ড ফোর্স, সমরাস্ত্র এবং প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে এসব দেশ রাশিয়ার পেছনে রয়েছে।

কালিনিনগ্রাদে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যটোর যে কোনো আগ্রসনের সাথে সাথে গোটা পূর্ব ইউরোপ রাশিয়ার আক্রমণে মুহূর্তে তছনছ হয়ে যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সম্প্রতি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যেসব ভার্চুয়াল ওয়ার গেম পরিচালনা করেছে তার ফলাফল এসেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খারাপ পরিণতি ডেকে আনবে।

রাশিয়া জানিয়ে দিয়েছে, তারা কাউকে কখনও তাদের সীমান্ত অতিক্রম করতে দেবে না। যারা তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করবে তাদের কেন্দ্রস্থল বা রাজধানী ধ্বংস করে দেবে রাশিয়া। রাশিয়ার দিকে ছুটে আসা যে কোনো মিসাইলকে তারা সর্বোচ্চ পারমাণবিক বোমা বহনকারী মিসাইল হিসেবে বিবেচনা করবে। এর জবাবও তারা দেবে পারমাণবিক হামলার মাধ্যমে। এ অবস্থায় অনেক বিশ্লেষকের মতে রাশিয়ান ফেডারেশনের বিরুদ্ধে যে কোনো আক্রমণের সাথে সাথে তা বৃহৎ যুদ্ধের রূপ নেবে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘদিন ধরে মনে করছেন রাশিয়া ইউরোপে সীমিত আকারে পারমাণবিক হামলা চালিয়ে যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। যুদ্ধ জয়ের লক্ষ্যে প্রথমে পারমাণবিক হামলা করতে পারে। রাশিয়া যাতে এমন হামলা চালাতে না পারে সেজন্য যুক্তরাষ্ট্রও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। ২০২০ সালে ট্রাম্পের নির্দেশে তারা তৈরি করেছে সীমিত আকারের নতুন একটি পারমাণবিক বোমা এবং তা মোতায়েন করেছে সাবমেরিনে।

যুক্তরাষ্ট্র তাদের পারমাণবিক অস্ত্র সংস্কারের ব্যাপকভিত্তিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ব্রিটেনও পারমাণবিক অস্ত্র ভান্ডার সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছে। পশ্চিমাদের অভিযোগ রাশিয়া এবং চীন ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে চলছে পারমাণবিক বোমার মজুদ। ফলে বৃহৎ শক্তির মধ্যে গত কয়েক বছর ধরে চলছে পারমাণবিক বোমার মজুদ বাড়ানো এবং উন্নত করার প্রতিযোগিতা।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র যত সহজে যুদ্ধ করতে পারে, রাশিয়া বা চীনের বিরুদ্ধে তা পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যের এসব দেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা নেই।

রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে যে কোনো যুদ্ধে পাল্টা আঘাত আসবে। যুক্তরাষ্ট্র তা ভালোভাবে উপলদ্ধি করতে পারে। ফলে রাশিয়ান ফেডারেশনে যুক্তরাষ্ট্র বা ন্যাটোর হামলা চালানোর সম্ভাবনা নেই। কোনো এডমিরাল বা জেনারেল যদি বৃদ্ধ প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এ পরামর্শ দিয়ে থাকেন, তবে তা ভুল পরামর্শ এবং অসুস্থ চিন্তা।