বিল গেটসের জীবন সম্পদ প্রেম বিচ্ছেদ


  • আহমেদ বায়েজীদ
  • ০৮ মে ২০২১, ১৩:২০

বিল গেটস। এই নামটি বললে আর কোনো পরিচয়ের দরকার হয় না। স্কুল জীবনেই যাকে পেয়ে বসেছিল কম্পিউটারের নেশা। সেই নেশাকেই শেষ পর্যন্ত পেশা বানিয়ে হয়ে গেছেন বিশ্বের সেরা ধনী। সম্প্রতি আলোচনায় এসেছেন স্ত্রী মেলিন্ডার সাথে তার দীর্ঘ ২৭ বছরের সংসারের ভাঙন নিয়ে। বিয়ে ভাঙার ফলে তার বিশাল সম্পদের অর্ধেক চলে যেতে পারে মেলিন্ডার হাতে। তাহলে কি শীর্ষস্থানীয় ধনীর তালিকা থেকে বাদ পড়বেন গেটস?

বিশ্বকে বদলে দিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে যে দুয়েকটি আবিষ্কার, তার মধ্যে কম্পিউটার একটি। আর কম্পিউটার ব্যবহারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে মাইক্রোসফট। এক সময় কম্পিউটার ব্যবহার করতে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ হতে হতো; কিন্তু সেই অবস্থা থেকে বিশ্বকে মুক্তি দিয়েছে মাইক্রোসফটের অপারেটিং সিস্টেম। এই পরিবর্তনের কারিগর বিল গেটস, তার প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট কর্পোরেশন আর তাদের তৈরি করা অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ।

হার্ভার্ড ড্রপআউট বলে বিল গেটসের একটি নেতিবাচক পরিচিতি আছে। অর্থাৎ হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি তিনি। যদিও কথাটি পুরোপুরি ঠিক নয়। ঠিক নয়- কারণ বিল গেটস শৈশব থেকেই ছিলেন তুখোর মেধাবি। তার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঝড়ে পড়া একাডেমিক ব্যর্থতার কারণে নয়। দুই বছর হার্ভার্ডে পড়ার পরই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দেন। বাবার চাওয়া মতো আইনজীবি হওয়ার বদলে তাকে পেয়ে বসে কম্পিউটারের নেশা।

বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়েছিলেন ব্যবসায় করার জন্য। বিল গেটস অবশ্য বিষয়টিকে দেখেছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছুটি নেয়া হিসেবে। তিনি বলেন, আমার পরিকল্পনা ছিল উদ্যোগ যদি সফল না হয়, তবে আবার ফিরব হার্ভার্ডে; কিন্তু তাকে আর পেছনে ফিরতে হয়নি। শুধু সামনেই চলেছেন পরের অনেকগুলো বছর। যা তাকে নিয়ে গেছে বিশ্বের শীর্ষ ধনীর আসনে। একবার দুবার নয়, অনেকগুলো বছর তিনি থেকেছেন এই আসনে।

যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম উপকূলীয় অঙ্গরাষ্ট্র ওয়াশিংটনের সিয়াটল শহরে স্বচ্ছল পরিবারের ১৯৫৫ সালে জন্ম উইলিয়াম হেনরি গেটসের। যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত ওয়াশিংটন স্টেট। গেটসের বাবা ছিলেন আইনজীবী আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে চাকরি করতেন মা। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মাঝে গেটস ছিলেন মেঝ। ১৩ বছর বয়সে লেকসাইড প্রেপ স্কুল নামের একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হন গেটস। সেখানেই তার কম্পিউটারের সাথে পরিচয়।

তখন কম্পিউটার ছিল হাটি হাটি পা পর্যায়ের। লেকসাইড স্কুলে পড়তো অপেক্ষাকৃত ধনী পরিবারের সন্তানেরা। একবার শিক্ষার্থীদের মায়েদের নিয়ে গড়া মাদার্স ক্লাব চাঁদা তুলে স্কুলে একটি কম্পিউটার কিনে দেয়। গেটস তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তখন কম্পিউটার ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর একটি বস্ত। কম্পিউটার নিয়ে গেটসের খেলা চলতে থাকে। সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন একই স্কুলের ছাত্র পল অ্যালেনকে।

নিজস্ব উদ্যোগে বিল এবং অ্যালেন সফটওয়ার নিয়ে কিছুদিন কাজ করেন কম্পিউটার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এমআইটিএসের সাথে। ১৯৭৫ সালে এমআইটিএস বাজারে আনে ইন্টেল ৮০৮০ সিপিইউ’র অ্যালটায়ার মাইক্রো কম্পিউটার। তখনই দুজনের মাথায় আসে নিজস্ব সফটওয়ার কোম্পানি খোলার। প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফট। চলতে থাকে প্রোগ্রামিং।

১৯৮০ সালে বিখ্যাত প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইবিএম একক ব্যবহারের জন্য একটি কম্পিউটার তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। এই কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম তৈরির জন্য মাইক্রোসফট দায়িত্ব পায়। বাজার থেকে কেনা একটি সফটওয়ারে কিছু পরিবর্তন এনে আইবিএমকে দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালটি ছিল বিল গেটসের স্বপ্ন পূরণের বছর। ওই বছরের ২০ নভেম্বর মাইক্রোসফট বাজারে ছাড়ে প্রথম অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ওয়ান। কম্পিউটার দুনিয়া লুফে নেয় সেই সফটওয়ার।

উইন্ডোজ ওয়ান বাজারে ছাড়ার মাত্র ২ বছরের মাথায় বিলিয়নিয়রের তকমা পান গেটস। ১৯৮৭ সালে ফোর্বস ম্যাগাজিনের করা যুক্তরাষ্ট্রের সেরা ৪০০ ধনীর তালিকায় স্থান করে নেন। তখন তার সম্পত্তির পরিমান ১.২৫ বিলিয়ন অর্থাৎ ১২৫ কোটি মার্কিন ডলার। নিজের চেষ্টায় বিলিয়নিয়ার হয়েছে এমন লোকদের মধ্যে তখন তার বয়স ছিল সবচেয়ে কম।

১৯৯৫ সালে হয়ে ওঠেন বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ২০১৭ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছর শীর্ষ ধনীর তালিকায় এক নম্বরে ছিলেন অন্য কেউ। বাকি বছরগুলো ছিল বিল গেটসেরই দখলে। ২০১৭ সালের অক্টোবরে তাকে ছাড়িয়ে যেন যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক ধনকুবের জেফ বেজোস। ২০০৬ সালে মাইক্রোসফটের কিছু দায়িত্ব অন্যদের হাতে ছেড়ে দেন গেটস। ২০০৮ সালে পুরোপুরি অবসরে যান তিনি। মনোযোগ দেন মানবসেবায়। বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাড়ানো শুরু করেন এই ধনকুবের।

শেষ বয়সে এসে সংসার ভাঙার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। ব্যক্তিগত জীবনে দুই কন্যা আর এক পুত্র সন্তানের জনক বিল গেটস। ১৯৮৭ সালে প্রথম দেখা বিল ও মেলিন্ডার। মাইক্রোসফটে ওই বছরই প্রোডাক্ট ম্যানেজার হয়ে যোগ দিয়েছিলেন মেলিন্ডা। সাত বছরের প্রেম শেষে ১৯৯৪ সালে বিয়ে। ২৭ বছর পর ভাঙলো সেই সংসার। গত ৩ মে সিয়াটলে কিং কাউন্টি আদালতে বিবাহ-বিচ্ছেদের আবেদন জানান বিল-গেটস ও মেলিন্ডা গেটস।

কেন ভাংলো তাদের সংসার তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। বিশ্বের ট্যাবলয়েড পত্রিকাগুলো নানা কাহিনী প্রচার করছে। ২৭ বছরের দাম্পত্য জীবন- সব মিলিয়ে ৩৪ বছরের প্রেমের এক ঝড়ো ইনিংস খেলার পর দু’জন দু’মেরুতে অবস্থান নিলেন। বৃটেনের একটি ট্যাবলয়েট পত্রিকা বলছে এর মধ্যে দু’জনেই ঘড় ভাংগার বিষয়ে কিছু ইঙ্গিত দেয়ার চেষ্টা করেছেন। মেলিন্ডা বলেছেন, দিনের মধ্যে ১৬ ঘন্টা কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন বিল গেটস। পরিবারের দিকে তার মন নেই। অনেকবার এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়াও হয়েছে।

অন্যদিকে মেলিন্ডা সম্পর্কে বিল গেটস বলেছেন, তার তো অনেক বয়ফ্রেন্ড আছে। আর আমার আছে মাইক্রোসফট। এসব নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের সম্পর্কে ঝড় চলছিল। সেই ঝড়কে কাটিয়ে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলেন তারা। দাবি করা হয় যে, তাদের বৈবাহিক সম্পর্ক বেশ কয়েকবার ভেঙেই পড়েছিল। বিল গেটস এবং মেলিন্ডা গেটসকে দেখা হতো ‘পাওয়ার কাপল’ বা শক্তিধর দম্পতি হিসেবে।

বিল গেটসের সম্পত্তির মোট পরিমাণ ১৪৬ বিলিয়ন বা ১৪ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ ধনী ব্যক্তি তিনি। আইন অনুযায়ী বিচ্ছেদের ফলে মেলিন্ডা এই সম্পত্তির অর্ধেক পাবেন এমন কথা আলোচনা হচ্ছে। আর সেটি হলে ফরাসি ধনকুবের ফ্রাসোয়া মায়ার্সের পর মেলিন্ডা হয়ে যাবেন বিশে^র দ্বিতীয় ধনী মহিলা। অন্য দিকে বিল গেটস বাদ পড়বেন শীর্ষ ধনীদের তালিকা থেকে। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, ওয়াশিংটন স্টেটের আইন অনুযায়ী বিচ্ছেদ হলে দম্পতির সম্পদ উভয়ের মধ্যে সমান ভাগভাগি হবে। সেটি হলে মেলিন্ডার সম্পদের পরিমান দাড়াবে ৭৩ বিলিয়ন ডলারে।

এর আগেও এমন কোটি ডলারের বিবাহ বিচ্ছেদ দেখেছে বিশ^। ২০১৯ সালে অ্যামাজনের প্রধান জেফ বোজেসের সাথে ছাড়াছাড়ি হয় ম্যাকেঞ্জি স্কটের। ওই বিচ্ছেদে ম্যাকেঞ্জি পেয়েছিলেন ৩৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মার্কিন মিডিয়া মুঘল রুপার্ট মারডকের সাথে ১৯৯৯ সালে স্কটিশ সাংবাদিক ও সাহিত্যিক আনা মারিয়ার বিচ্ছেদের পর মারিয়া পেয়েছিলেন ১দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি ও ১১০ মিলিয়ন ডলার নগদ অর্থ। ২০১০ সালে গলফ কিংবদন্তী টাইগার উডসের সাথে বিচ্ছেদের পর তার স্ত্রী এলিন নরডেগ্রিন পান ৭১০ মিলিয়ন ডলার।

সবাইকে ছাড়িয়ে যেতে পারে বিল মেলিন্ডার বিচ্ছেদ। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাষ্ট্রের রয়েছে আলাদা আইন। তাই প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্থানীয় আইন প্রযোজ্য হচ্ছে। এদের মধ্যে একমাত্র মেলিন্ডাই তার স্বামীর সম্পত্তির অর্ধেক পেতে পারেন ওয়াশিংটন অঙ্গরাষ্ট্রের আইনের কারণে। কিন্তু সম্পদ শেষ নয়। বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের অঢেল সম্পদের পরও তারা কতটা সুখী ছিলেন সে প্রশ্ন আবার উঠেছে। আবার বিচ্ছেদ মানেই জীবনের গতি থেমে যাওয়া নয়।