তুরস্ক ইরান পাকিস্তানের মধ্যে মেলবন্ধনের অপার সম্ভাবনা

-

  • মোতালেব জামালী
  • ১৫ মে ২০২১, ০৮:১৪

ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে সামনে রেখে তুরস্ক, ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি আঞ্চলিক জোট গঠন নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। গুরুত্বপূর্ণ এই তিনটি দেশ নিরাপত্তা, বাণিজ্য, স্থল পরিবহন, যৌথ বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারস্পারিক সহযোগিতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

চীন ও ইরানের মধ্যে সম্প্রতি ২৫ বছর মেয়াদি যে চুক্তি হয়েছে তা দুই দেশের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা আরো গভীর করবে। কাগজে-কলমে এই চুক্তি দ্বিপক্ষীয় হলেও এতে আরো দেশের যুক্ত হওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এছাড়া এই চুক্তির অন্য একটি দিক রয়েছে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অর্থনৈতিকভাবে ইরানকে বিছিন্ন করে ফেলার যে চেষ্টা করছিল এই চুক্তির মাধ্যমে তা রুখে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে চীন পাকিস্তানের সাথে চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর বা সিইপিসি নামে যে অর্থনৈতিক কানেক্টিভিটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে তা সম্প্রসারনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই ইকোনমিক করিডোরে ইরান ও তুরস্ককে যুক্ত করার সুযোগ সৃস্টি হয়েছে। আঞ্চলিক ভূরাজনৈতিক আকাঙ্খাও এই অর্থনৈতিক কনেক্টিভিটিকে সামনে এগিয়ে নিচ্ছে।

পাকিস্তানে নিযুক্ত ইরানের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ আলী হোসেইনি সম্প্রতি বলেছেন, এই অঞ্চলের উন্নত ভবিষ্যতের জন্য ইরান,পাকিস্তান, তুরস্ক, রাশিয়া ও চীন একটি নতুন জোট গড়ে তুলতে পারে। ইরান, তুরস্ক ও এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশকে নিয়ে জোট গঠনে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তও রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপ্রবেশ রোধ করতে ১৯৩৪ সালে সাদাবাদ চুক্তি নামে একটি চুক্তি করতে তুরস্ক, ইরান, ইরাক ও আফগানিস্তানের মধ্যে সমঝোতা হয়েছিল।

অন্যদিকে এই অঞ্চলে নিজেদের পারস্পারিক স্বার্থ রক্ষায় ১৯৫৫ সালে পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, তুরস্ক ও ব্রিটেন বাগদাদ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল। যদিও পরে তা সেন্ট্রাল ট্রিটি অর্গানাইজেশন বা সেন্টোতে পরিনত হয়। ১৯৫৮ সালে ইরাকে বিপ্লবের কারণে দেশটি পরের বছর চুক্তি থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নিলে আঞ্চলিক এই কাঠামোটি মুখ থুবড়ে পড়ে।

১৯৫৮ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত নথি থেকে দেখা যায় যে, ইরান অনারব দেশগুলোকে নিয়ে জোট গঠনে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে পাকিস্তান তার বৈরি দেশ ভারতের মোকাবেলায় নিজের স্বার্থের দিকে লক্ষ্য রেখে ইরানী উদ্যোগের প্রতি আগ্রহী হয় উঠেছিল। পাকিস্তান সব সময়ই সেন্টোভূক্ত দেশগুলোকে ভারতের সাথে সর্ম্পক জোরালো না করার জন্য উৎসাহিত করতো।

১৯৬৩ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান সেন্টোর একটি প্রতিনিধি দলের কাছে ভারতে ব্রিটেনের অস্ত্র বিক্রির বিষয়ে তার অসন্তোষের কথা জানিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও ভারত ও ব্রিটেনের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা দিন দিন বাড়ছিল। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর সেন্টো নামের আঞ্চলিক জোটের মৃত্যু নিশ্চিত করে।

নিজেদের বহুমুখি ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কথা মাথায় রেখে একটি অভিন্ন অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জণে ১৯৬৪ সালে ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক একটি আঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামো দাড় করানোর উদ্যোগ নিয়েছিলো। কিন্তু সে সময় এই তিন দেশের কোনটিরই কোন সম্পদ ছিলনা। কারিগরি সহযোগিতার জন্য তাদেরকে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের দারস্থ হতে হতো।

ভূ রাজনীতিতে কোন ধারণারই খুব দ্রুত মৃত্যু ঘটেনা। আঞ্চলিক উন্নয়নের জন্য ইরান, পাকিস্তান ও তুরস্ক এক সময় সহযোগিতা ও নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় যে কাঠামো গড়ে তোলার কথা চিন্তা করেছিল। বর্তমান সময়ে এসে তা আবারো নতুন করে গতি পাচ্ছে। তবে এই কাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যে সব সীমাবদ্ধতা রয়েছে তা কাটিয়ে উঠে এটিকে বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক রুপ দেয়াও একটি বড় চ্যালেঞ্জ। স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো বর্তমানে দেশগুলোর মধ্যে সুস্পষ্ট কোন আদর্শিক প্রতিযোগিতা বা আদর্শিক যোগসূত্র নেই। কোন দেশের ভূখন্ড দখল করার উদ্দেশ্যও কোনো বৃহৎ শক্তির নেই।

মধ্যপ্রাচ্যের কোন এলাকা রাশিয়ার দখল করার ন্যূন্যতম কোন সম্ভাবনাও নেই। আফগানিস্তান থেকে মর্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের পর এই অঞ্চলে দেশটির সামরিক উপস্থিতি কমে যাবে। ফলে এই অঞ্চলে বৃহৎ শক্তিগুলোর দিক থেকে আর কোন হুমকি আর থাকছেনা। এই প্রেক্ষাপটে অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি ও নিজ নিজ আকাঙ্খা পূরণের লক্ষ্যেই আঙ্কারা-তেহরান-ইসলামাবাদ সহযোগিতা কাঠামো গড়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইরানের দিক থেকে দেখলে তুরস্ক ও পাকিস্তানের সাথে তাদের জোটবদ্ধ হওয়ার মাধ্যমে তেল সম্পদে সমৃদ্ধ আরব দেশগুলোর বিরুদ্ধে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি পাবে। অপরদিকে পাকিস্তান ও তুরস্কের রয়েছে বিপুল জ্বালানী চাহিদা। তুরস্ক ও পাকিস্তান সমরাস্ত্র উৎপাদনের ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় দেশ। এই দুই দেশের সাথে ইরানের রয়েছে বিপুল বানিজ্য। পরস্পরের বন্দর ও অবকাঠামো সুবিধা ব্যবহারের নানা সুযোগ।

প্রেসিডেন্ট রিজেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের নেতৃত্বে বর্তমানে তুরস্ক সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ, ইরাক, লিবিয়া ও দক্ষিন ককেশাসে সংঘাতে জড়িত হয়েছে। এছাড়াও পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে গ্রীসের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে আঙ্কারা। আঞ্চলিক এই ভূমিকা বা উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে মনে হচ্ছে, এরদোয়ান নিজেকে মুসলিম বিশ্বের নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তুরস্ক ও ইরান দুই দেশেরই লক্ষ্য হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে আরব দেশগুলোর প্রভাবকে খর্ব করা। আবার একই সঙ্গে দুই দেশই মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি ও শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে চায়।

অন্যদিকে পাকিস্তান-তুরস্ক সম্পর্ক সামনে এগুচ্ছে তিনটি লক্ষ্যকে সামনে রেখে। এরদোয়ান ঘোষণা করেছেন যে, পাকিস্তানের সাথে সামরিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা কোন পছন্দের বিষয় নয়। বরং এটি একটি বাধ্য-বাধকতা। দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার অংশ হিসেবে তারা দূরপাল্লার ক্ষেপনাস্ত্র সিপার ও যুদ্ধ বিমান টিএফ-এক্স ও জেএফ-১৭ জঙ্গি বিমান বানাচ্ছে। সম্প্রতি দুই দেশ যৌথ সামরিক মহড়ায়ও অংশ গ্রহন করেছে।

পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে পরমানু ক্ষেত্রে সম্ভাব্য সহযোগিতা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তানের পরমানু অস্ত্র কর্মসূচির জনক আব্দুল কাদির খানের সাথে তুরস্কের গোপন যোগাযেগ রয়েছে। যদি ইরান ও তুরস্ক পরমানু অস্ত্রের মালিক হয়ে যায় তাহলে এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও পরমানু অস্ত্র বানানোর প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়বে।

আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে বলা পাকিস্তান ও তুরস্ক পরস্পরের সাথে সমন্বয় করে আঞ্চলিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে নানা ধরণের প্রচারণা চালাচ্ছে এমন কথা ব্যাপক ভাবে আলোচিত হচ্ছে। একথাও বলা হচ্ছে যে, দেশ দুটি গোপন কোন নিরাপত্তা এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে। যদিও উভয় দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযেগিতা এখনও খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে পৌছেনি।

অর্থনৈতিক সহযোগিতার জোরদার করতে ১৯৮৫ সালে ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তান গঠন করেছিল ইকোনমিক কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা ইকো। পরে এতে মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশকেও যুক্ত করা হয়। এই উদ্যোগের পরও এখনো এই দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক সহযাগিতামূলক কর্মকান্ড খুব একটা জোরদার হয়নি।

২০১৯ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন ও যুক্তরাষ্ট্র ছিল তুরস্কের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক অংশিদার। ইরান তুরস্কের বৈশ্বিক বাণিজ্যের মাত্র ১দশমিক ৬ শতাংশের অংশীদার। পাকিস্তানের অংশ আরো কম। একই সময়ে পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় বাণিজ্যিক অংশিদার ছিল চীন, ইইউ, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। পাকিস্তানের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশিদার ১০টি দেশের তালিকায় তুরস্ক ও ইরানের নাম নেই।

এদিকে একই সময়ে ইরানের শীর্ষ বাণিজ্যিক অংশিদার দেশের তালিকায় আছে চীন, ভারত, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। পশ্চিমা বিশ্বের সাথে ইরানের সম্পর্ক ভালো না থাকায় তুরস্কের সাথে দেশটির বাণিজ্য কিছুটা বেড়েছে। এর পরিমান ইরানের মোট বাণিজ্যের ৯ দশমিক ৭ শতাংশ।

অন্যদিকে তুরস্ক ইউরোপীয় দেশগুলোর সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদার না করে বরং পূর্বমূখি হয়ে ইরান ও পাকিস্তানের সাথে বাণিজ্য বাড়াচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে তরেন আগামী দিনে ইরান, তুরস্ক ও পাকিস্তানের মধ্যে বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতার সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় পৌছার অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।