চূড়ান্ত পতনের মুখে মিয়ানমার

-

  • মেহেদী হাসান
  • ১০ মে ২০২১, ১৭:০০

জাতিসঙ্ঘের পক্ষ থেকে হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে, অর্থনৈতিকভাবে চূড়ান্ত পতনের মুখে মিয়ানমার। দেশটির জন্য করুণ অধ্যায় অপেক্ষা করছে। এমনকি মিয়ানমার হতে পারে এশিয়ার পরবর্তী ব্যর্থ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি দেশটির অখণ্ডতা এখন হুমকির মুখে। বিভিন্ন রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো সশস্ত্র আন্দোলন জোরদার করেছে। ফলে চাপের মুখে পড়েছে মিয়ানমারের জান্তা সরকার।

জাতিসঙ্ঘের উন্নয়ন কর্মসূচি বা ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা আর সেনা অভ্যুত্থানজনিত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা মিয়ানমারকে পতনের মুখে টেনে এনেছে। সেনা অভ্যুত্থানের কারণে মিয়ানমারে করোনাজনিত সমস্যা আরও তীব্র হয়েছে। মিয়ানমারে শীঘ্রই মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। কারণ, দেশটির পরিস্থিতি সহসা উন্নতির কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সেনাবিরোধী চলমান প্রতিবাদ আন্দোলন সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপ নিচ্ছে। মিয়ানমারে বিভিন্ন রাজ্যে চলমান জাতিগত বিভিন্ন গোষ্ঠীর বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সেনাবিরোধী সশস্ত্র লড়াই এখন শহরেও ছড়িয়ে পড়ছে। বাইরের বিভিন্ন শক্তির স্বাথকেন্দ্রিক আর আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ের খেলার মাঠ হতে যাচ্ছে মিয়ানমার।

সম্প্রতি মিয়ানমারের মধ্যাঞ্চলের একটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছে। এর কিছুদিন পর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর একটি অ্যাটাক হেলিকপ্টার ভূপাতিত করার দাবি করেছে বিদ্রোহীরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতিগত বিদ্রোহী গ্রুপ ও শহুরে গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভকারীদের মিলিত প্রচেষ্টায় এ ধরনের হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। তারা ধারণা করছেন, সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো বিস্ফোরক সরবরাহ করেছে এবং শহুরে বিক্ষোভকারিরা স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত থাকায় তারা সহজেই তা ব্যবহার করতে পেরেছে।

কাচিন বিদ্রোহীরা সম্প্রতি চীন সীমান্তে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আলাভূম পর্বতের কাছে সেনাবাহিনীর একটি চৌকি দখল করে নেয়। এরপর থেকে সেখানে দু’পক্ষের মধ্যে ৫০ বারেরও বেশি সংঘর্ষ হয়েছে। জান্তা সরকার বিমান হামলা চালিয়েও কেআইএ গেরিলাদের সেখান থেকে সরাতে পারেনি। বরং গেরিলারা কাচিন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলসহ নিকটবর্তী অন্যান্য এলাকাতেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির অন্যান্য অঞ্চলেও সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে।

ইউএনডিপির প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে হয়েছে, নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির যদি দ্রুত উন্নতি না হয় তাহলে ২০২২ সালের মধ্যে আড়াই কোটি লোক দরিদ্র হবে। যা মোট জনসংখ্যার ৪৮ ভাগ মানুষ। এমনকি চলতি বছরের শেষেই মিয়ানমারের অর্ধেকের বেশি মানুষ দারিদ্রতা অবস্থার মধ্যে পড়বে।

সেনা অভ্যুত্থানের ফলে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং করোনার কারণে মানুষের উপার্জন কমেছে। বেড়েছে খাদ্য পন্যের দাম। ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য সেবা খাত খুড়িয়ে চলছে। অপর্যাপ্ত সামাজিক নিরাপত্তায় লাখ লাখ মানুষ ইতোমধ্যে দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গেছে। লাখ লাখ মানুষের দৈনিক আয় এক ডলার বা তারও নিচে নেমে গেছে। এর ফলে সবেচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা।

ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে এটা নিশ্চিত যে, মিয়ানমার একটি করুণ অধ্যায়ের অপেক্ষা করছে। মিয়ানমারে সাপ্লাই চেইন ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। মানুষ ও পন্যর চলাচল স্বাভাবিক নয়। ব্যাংকিং সিস্টেম বন্ধ থাকায় লোকজন ঠিকমত রেমিট্যান্স পাচ্ছে না।

যেসব দরিদ্র জনগোষ্ঠী সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় ছিল তাদেরও অর্থ দেয়া বন্ধ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক এ অচলাবস্থা যত দীর্ঘস্থায়ী হবে এসব সমস্যা আরো মারাত্মক আকার ধারন করবে।

দারিদ্র্য দূরীকরণে মিয়ানমার লক্ষণীয় উন্নতির পথে ছিল। ২০১১ সালে গণতান্ত্রিক পথে যাত্রার পর অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সংস্কারের পর দারিদ্র্য হ্রাস পেতে থাকে। গত ১৫ বছরে মিয়ানমার দারিদ্র্য হার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালে মিয়ানমারে দারিদ্র্য হার ছিল ৪৮ দশমিক ২ ভাগ। ২০১৭ সালে তা নেমে আসে ২৪ দশমিক ৮ ভাগে। কিন্তু এ অবস্থায় আবার দারিদ্র্য হার ২০০৫ সালের আগের অবস্থায় পৌঁছে যাওয়া হবে দেশটির জন্য দুর্ভাগ্যের।

বৈশ্বিক করোনা দুর্যোগ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বিপর্যস্ত করে ফেলেছে। লকডাউনের কারণে মিয়ানমারে সরবরাহ ব্যবস্থা সচল রাখা যাচ্ছে না। পন্য উৎপাদন, বিপনন, বড় ব্যবসা থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসা সর্বত্র লন্ড ভন্ড অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর নাগাদ ৪ লাখ ২০ হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছে। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ মিয়ানমারের ৮৩ ভাগ পরিবারের আয় অর্ধেক কমে গেছে।

করোনা ভাইরাসের এই বিপর্যয়ের মধ্যে সেনাশাসন পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। চলতি বছর ১ লা ফেব্রুয়ারি গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত অং সান সুচি সরকারকে হটিয়ে সেনা প্রধান মিন অং লাই ক্ষমতা দখল করেন।

এরপর থেকে চলছে মিয়ানমারে সেনাশাসন বিরোধী রক্তাক্ত প্রতিবাদ আন্দোলন। এ আন্দোলনে সাড়া দেয় মিয়ানমারের সর্বস্তরের জনতা। ডাক্তার, শিক্ষক, সিভিল সার্ভেন্টস, কারখানা শ্রমিকরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্টানগুলোতে কর্মবিরতি পালন করা হয়। ডক, লরি, রেল শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় বন্দর কার্যক্রম। ক্রমে রসাতলে যেতে থাকে অর্থনীতি।

সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে শ্রমিক ধর্মঘটের কারণে বিভিন্ন শিপিং ফার্ম তাদের সার্ভিস সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। মিয়ানমারের ৮০ ভাগ বানিজ্য সমুদ্র নির্ভর। ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে সেনা অভ্যুত্থানের পর দুই মাসে মিয়ানমারে বন্দরগুলোতে বানিজ্য ৬৪ ভাগ কমে যায়।

সামরিক জান্তা কঠোর উপায়ে আন্দোলন দমনের পথ বেছে নিয়েছে। আর্মি ও পুলিশ গুলি করে রাস্তায় মানুষ মারছে। এডভোকেসি গ্রুপ এসিসট্যান্স এসোসিয়েশন অব পলিটিক্যাল প্রিজনারস এর তথ্য অনুযায়ী এখন পর্যন্ত প্রায় আটশ মানুষ নিহত হয়েছে এবং বন্দী হয়েছে প্রায় ৫ হাজার।

করোনা আর সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের ফলে দারিদ্র্য দূরীকরনে মিয়ানমার যে অগ্রগতি অর্জন করেছিল তা আর ধরে রাখা যাচ্ছে না। আগামী বছরের মধ্যেই মিয়ানমারের দারিদ্র্য হার বর্তমানের তুলনায় দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ইউএনডিপির মতে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা না থাকলে শুধু করোনার কারণে মিয়ানমারের দারিদ্র্য হার হয়তো ২৪ দশমিক ৮ ভাগ থেকে বেড়ে ৩৬ ভাগে পৌঁছাত। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানের কারণে এ হার এখন ৪৮ শতাংশে পৌঁছে যাচ্ছে।

জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একদিকে সাধারন মানুষের আয় কমতে থাকবে আরেক দিকে বাড়তে থাকবে খাদ্য পন্যের দাম। বাড়বে অপরিহার্য বিভিন্ন জরুরি সেবার মূল্য। শহরের মানুষের দারিদ্র্য হার তিনগুন বেড়ে যেতে পারে। কারণ করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব মানুষ। অপরদিকে সামরিক দমনাভিযানেরও শিকার হচ্ছে এসব মানুষ।

জাতিসঙ্ঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ এর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দারিদ্র্য হার বৃদ্ধি মানে শিশুরা হারাবে তাদের শিক্ষার অধিকার। আর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের মৌলিক অনেক সেবা থেকেও বঞ্চিত হবে।

মাতৃতান্ত্রিক পরিবারগুলো রয়েছে আরো ঝুঁকিতে। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও করোনার কারণে নারীদের কর্মমুখী গার্মেন্ট শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

সেনা অভ্যুত্থানের কারণে করোনা মোকাবেলার সমস্ত কার্যক্রম লন্ড ভন্ড হয়ে গেছে। সেনা অভ্যুত্থানের পর করোনা পরীক্ষা ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে করোনারজনতি দুর্ভোগ বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে সেনা অভ্যুত্থান।

মিয়ানমারে ৭০ ভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর। করোনা এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে ক্ষতির মুখে পড়েছে কৃষি খাতও। বিশেষজ্ঞদের মতে মিয়ানমারে শীঘ্রই মানবেতর পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য তহবিল সতর্ক করে দিয়ে বলেছে ক্ষুধা এবং বৈষম্য বাড়ছে মিয়ানমারে। আগামী ৬ মাসে দেশটির ৩৪ লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হতে যাচ্ছে।

ইউএনডিপির প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, সার্বিক পরিস্থিতি বিচারে অর্থনৈতিকভাবে পতনের মুখে মিয়ানমার। অর্থনৈতিক দুর্দশা ও সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলনে এশিয়ার পরবর্তী ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি। সঙ্ঘাতময় পরিস্থিতির কারণে জাতিগত সংখ্যালঘু এবং অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুহারা লোকজনের সংখ্যা বাড়বে। এরইমধ্যে মিয়ানমার-থাইল্যান্ড সীমান্তে উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়েই চলছে।