পিকেকের বিরুদ্ধে কতটা সফল তুরস্ক


  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৬ মে ২০২১, ১৬:৪১

তুর্কি সেনাবাহিনীর সামরিক কৌশল আর আক্রমণাত্মক ভূমিকার কারণে ক্রস-বর্ডার অপারেশনে ইরাকের উত্তরাঞ্চলে কুর্দিস্তান ওয়ার্কাস পার্টি বা পিকেকের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সাফল্য এসেছে। ইরাকের ভেতরে প্রবেশ করে পিকেকের সামগ্রিক কাঠামো, সেল ও নেটওয়ার্ককে রীতিমতো বিপর্যয়ের মধ্যে ফেলে দিতে সক্ষম হয়েছে তুর্কি সেনাবাহিনী। ২০১৯ সালে তুরস্ক তার সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ইরাকের পাহাড়ি এলাকায় এ অভিযান শুরু করে। ধারণা করা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোতে পিকেকের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের কৌশলে তুরস্ক কিছু পরিবর্তনও নিয়ে আসবে।

রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া বিদ্রোহী বা গেরিলা যোদ্ধারা ঐতিহাসিকভাবেই নিজেদের আবাসস্থল হিসেবে পার্বত্য এলাকাকেই বেছে নেয়। পিকেকেও তার ব্যতিক্রম নয়। এক্ষেত্রে তুরস্কের সেনাবাহিনী পাহাড়ি এলাকায় আশ্রয় নেওয়া পিকেকেকে ছাড় দিতে চায়নি। বেশ ঝুঁকি নিয়ে পাহাড়ের গুহা এবং অভ্যন্তরীণ কাঠামোগুলোতে হামলা চালায়। সম্প্রতি উত্তর ইরাকে তুরস্কের সেনাবাহিনী যে অভিযানগুলো চালিয়েছে, তাতে পাহাড়ি এলাকায় তুর্কি সেনাবাহিনীর সক্রিয়তা ও দক্ষতা আরেক দফা প্রমাণিত হয়েছে।

জার্গোস পর্বতমালা ইরাকের বৃহত্তম পার্বত্য অঞ্চল। এখানে সর্বোচ্চ ৩ হাজার মিটার উচ্চতারও পর্বতশৃঙ্গ রয়েছে। এই এলাকার ভৌগলিক কাঠামোটি এতটাই বন্ধুর যে এখানে যাওয়া আসা করাও খুবই কঠিন। ইরাক-ইরান সীমান্তে যেমন খাড়া পর্বতমালা রয়েছে, ঠিক একই অবস্থা ইরাক ও তুরস্কের সীমান্তেও। ফলে এ সীমান্তগুলো পৃথিবীর অন্যান্য সীমান্তের তুলনায় অনেক বেশি দুর্ভেদ্য।

ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় এলাকার এই দুর্ভেদ্য পর্বতমালার একেবারে মাঝখানে ছোটো কয়েকটি নদী আছে। কিছু গ্রামও আছে। তবে যেকোনো মানুষের পক্ষেই এসব পাহাড়ে ওঠা খুবই দুরুহ। ভৌগলিকভাবে এলাকাটি এতটা জটিল ও বন্ধুর হওয়ার কারণেই পিকেকে সেখানে তাদের ঘাঁটি তৈরি করেছে। এই ঘাঁটি একদিনে তৈরি হয়নি। দীর্ঘ কয়েক বছর সময় নিয়ে ইরাকের উত্তরাঞ্চলীয় নানা এলাকায় ঘাঁটি তৈরি করতে সক্ষম হয় পিকেকে। এরমধ্যে কান্দিল, হাকুর্ক, জাপ, আভাসিন, বাসইয়ান, মেতিনা, হাফতানিন, সিনাত, গারা এবং সিনজারে পিকেকে তাদের আধিপত্যও প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রথমদিকে, পিকেকে অবশ্য কুর্দী বিভিন্ন গ্রাম থেকে কিছু সহায়তা নিতো। এমনকী তাদেরকে কর দিতেও বাধ্য করতো। পিকেকের অত্যাচারের কারণেই এসব এলাকার গ্রাম থেকে হাজার হাজার মানুষ পালিয়ে যায়।

তুরস্কের সেনাবাহিনী এর আগে বেশ কয়েকটি সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছিল। এই অভিযানগুলোতে প্রাথমিকভাবে কিছু সফলতা আসলেও পিকেকেকে দুর্বল করে দেয়া সম্ভব হয়নি। পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান নেয়ায় আকাশ পথে পিকেকের কার্যক্রমের ওপর কোনো নজরদারি করতে পারছিলো না তুর্কি সেনাবাহিনী। গুহাগুলোর ভেতরে পিকেকে যোদ্ধারা আশ্রয় নেয়ায় সামরিক বাহিনীও সেখানে প্রবেশ করতে পারছিল না। কিন্তু বর্তমান অভিযানগুলোর ধরনের পাল্টে গেছে।

তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্পখাত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এমন কিছু ড্রোন তৈরি করেছে যা ব্যবহার করে তুরস্ক ইতোমধ্যেই সিরিয়া, লিবিয়া এবং আজারবাইজানে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। নাগারনো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রন নিয়ে যে যুদ্ধটি হলো তাতেও তুরস্কের এ ড্রোনের কারণেই আজারি সেনারা চুড়ান্ত বিজয় লাভ করেছিল। এই ড্রোনগুলো এখন তুরস্ক পিকেকের বিরুদ্ধেও ব্যবহার শুরু করেছে।

এই ড্রোনগুলো মোতায়েন করার পর থেকেই তুরস্ক এখন নিয়মিতভাবে পিকেকের কার্যক্রম নজরদারি করতে পারছে। প্রয়োজনে আক্রমণও করতে পারছে। অন্যদিকে, তুরস্কের সেনাবাহিনীকেও এরই মধ্যে এমন কিছু গোলা বারুদ, প্রযুক্তি ও বিস্ফোরক সরবরাহ করা হয়েছে যা দিয়ে তারা পাহাড়ী গুহায় আশ্রয় নেয়া যেকোনো গোষ্ঠীকে পরাজিত করতে পারে।

তুরস্কের সাম্প্রতিক সাফল্যের নেপথ্যে আছে তাদের গেইমচেঞ্জার আক্রমণাত্মক অপারেশনাল মডেল। যেকোনো ধরনের ক্রসবর্ডার অপারেশনে এই মডেলটি খুবই কার্যকর। আর এ মডেলের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার মাধ্যমেই তুরস্ক উত্তর ইরাকের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতেও নিজেদের নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।

তুরস্কের সাম্প্রতিক এ সাফল্য শুরু হয় অপারেশ ক্ল দিয়ে। তুরস্কের সেনাদেরকে এই অপারেশনের আওতায় হেলিকপ্টার ও বিমান থেকে ভূমিতে অবতরণ কমানো হয়। এই সেনারা ভূমিতে অবস্থিত পিকেকে ক্যাম্প এবং গুহাগুলোতে গড়ে ওঠা তাদের ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। তুর্কি সেনারা সেখান থেকে চলে না এসে বরং পাহাড়গুলোর ওপরে বেশ কয়েকটি চেকপয়েন্ট স্থাপন করে। যখনই পিকেকের কোনো ঘাঁটি বা ক্যাম্পকে ধ্বংস করা সম্ভব হতো, এরপর তুর্কি সেনারা সেখানে চেকপয়েন্ট বসাতো।

এই চেকপয়েন্টের মাধ্যমে তুর্কি সেনারা পাহাড়জুড়ে একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। এ নেটওয়ার্কটি সরাসরি তুরস্কের মূল সামরিক ঘাঁটির সাথে সংযুক্ত ছিল। পাশাপাশি আকাশপথে নিয়মিত ড্রোনও ভাসমান ছিল।

তুর্কি সেনারা চেকপয়েন্ট ও ড্রোনের সহায়তায় পিকেকে সেনাদের যেকোনো গতিবিধি ও কার্যক্রমকে সরাসরি নজরদারি করার সুযোগ পায়। প্রতিটি চেকপয়েন্টে পর্যাপ্ত সেনাসদস্য ও সামরিক উপকরণ থাকায় পিকেকে সদস্যরা যখনই আশপাশে কোনো ক্যাম্প তৈরির চেষ্টা করেছে, চেকপয়েন্ট থেকেই তাদেরকে ধ্বংস করে দেয়া সম্ভব হয়। পাশাপাশি, পিকেকে সেনারা যেন সীমান্ত পার হয়ে কোনোক্রমেই তুরস্কে প্রবেশ করতে না পারে চেকপয়েন্টগুলো থেকে তাও নিশ্চিত করা হয়।

চেকপয়েন্ট কৌশলে ইরাক-তুরস্ক সীমান্তের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলো পিকেকে মুক্ত হয়। সম্প্রতি তুরস্ক আবার যে অভিযানগুলো পরিচালনা করছে তাতে নজর দেয়া হয়েছে মেতিনা ক্যাম্পের দক্ষিণ পাশে। তুরস্কের সেনারা সেখানেও চেকপয়েন্টের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। পাশাপাশি মেতিনাতেও ড্রোনের যাতায়াত এবং বিমান বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় করা হয়েছে।

এর ফলে বেশ কিছু সময় পিকেকে বিপর্যস্ত অবস্থায় পড়ে যায়। তারা না পারছিল চেকপয়েন্টগুলোতে বড় ধরনের কোনো হামলা চালাতে না পারছিল ইরাকী সীমান্ত অতিক্রম করে তুরস্কে প্রবেশ করতে। ফলে, পিকেকে সেনাদের হাতে সিরিয়ার টানেলগুলো ছাড়া তুরস্কে প্রবেশের আর কোনো রাস্তাও ছিল না।

যুদ্ধ বা সামরিক সংঘাতের সময় যদি লজিস্টিক সাপ্লাই লাইন ভালোভাবে তৈরি করা তাহলে এর ওপর ভর করে সামরিক বাহিনীর অভিযান পরিচালনাও অনেক সহজ হয়ে যায়। তুরস্ক এবার ইরাকের উত্তরাঞ্চল থেকে পিকেকে উৎখাত করার ক্ষেত্রে অনেকটা সফলতা পেয়েছে। এখন পিকেকে সেনারা আরো দক্ষিণের দিকে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে, সেখানেই তারা প্রশিক্ষন নিচ্ছে এবং ক্রমাগতভাবে তুরস্কে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করছে।

তুরস্ক সে সুযোগও খুব বেশি দিন দিবে বলে মনে হচ্ছে না। ধারনা করা হচ্ছে, তুরস্ক খুব শীঘ্রই গারা, কানদিল এবং সিনজার ক্যাম্পেও সামরিক অভিযান পরিচালনা শুরু করবে। সম্প্রতি তুরস্কের একজন বন্দী নাগরিকের মৃত্যুদন্ড কুর্দী সেনারা কার্যকর করে। এর পরপরই তুরস্কের সেনারা যেভাবে তাৎক্ষনিক উদ্ধার অভিযান চালিয়ে তুরস্কের ও ইরাকের বন্দী বেসামরিক নাগরিকদেরকে মুক্ত করেছে, তাতে ইরাকের আরো দক্ষিণে আশ্রয় নেয়া পিকেকে সেনাদের বিরুদ্ধেও তুরস্কের সম্ভাব্য সফলতার ধারনা পাওয়া গিয়েছে।

এই উদ্ধার ও অন্যান্য সামরিক অভিযান চালানোর সময় তুর্কি সেনারা পেসমারগার যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছে। লজিস্টিক সাপোর্টকে নিরবিচ্ছিন্ন রাখাও সম্ভব হয়েছিল।

পেসমারগা পিকেকের গতিবিধিতে নিয়ন্ত্রন আরোপ করেও তুরস্কের সেনাবাহিনীকে সহায়তা করার চেষ্টা করছে। কুর্দীদের এ অংশটির সাথে তুরস্কের এ সখ্যতা আগামীতে আরো বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। যার ভালো ফল পাবে তুরস্ক। কারণ চেকপয়েন্ট নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় এবং নেটওয়ার্ক সচল রাখার ক্ষেত্রে কুর্দী এ সংগঠনটির সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।

তুরস্কের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে বসবাসরত কুর্দী ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে থাকা কুর্দীদেরকে নিয়ে স্বায়ত্বশাসিত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৮৪ সাল থেকেই পিকেকে নানাভাবে তুরস্কের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ পরিচালনা করে আসছে। তখন থেকেই ইরাকের উত্তরাঞ্চলের পার্বত্য এলাকায় পিকেকে নিজেদের অস্থায়ী সদর দফতর ও শক্তিশালী কাঠামোও তৈরি করে।

অন্যদিকে, ইরাকে থাকা কুর্দীরাও পিকেকের উন্থান মেনে নিতে পারছেনা। কেননা ইরাকী কুর্দীরাও নিজেদেরকে কুর্দীদের একমাত্র ও সঠিক প্রতিনিধি হিসেবে দাবি করে। এ কারণে তারা পিকেকে দমনে তুরস্ককে সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছে। অন্যদিকে, তুরস্ক এ সমস্যা অনেকদিন থেকে মোকাবেলা করলেও নিজস্ব সক্ষমতা কম থাকায় ও আর্থিকভাবে অনগ্রসর হওয়ায় পিকেকের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের আমলে দেশটি সামরিক খাতে অভাবনীয় উন্নতি করার পর এবং প্রতিবেশি দেশগুলোতে কুটনৈতিক ও সামরিক সাফল্য পাওয়ার পিকেকের বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে। আর পিকেকের বিরুদ্ধে সাফল্য পাওয়ায় আভ্যন্তরিনভাবে এরদোয়ানের জনপ্রিয়তা অনেকটা বেড়েছে।