করোনায় বিপর্যস্ত ভারতের অর্থনীতি


  • মোতালেব জামালী
  • ০৮ মে ২০২১, ১৩:৩৮

ভারত হচ্ছে বিশ্বের বৃহৎ ও দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে সারা বিশ্বের মতো ভারতের অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মেকাবিলার পর ভারত আগের জায়গায় আসতে ২৫ বছর লেগে যেতে পারে।

ভারতে গত বছরের মার্চে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়। প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মেদির সরকার ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সারাদেশে কঠোর লকডাউন ঘোষণা করে। বিশ্বের আর কোনো দেশে এভাবে এত কঠোর বা সর্বাত্মক লকডাউন দেওয়া হয়নি। এর ফলে বিমান, ট্রেন, বাসসহ সব গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি ব্যক্তিগত যানবাহন চলাচলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। ঘরবন্দি হয়ে পড়ে মানুষ। শিল্প-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সব অচল হয়ে পড়ে। এতে দেশটির অর্থনীতির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে।

ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অর্থনৈতিক উইং-এর এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, লকডাউনের কারণে ভারতের ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন রুপির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। সারাদেশে এই মোট ক্ষতির মধ্যে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানের ক্ষতিই হয়েছে ৮০ শতাংশ। এরমধ্যে এককভাবে মহারাষ্ট্রেরই ক্ষতি হয়েছে ৫৪ শতাংশ।

লকডাউনের ফলে ভারতের বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়েন হাজার হাজার কর্মজীবী মানুষ। এক রাজ্য থেকে হেঁটে আরেক রাজ্যে নিজের বাড়িতে পৌঁছার চেষ্টায় অনেক মানুষকে পথে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় জীবনও দিতে হয়। লকডাউনের প্রথম ২১ দিনে সারা ভারতে ৭ থেকে ৮ লাখ কোটি রুপির আর্থিক ক্ষতি হয়েছে বলে বিশ্লেষক ও শিল্প-কারখানাগুলো হিসাব জানিয়েছেন।

লকডাউনের কারণে একদিকে যেমন মানুষের আয় কমে গেছে, অন্যদিকে ভারত সরকারের রাজস্ব আয়ও কমে গেছে। এতে আগামী কয়েক বছর সরকারের রাজস্ব ঘাটতি অব্যাহভাবে বাড়তে থাকবে। শিল্প খাতে নেই কোনো বিনিয়োগ। বেসরকারি খাতও অনেকটাই স্থবির হয়ে আছে। বাণিজ্যেও নেমে এসেছে স্থবিরতা। দেশের অসংগঠিত খাতগুলো এবং প্রবাসী শ্রমিকদের আর্থিক অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের পর বিশ্বের প্রায় সব দেশের সাথে ভারতের বিমান যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে।

অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা ওইসিডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর করোনা ভাইরাসের সংক্রমন শুরুর আগে ২০২১ সালে ভারতের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ১২দশমিক ৬ শতাংশ। কিন্তু গত মার্চ মাসে সংস্থাটির প্রকশিত নতুন এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়া ও কঠোর লকডাউন কার্যকর করার কারণে ২০২১ অর্থ বছরের চতুর্থ কোয়ার্টারে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার কমে ৭ দশমিক ৮ শতাংশে নেমে নেমে আসবে।

২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর সরকার ঘোষিত লকডাউনের প্রথম ২১ দিনে দৈনিক ৩২ হাজার কোটি রুপি বা ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে ভারতে দৈনিক ২দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলারের আর্থিক কর্মকান্ড পরিচালিত হয়। পূর্ণ লকডাউন চলাকালে এর এক চতুর্থাংশ কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে।

অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর কারণে সারা ভারতে ৫৩ শতাংশ ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভারত ফোর্জ, আল্ট্রাটেক সিমেন্ট, আদিত্য বিড়লা গ্রুপ, বিএইচইএল ও টাটা মোটর্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ব্যবসায়িক কর্মকান্ড স্থগিত করে কিংবা ব্যাপকভাবে হ্রাস করে।

ভারতের শেয়ার বাজার দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আর্থিক ক্ষতির কবলে পড়ে। নরেন্দ্র মোদির সরকার দরিদ্রদের জন্য এক লাখ ৭০ হাজার কোটি রুপির বা ২৪ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ ঘোষণা করে। এরপর আরো দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। সব মিলিয়ে সরকার ২৯দশমিক ৮৭ লাখ কোটি রুপির আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়।

করোনা মহামারির কারণে ভারতের অর্থনীতির বিভিন্ন খাত ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে বিমান চলাচল, পর্যটন, অটোমোবাইল, রিয়েল এষ্টেট ইত্যাদি খাতগুলো মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে এসব খাতের অনেক বছর লেগে যেতে পারে। গত বছর মার্চ মাসে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর এর বিস্তার রোধে সারা বিশ্বে বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে সরকারি-বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো মারাত্মক আর্থিক ক্ষতির কবলে পড়ে। বিমান চলাচল বন্ধের প্রভাব গিয়ে পড়ে পযৃটন খাতের উপরও। বিশ্বের আকর্ষনীয় পর্যটন স্পটগুলো লাখ লাখ পর্যটক থেকে বঞ্চিত হয়। মাত্র কয়েক দিনের লকডাউনের যখন এত বিপুল ক্ষতি হয় তখন হাজার, হাজার মানুষের মৃত্যু আর দীর্ঘমেয়াদে বিচ্ছিন্ন থাকার ক্ষতি যে বহুগুন বেশি হবে তা সহজে অনুমান করা যায়।

প্রথম দফায় সংক্রমন রোধে দেশের অভ্যন্তরে গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ করে দেয়া হয়। এতে পরিবহন খাতের মালিক-শ্রমিকরা চরম আর্থিক সংকটে পড়েন। করোনার কারণে রিয়েল এষ্টেট খাতের কর্মকান্ডও স্থবির হয়ে পড়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে বেচা-কেনা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ও কঠোর লকডাউনের কারণে ভারতের অর্থনীতির যে বিরাট ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। তাদের মতে, কোভিড-১৯ এর সংক্রমন শুরুর আগে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে গতি ছিল আবার সেই পর্যায়ে যেতে এক দশকেরও বেশি সময় লেগে যেতে পারে।

ভারতের ন্যাশনাল ইন্সটিউিট অব পাবলিক ফিন্যান্স অ্যান্ড পলিসির রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া চেয়ার সব্যসাচী কার মনে করেন, গত এক বছরে ভারতের অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে ২০৩৩ সালে পর্যন্ত লেগে যেতে পারে। তার মতে, আগামী ১৩ বছর যদি ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ করেও হয় তার পরও এই সময় লাগবে।

এটা আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য, যে দেশে শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেনী আছে সেদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি তত বেশি শক্তিশালী হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমনের কারণে গত এক বছরে ভারতে মধ্যবিত্ত শ্রেনী কমে গেছে এক তৃতীয়াংশ। ধারণা করা হচ্ছে কোভিড-১৯ সংক্রমন শুরুর আগে ভারতে মধ্যবিত্তের সংখ্যা ছিল অন্তত ৯ কোটি ৯০ লাখ। কিন্তু মহামারির ফলে আর্থিক সংকটের কারণে গত এক বছরে এই সংখ্যা কমে ৬৬ লাখে নেমে এসেছে। চলমান আর্থিক সংকট অব্যাহত থাকলে এই সংখ্যা আরো কমবে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে, গত এক বছরে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি হয়ে গেছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস সংক্রমনের আগে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫ কোটি ৯০ লাখ। কিন্তু গত এক বছরে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩ কেটি ৪০ লাখ। এছাড়া সারা ভারতে অন্তত আরো সাড়ে সাত কোটি মানুষ দরিদ্রের কাতারে চলে আসবে যারা দৈনিক দুই ডলারেরও কম তাদের জীবন যাত্রার ব্যয় নির্বাহের জন্য ব্যয় করে থাকে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ এর আর্থিক সংকটের কারণে ভারতে দরিদ্রের সংখ্যা চীনের চেয়েও দ্রুত বাড়তে পারে।

২০২০ সালের শুরুর দিকে ভারতে বেকারত্বের হার ছিল ৫দশমিক ৪ শতাংশ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে বেকারত্বের হার বাড়তে থাকে। সর্বশেষ তথ্যে দেখা যায়, গত মাসের অর্থাৎ এপ্রিলের শেষ দিকে দিকে এসে তা ৮ শতাংশের উপরে পৌছেছে।

ভারতে যে বেকারত্ব এরমধ্যে শহুরে এলাকায় বেকারত্বের হার ৮দশমিক ৪ শতাংশ এবং গ্রামীন এলাকায় বেকারত্বের হার ৭দশমিক ২ শতাংশ। শ্রমিকদের কাজে অংশ গ্রহনের হার কমেছে গড়ে ৪০ শতাংশ। তথ্যে দেখা যায়, ১২ কেটিরও বেশি অসংগঠিত শ্রমিক মারাত্মক আর্থিক সংকটে দিন কাটাচ্ছে।

প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ভারতে লকডাউন চলাকালে চাকুরি হারিয়েছেন প্রায় ১৪ কেটি মানুষ। বেতন কমানো হয়েছে কোটি কোটি চাকুরিজীবির। সারাদেশে যতগুলো পরিবার আছে তাদের মধ্যে ৪৫ শতাংশেরও বেশি পরিবারের আয় আগের বছরের তুলনায় অর্ধেক কমে গেছে।

ভারতে এখন আবার করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মারাত্মকভাবে আঘাত হেনেছে। হাসপাতালে ঠাই নেই। অক্সিজেন সংকটে বিনা চিকিৎসায় জীবন দিতে হচ্ছে শত শত কোভিড রোগীকে। পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ ভারতকে অক্সিজেন ও অন্যান্য চিকিৎসা উপকরন দিয়ে সহায়তা করছে। আবারো বিভিন্ন রাজ্য লকডাউন ঘোষনা করেছে। এর ক্ষতি এখনও নিরুপর করা সম্ভব হচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করেন করোনার এবারের যে ঢেউ তাতে ভারতের অর্থনীতি ২০ থেকে ২৫ বছর পিছিয়ে গেছে। ভারতকে আগের জায়াগায় যেতে হলে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।