মিয়ানমার নিয়ে জটিল পরিস্থিতিতে ভারত


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ১৫ জুন ২০২১, ১৭:২২

মিয়ানমারের সামরিক শাসন-বিরোধীদের ভারতে আশ্রয় নেওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এরইমধ্যে ১৬ হাজার উদ্বাস্তু ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এ নিয়ে ভারত সরকার বেশ জটিলতায় পড়েছে। আপাতত ভারত চাইছে মিয়ানমার থেকে আসা এ মানুষগুলো যেনো মিজোরাম, মনিপুর এবং নাগাল্যান্ডে কোনো ধরনের ক্যাম্প বা প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতে না পারে।

মিয়ানমারের সামরিক শাসনে হামলা ও নির্যাতন থেকে বাঁচার জন্য প্রতিদিনই হাজার হাজার লোক সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে প্রবেশ করছে। এ নিয়ে ভারত সরকার বেশ উদ্বিগ্ন। তারা চাইছে না এ অঞ্চলে গণতন্ত্রপন্থীরা ঘাঁটি গড়ে তুলুক। মিয়ানমার থেকে আসা এসব সরকারবিরোধীরা সক্রিয় ও শক্তিশালী হয়ে গেলে তাতে এ রাজ্যগুলোর স্বাধীনতাকামীরাও উৎসাহিত হতে পারে। যারা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে। মিজোরাম, মনিপুর এবং নাগাল্যান্ডে এ মুহূর্তে মিয়ানমার থেকে আসা ১৬ হাজার মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে। আগামীতে এ সংখ্যা আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে আসা মানুষেরা মিজোরামে নিরাপদ ও মুক্তভাবে চলাফেরা করতে চেয়েছিল। তবে রাজ্য সরকার এখনও এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তারা নজর রাখছে, যাতে মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থীরা উদ্বাস্তুদের সাথে মিলে শক্তি সঞ্চয় করতে না পারে। মিয়ানমার আর ভারতের এ অঞ্চলের সীমানাটি তিয়াও নদী দিয়ে বিভক্ত। গোটা সীমান্ত এলাকাজুড়ে গভীর বনাঞ্চল।

এ দুর্ভেদ্য এলাকা পার হয়েই প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মিয়ানমার থেকে ভারতে প্রবেশ করছে। ভারত সরকারের একজন উপদেষ্টা রয়টার্সকে বলেছেন, ‘আমরা গোটা পরিস্থিতির ওপর তীক্ষè নজর রাখছি। প্রথমদিকে মিয়ানমার থেকে কিছু সশস্ত্র বিদ্রোহীও সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে এসেছিল, কিন্তু তাদেরকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। আমরা এমন কোনো অস্ত্রধারী গোষ্ঠীকে মিজোরামে প্রশিক্ষণ নিতে দেব না। মিজোরামে যদি এরা কোনো সমস্যা তৈরির চেষ্টা করে, তাহলে সেখানে থাকা হাজার হাজার উদ্বাস্তু সমস্যায় পড়ে যাবে।

এর আগে মে মাসে অন্তত ৫০ জন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে মিজোরামে এক প্রশিক্ষণ শিবিরে অংশ নেয়। স্থানীয়রা রয়টার্সকে জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে কিছু সশস্ত্র মানুষ এ ক্যাম্পে ছিল, যারা প্যারামিলিটারি পৌঁছাবার আগেই সেখান থেকে মিয়ানমারে ফিরে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে সামরিক জান্তা ক্ষমতায় আসার পর প্রায় ৯ শতাধিক লোক এ পর্যন্ত মারা গেছে। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে পর থেকেই দেশজুড়ে গণতন্ত্রকামীরা বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছেন। ভারত সীমান্তের নিকটবর্তী চিন স্টেটে সেনা বাহিনীর সাথে স্থানীয় মিলিশিয়াদের সংঘর্ষ হওয়ায় সীমান্ত পার হয়ে মিয়ানমার থেকে নাগরিকদের ভারতে পালিয়ে আসার প্রবণতা বেড়ে যায়।

সু চির দল এনএলডির একজন নেতা রয়টারকে জানান, চীন স্টেটেটর প্রতিরোধ যোদ্ধারা ভারত ও আরাকান আর্মি থেকে অস্ত্র ক্রয় করেছে। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চলের নৃতাত্বিক মিলিশিয়াদের বাহিনীটি বর্তমানে গোটা অঞ্চলের অস্ত্র কেনাবেচাতেও মুখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে তিনি জানান। মিজোরামের পুলিশ কর্মকর্তারাও বলছেন, গণতন্ত্রকামী বা বিদ্রোহী সেনা- সবাই এখন মিয়ানমারের সামরিক শাসনের পতন চায়। তাই তারা একাট্টা হয়ে কাজ করছে। প্রাথমিকভাবে তারা ভারত থেকে অস্ত্র কিনে নিজেদের উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা করছে।

ভারতের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে প্রায় ১৬০০ কিলোমিটার। এই গোটা সীমান্ত এলাকা জুড়ে অসংখ্য বিদ্রোহী গোষ্ঠী আছে যারা নয়াদিল্লির শাসন থেকে মুক্তি চায়। নাগাল্যান্ড, মনিপুর বা মিজোরামের স্বাধীনতা আন্দোলনও অনেক বছর ধরেই চলে আসছে। ভারতের মাটিতে সক্রিয় এই স্বাধীনতাকামীরা সীমান্তের এপারে এবং ওপারের পরিস্থিতি থেকে ফায়দা হাসিল করার চেষ্টা করে।

ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীরা দাবি করেন যে, এ স্বাধীনতাকামী সংগঠনগুলোর মাধ্যমেই গোটা দক্ষিন পূর্ব এশিয়ায় অস্ত্র ও মাদকের বড়ো চোরাচালানগুলো সংঘটিত হয়। এ কারণেই মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামীদের নিয়ে ভারতের ভয় বেশি। তারা ভাবছে, যদি মিয়ানমার থেকে অবলীলায় বিদ্রোহী ও গণতন্ত্রকামীরা নাগাল্যান্ড ও মনিপুরে আসতে পারে তাহলে ভারতীয় এ দুই প্রদেশের স্বাধীনতাকামীরা নতুন করে পালে হাওয়া পাবে। বর্তমানে সীমান্ত এলাকা জুড়ে প্রায় ২৫টি স্বাধীনতাকামী সংগঠন কাজ করছে যারা নাগা ও মনিপুরকে ভারতের বিদ্যমান মানচিত্র থেকে আলাদা করতে চায়।

ভারত-মিয়ানমার সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে রয়টার্স বেশ কয়েকবার মিয়ানমারের সামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পায়নি। অন্যদিকে, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় পরিস্থিতি নিয়ে জানিয়েছে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। এই গতানুগতিক মন্তব্যের বাইরে আর কিছু বলতে চাননি।

লন্ডনের সোয়স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অভিনাস পালিওয়াল মনে করেন, মিয়ানমারের সীমান্তজুড়ে উদ্বাস্তুদের জোরপূর্বক উচ্ছেদ এবং সংঘাতে ভারতের পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতি অনিশ্চিত ও অনিরাপদ করে তুলেছে। সহিংসতার কারণে ভারত সরকারের সাথে মিয়ানমার সামরিক সরকারের সম্পর্ক আগামী দিনগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। শুধু তাই নয়, মিয়ানমারের বন্দর ও হাইওয়েগুলোতে ভারত ৬৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের যে বিশাল পরিকল্পনা করেছে তাও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গোটা অঞ্চলের কানেক্টিভিটি এজেন্ডা, চীন ও ভারতের ক্ষমতার ভারসাম্য, মাদক চোরাচালান এবং সরকারবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে মোকাবিলা আগামী দিনে জটিল হয়ে উঠতে পারে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের অভিবাসন সংকট যদি আগামীতে আরো খারাপ বলে মনে করা হচ্ছে। নিকট ভবিষ্যতে এই অভিবাসন ইস্যু সামরিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

মিজোরাম রাজ্যে ইতোমধ্যেই মিয়ানমার থেকে ১৫ হাজার নাগরিক এসে পৌঁছেছে। তারা সেখানে আশ্রয় চাইছে। মিজোরাম প্রশাসন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে সেখানে ৮টি উদ্বাস্তু শিবির চালু করার অনুমতি এবং সহযোগিতা চেয়েছে। অন্যদিকে, প্রতিবেশি মনিপুরে মিয়ানমার থেকে আসা ১ হাজার নাগরিক বনাঞ্চলে নিজেদের মতো করে ঘর তুলে বসবাস করতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে মনিপুর ও মিজোরামে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের নাগরিকেরা প্রচণ্ড খাদ্য সংকটে পড়েছে। অনেক জায়গায় চালের কোনো সরবরাহ না থাকায় উদ্বাস্তুরা দুইবেলা পেট ভরে খেতেও পারছেন না।

মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় নেয়ার পর রোহিঙ্গা জনগোষ্টী বাংলাদেশ সরকার ও বেসামরিক মাধ্যমে যতটা মানবিক সহযোগিতা পেয়েছিলেন এবং এখনো পাচ্ছেন। ভারতের মাটিতে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমারের নাগরিকেরা সে অর্থে কোনো সাড়াই পাচ্ছেন না। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আগামী দিনগুলোতে ভারতে আশ্রয় নেয়া মিয়ানমার নাগরিকদের সংখ্যা আরো বাড়বে। শুধু রাজনৈতিক অস্থিরতাই নয়, মিয়ানমারের এ অঞ্চলগুলোতে অর্থনৈতিক অবস্থাও বেশ নাজুক। তাই জীবন বাঁচানোর তাগিদ থেকেই ভারতে আশ্রয় নেয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো বিকল্প পথ খোলা নেই।

এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ দূত টম এন্ড্রিউস হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন, মিয়ানমারের সামরিক জান্তার অধীনে দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে যেভাবে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়েছে। এর পরিণতিতে এ অঞ্চলে ক্ষুধা, মহামারিসহ নানা রোগব্যধিরও ব্যাপক বিস্তার ঘটছে। অবিলম্বে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে এসব অঞ্চলে অগণিত মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে।

সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নেয়ার পর থেকেই দেশটির নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বেসামরিক নাগরিক নিহতের সংখ্যা বেড়ে যায়। থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী কায়াহ রাজ্যেও ব্যাপক সঙ্ঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন সেনাবাহিনী এ রাজ্যে নির্বিচারে আর্টিলারি শেল নিক্ষেপ করেছে। যার ফলে স্থানীয় গ্রামবাসীসহ প্রায় ১ লাখ মানুষ এরই মধ্যে নিজ নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

টম এন্ড্রিউস বলেছেন, যদি এখুনি মিয়ানমার সেনাবাহিনী কায়াহ প্রদেশে তাদের অমানবিক হামলা বন্ধ না করে তাহলে কায়াহ সহ আশপাশের এলাকায় এত বেশি সংখ্যক লোককে অনাহারে, রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যেতে দেখবো যা নিকট অতীতে আর কোথাও দেখা যায়নি। এসব এলাকার অধিকাংশ জুড়েই বিদ্যুতের কোনো সরবরাহ নেই। মানুষের কাছে খাবার নেই। বসবাস করার মতো বাড়িঘর নেই।

গ্রামবাসীর যে ঘরগুলো ছিল, তা সেনাবাহিনীর বোমা হামলায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বেঁচে থাকার জন্য এই মানুষগুলোর খাবারের পাশাপাশি জ্বালানি তেলের সরবরাহও প্রয়োজন। এএফপি কায়াহ প্রদেশের ভেতরের দিকের বেশ কিছু গ্রামের ছবি প্রচার করেছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে. সাধারণ গ্রামবাসীরাই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অতীষ্ট হয়ে নিজেদের মতো করে স্থানীয় অস্ত্র তৈরি করছে। তা দিয়েই সেনাবাহিনীকে মোকাবিলা করার চেষ্টা করছে। বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন, মিয়ানমারের চলমান সহিংসতা সহজে থামবে না। উভয়পক্ষই হয়তো কৌশল পাল্টে ভিন্নভাবে আগামী দিনগুলোতেও পরস্পরকে মোকাবেলা করার পথ খুঁজবে।