যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটছে, নেতৃত্ব নিচ্ছে চীন-রাশিয়া


  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৮ মে ২০২১, ১৪:১৯

মধ্যপ্রাচ্যের মতো কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমধ্যসাগর থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসছে চীন ও রাশিয়া। এ ক্ষেত্রে মস্কো এবং বেইজিংয়ের মধ্যে দারুণ বোঝাপড়াও তৈরি হয়েছে।

প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত ফেব্রুয়ারিতে মিউনিখ সিকিউরিটি কনফারেন্সে ঘোষণা করেছিলেন যে ট্রান্সআটলান্টিক জোট আবার ফিরে এসেছে। তবে এ জোটের সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে চীন ও রাশিয়ার ঐক্য। বিশেষ করে ভূমধ্যসাগরে ন্যাটোকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে ক্রমেই একজোট হচ্ছে চীন ও রাশিয়া।

নিউ আমেরিকান সিকিউরিটি সংস্থার একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, চীন ও রাশিয়া জোটবদ্ধ হলে তা পৃথকভাবে তাদের মোকাবিলার চেয়ে কঠিন হবে। এই দুই দেশের সম্মিলিত চ্যালেঞ্জ ন্যাটোর জন্য বড় হুমকি। এটা মোকাবিলার কোনো সহজ পথ নেই ন্যাটোর সামনে।

ভূমধ্যসাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গত জানুয়ারিতে ৬১তম আলোচনায় বসে তুরস্ক ও গ্রীস। কিন্তু এই সংকটের সমাধান হচ্ছে না। কারণ যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ভূমধ্যসাগরে ভূমিকা কমিয়ে আনায় সেখানে ক্ষমতার শূণ্যতা তৈরি হয়েছে। এদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নে তুরস্কের যোগদানের আলোচনাও বাতিল হয়ে গেছে। আবার পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রধান সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে ফিরেছে রাশিয়া।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের কয়েক দশক পর রাশিয়া আবার কৃষ্ণ সাগর, পূর্ব ভূমধ্যসাগর এবং সিরিয়া ও লিবিয়ায় আবার সদর্পে ফিরে এসেছে।

ক্ষমতার এই ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন নতুন খেলোয়াড় চীনের আগমন। ২০১৩ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ঘোষণার পর থেইে চীন ভূমধ্যসাগর তীরবর্তী দেশগুলোতে ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। চীন যেসব আঞ্চলিক বন্দর কিনছে সেগুলো ইউরোপের কন্টেইনার সক্ষমতার ১০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করবে। চীন উত্তর আফ্রিকার প্রতিটি দেশের সঙ্গে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অংশ হিসেবে সমঝোতা সাক্ষর করছে।

২০১৯ সালের জুনে চীনের কোম্পানি সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল পোর্ট গ্রুপ ইসরাইলের হাইফা শহর কর্তৃপক্ষের একটি চুক্তি করেছে। এর ফলে ভূমধ্যসাগরে একটি সমুদ্রবন্দর নির্মাণ ও পরিচালনা করতে পারবে বেইজিং। চীনের বিনিয়োগ কোনো হুমকি নয়। কিন্তু এর মাধ্যমে চীন পুরাতন অবকাঠামো পুনর্নিমাণ এবং পরিবহন কানেকটিভিটির উন্নতি করে চলেছে। চূড়ান্ত বিচারে চীন এসব বিনিয়োগের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বিশাল প্রভাব সৃষ্টি করতে সক্ষম হবে।

ভূমধ্যসাগরে চীন ও রাশিয়ার এই ক্রমবর্ধমান অংশীদারিত্ব এ অঞ্চলের পুরো হিসাবনিকাশকেই পাল্টে দিচ্ছে। রাশিয়াও চীনকে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ করে দিচ্ছে। রাশিয়ার সঙ্গে অংশীদারিত্বের ফলে চীন সামরিক কার্যক্রম পরিচালনায় আরও দক্ষ হয়ে উঠছে।

২০১৫ সালে চীন ও রাশিয়া প্রথমবারের মত পূর্ব ভূমধ্যসাগরে প্রথম যৌথ নৌ মহড়া চালায়। এরপর ২০১৭ সালে চীরেন নৌবাহিনীর রণতরীর বহর পূর্ব ভূমধ্যসাগরে তাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি যাচাই করার জন্য তাজা গুলির মহড়া চালায়। এরপর বাল্টিক সাগরে রুশ নৌবাহিনীর সঙ্গে চীন যৌথ মহড়ায় অংশ নেয়। রাশিয়া ও চীনের এই যৌথ অভিযানে ইঙ্গিত মিলছে যে তারা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে চায়। শুধু তাই নয়, রাশিয়ার কোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ন্যাটো জবাব দেওয়ার প্রস্তুতি নিলে চীন তার নিয়ন্ত্রণে থাকা ইউরোপের অবকাঠামো ব্যবহার করে ন্যাটোকে গতিরোধ করতে চায়।

ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার সংঘাত দেখা দিলে চীন তার নিয়ন্ত্রিত বন্দরে কারিগরি সমস্যার কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি মোতায়েনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। চীন ও রাশিয়ার এই জোটবদ্ধতা প্রতিরক্ষা ছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রেও ভূমধ্যসাগরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের স্বার্থকে বিপন্ন করতে পারে।

চীন ও রাশিয়া অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জোটকে অনেক বেশি অকার্যকর করে ফেলতে পারে। যেমন সোভিয়েত আমল থেকেই সাইপ্রাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আছে মস্কোর। যুক্তরাষ্ট্র এখন ওই দেশটির দিকে মনোযোগ না দেওয়ায় সেই সুযোগ নিচ্ছে রাশিয়া। সেখানে রাশিয়ার শক্তিশালী উপস্থিতি রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অনুপস্থিতির সুযোগ রাশিয়া ভূমধ্যসাগরে সাইপ্রাসের জ¦ালানি অনুসন্ধান নিয়ে সংঘাতে মধ্যস্থতা করেছে। এতে রাশিয়াকে সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক ও গ্রিস। রাশিয়ার মতই চীনও সাইপ্রাসে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের শূন্যতা পূরণ করছে।

ইউরোপে করোনাভাইরাস মহামারির শুরতেই চীন প্রথম সাইপ্রাসে চিকিৎসা সামগ্রী অনুদান দেয়। ওই অনুদানের জেরে দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারের জন্য সম্প্রতি দেশটি সফর করেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। রাশিয়া চায় অস্থিতিশীলতার সুযোগে প্রভাব বিস্তার করতে । আর চীনের লক্ষ্য গণতান্ত্রিক জোটের বিকল্প বলয় তৈরি যার নেতৃত্ব চীন একাই দেবে।

অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, চীন ও রাশিয়ার মোকাবিলায় ট্রান্স আটলান্টিক জোটকে দৃঢ় করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। চীন ও রাশিয়ার মোকাবিলায় একতরফা নিষেধাজ্ঞা কিংবা সমন্বিত বাণিজ্য চুক্তি খুব বেশি সুফল দেবে না। বরং যুক্তরাষ্ট্র এবং তার ইউরোপীয় মিত্রদের একটি সমন্বিত চীন নীতি দরকার। চীনের মোকাবিলার জন্য প্রযুক্তি, ক্লিন এনার্জি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় ইউরোপকে সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে পারে আমেরিকা।

ইউরোপ শক্তিশালী হলে চীনকে মোকাবিলা করা সহজ হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনকে মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরালো করা। যেমন চীনের বিনিয়োগের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র গ্রিসে বিনিয়োগ বাড়াতে পারে। গ্রিসের বন্দরগুলো উন্নয়নে কৌশলগত বিনিয়োগের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে, উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তি চীনের বিনিয়োগের জন্য এখন জার্মানির মত ইউরোপের শক্তিশালী দেশও মুখিয়ে আছে। ফলে আমেরিকা বিনিয়োগের মাধ্যমে চীনকে মোকাবিলা করতে পারবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভূমধ্যসাগরে ন্যাটোর বিশ^াসযোগ্যতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া উচিত যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের। কিন্ত ন্যাটোর মধ্যেই এখন বিভাজন স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কয়েক বছর ধরে তুরস্কের সম্পর্কে উত্তেজনা চলছে। তুরস্ক রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কেনায় ন্যাটোর কার্যকারিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। আবার সমুদ্রসীমা নিয়ে তুরস্কের সঙ্গে গ্রিস ও সাইপ্রাসের বিরোধেরও সুরাহা হয়নি। তুরস্ক ও গ্রিসের জাহাজ তো কার্যত সংঘাতে জড়িয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুরস্কের বিরোধের আশু সমাধান হওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তবে ইউরোপের সঙ্গে তুরস্কের সম্পর্ক ভেঙে যায়নি এখনও। তুরস্কের সঙ্গে ইউরোপের দেশগুলো ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়তে সক্ষম হলে ভূমধ্যসাগরে হিসাব নিকাশ আবার পাল্টে যেতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাশিয়ার প্রভাব ঠেকাতে হলে ভূমধ্যসাগর এবং কৃষ্ণ সাগরে ন্যাটোর নৌবাহিনীর অবস্থান শক্তিশালী করতে হবে। রাশিয়ার সাবমেরিনের হুমকিও মোকাবিলার প্রস্তুতি থাকতে হবে ন্যাটোর। ভূমধ্যসাগরে চীনের বন্দরগুলোর বিপরীতেও ন্যাটোর বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুতি কতটুকু?

বাস্তবতা হচ্ছে দিনদিনই পিছিয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। এর কারণ উদীয়মান চীনকে মোকাবিলাই এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে বড় অগ্রাধিকার। এ কারণে মধ্যপ্রাচ্য কিংবা ইউরোপের অনেক দেশকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আর আগের মত ভাবতে চায় না। বরং মধ্যপ্রাচ্য থেকে যুক্তরাষ্ট্র সরে আসতে চাইছে।

বাইডেনের একজন ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা এবং সাবেক ঊর্ধতন জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছেন, ‘আপনি যদি বাইডেনের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত অঞ্চলগুলোর তালিকা লক্ষ্য করেন তবে দেখবেন যে মধ্যপ্রাচ্য এখন আর শীর্ষ তিনের মধ্যেও নেই। প্রথমে আছে এশিয়া-প্যাসিফিক তথা চীন, তারপরে ইউরোপ এবং তারপরে পশ্চিম গোলার্ধ। বৃহৎ শক্তি চীন ও রাশিয়ার উত্থানে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কারণে বাইডেনের এ অবস্থান গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছেন।

বাইডেনের আরেকজন উপদেষ্টা বলেছেন, ইচ্ছে করেই মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে আর জড়ানো হচ্ছে না। বাইডেন মধ্যপ্রাচ্যের বদলে অন্যান্য বৈশি^ক ইস্যুকে অগ্রাধিকার দিতে চান। বাইডেনের আগের শাসকরাও এ চেষ্টা করেছিলেন, তবে সফল হতে পারেননি। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক নির্ধারকরা মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে অপ্রয়োজনীয় রকমের মাথা ঘামায়।

বিশ্লেষকরা বলছেন, মধ্যপ্রাচ্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বেশি সময়, মনযোগ ও সম্পদ বিনিয়োগ করায় চীন ও রাশিয়ার উত্থানের দিকে বেশি গুরুত্ব দিতে পারেনি। এখন সময় এসেছে ভুল শোধরানোর।