বড় ধরনের গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে মিয়ানমার


  • মোতালেব জামালী
  • ০৬ মে ২০২১, ১৬:২৩

মিয়ানমারের পরিস্থিতি ব্যাপক আকারের সঙ্ঘাতের দিকে এগিয়ে চলেছে। যা শেষ পর্যন্ত গৃহযুদ্ধে রূপ নিতে পারে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, মিয়ানমারের পরিস্থিতি শেষ পর্যন্ত সিরিয়ার মতোই হতে পারে। সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ সশস্ত্র প্রতিরোধের দিকে এগিয়ে চলেছে। সারা দেশে তা ছড়িয়ে পড়ছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু হয়। কঠোরভাবে সে বিক্ষোভ দমন করার চেষ্টা করছে জান্তা। সৈন্যদের গুলিতে নিহত হন কয়েকশ বিক্ষোভকারী ও পথচারী। গ্রেফতার করা হয় ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্র্যাসির নেত্রী অং সান সুচিসহ কয়েক হাজার মানুষকে। গ্রেফতার এড়াতে বাড়িঘর ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেন হাজার হাজার মানুষ।

১৯৯৮ সাল থেকে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনটি বড় ধরনের বিক্ষোভ-বিদ্রোহ সঙ্ঘটিত হয়েছে। অপরদিকে, দেশটির জাতিগত রাজ্যগুলোতে গত ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ ও সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘাত চলছে। এখন এই সঙ্ঘাত গ্রামাঞ্চল থেকে নগরগুলোতেও বিস্তার লাভ করেছে। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থানে সামরিক বাহিনীর টার্গেটে হামলা করছে বিদ্রোহীরা।

এই হামলার দায়িত্ব কেউ স্বীকার করেনি। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করেন, জাতিগত বিদ্রোহী গ্রুপ ও শহুরে গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভকারীদের মিলিত প্রচেষ্টায় এ ধরনের হামলা চালানো সম্ভব হয়েছে। তারা ধারণা করছেন, সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো বিস্ফোরক সরবরাহ করেছে এবং শহুরে বিক্ষোভকারিরা স্থানীয় পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত থাকায় তারা সহজেই তা ব্যবহর করতে পেরেছে।

যদি এই ধারণা সঠিক হয় এবং হামলাটি বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা না হয় তাহলে ধরে নিতে হবে, মিয়ানমারে প্রত্যন্ত অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে স্বল্প পরিসরে যে গৃহযুদ্ধ চলে আসছে তা নতুন রূপ পেতে যাচ্ছে। জাতিগত সংখ্যালঘু এলাকা থেকে দেশের বড় বড় শহর ও নগরেও ছড়িয়ে পড়ছে। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারের কাছ থেকে জেনারেলরা ক্ষমতা দখলের পর সারাদেশে যে বিক্ষোভ শুরু হয়। তা দমনের সময় সেনাবাহিনী ও পুলিশের গুলিতে ৭৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৪ হাজারের বেশি মানুষকে। কিন্তু এরপরও মানুষ সাহস নিয়ে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আসছে। সেনাবাহিনীর অন্যায়ভাবে ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে চলমান এই প্রতিরোধ আন্দোলনকে আধুনিক এশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে অসফল একটি ক্যু হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এটি জান্তা সরকারের প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর জন্য একটি বড় ধাক্কা। আন্তর্জাতিক নিন্দা ও সমালোচনাকে অগ্রাহ্য করে তিনি ক্ষমতা ধরে রাখাছেন। মিয়ানমারকে বহির্বিশ^ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। এ পরিস্থিতিতে পূর্ববর্তী জান্তা সরকারের কর্মকর্তারা জেনারেল মিন অং হ্লাইং এর ব্যাপারে দিন দিন হতাশ হয়ে পড়ছেন। তারা তার একমুখী কর্মকাণ্ড ও কৌশলের জন্য তাকে একজন অকার্যকর ব্যক্তি হিসেবেও বিবেচনা করছেন।

তিন মাস আগে ক্ষমতা দখলের সময় সেনাবাহিনী এনএলডি নেত্রী অং সান সুচিসহ অনেক নির্বাচিত এমপি ও দলীয় নেতাকে গ্রেফতার করে। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এখন মিয়ানমারের রাজধনী নেইপিডোসহ দেশটির মধ্যাঞ্চলে সশস্ত্র বাহিনীর অবস্থানে বিদ্রোহীদের হামলা শুরু হয়েছে যা আগে কখনোই দেখা যায়নি। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে, গহযুদ্ধ এখন দেশটির কেন্দ্র এসে পৌছেছে।

বিদ্রোহীরা দেশটির মধ্যাঞ্চলের মাগবি ও মেইকটিলায় বিমানবাহিনীর ঘাটিতে রকেট হামলা চালায়। এছাড়া সাবেক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের ৭০ কিলোমিটার উত্তরে বাগো সিটির কাছে সেনাবাহিনীর একটি অস্ত্রাগারে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। থাইল্যান্ড সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও কারেন ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি বা কেএনএলএ র মধ্যে প্রচন্ড গুলি বিনিময়ের পর এসব হামলার ঘটনা ঘটে।

অন্যদিকে দেশের উত্তরাঞ্চলে জাতিগত বিদ্রোহী গ্রুপ কাচিন ইনডিপেন্ডেন্স আর্মি বা কেআইএ ও সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রচণ্ড গুলি বিনিময়ের পর বিমানবাহিনীর ঘাটিতে হামলার ঘটনা ঘটে। বিক্ষোভ দমনে সেনাবাহিনী শহরাঞ্চলে ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করার পর গণতন্ত্রপন্থি অনেক নেতাকর্মী দেশের উত্তরাঞ্চলের কাচিন রাজ্যের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বিদ্রোহীদের সাথে গুলি বিনিময়ের সময় তাদের সম্ভাব্য অবস্থানে বিমান হামলা চালায় সেনাবাহিনী। এসময় বেশ কিছু গ্রামেও বোমা বর্ষণ করা হয়। এতে কাচিন রাজ্যে ৫ হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। এর আগে এই এলাকায় দু’পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময়ের সময় হাজার হাজার মানুষ তাদর বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

দেশটির বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৮৮ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পরের পরিস্থিতির সাথে তুলনা করছেন। এ সময় জান্তা সরকার সারা দেশে সহিংস পন্থায় গণতন্ত্রপন্থি বিক্ষোভ দমন শুরু করলে শত শত বিরোধী নেতাকর্মী পালিয়ে গিয়ে বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এ সময় তরুণ-যুবক বিক্ষোভকারিরা অল বার্মা ষ্টডেন্টস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা এবিএসডিএফ গঠন করে ও ইউনিফর্ম পরে সীমান্ত এলাকায় জাতিগত বিদ্রোহীদের সাথে মিলে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।

সে সময় থাইল্যান্ডের চোরাই বাজার থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা খুব সহজ ছিল। সেময় সরকার বিরোধীরা প্রতিবেশি থাইল্যান্ডে সহজেই আশ্রয় পেতো। এমনকি অফিসও খুলতে পারতো। এখন থাই ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সুসম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে কোভিড-১৯ এর কারণে মিয়ানমার থেকে থাইল্যান্ডে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ কারণে সশস্ত্র বিদ্রোহী ও সরকার বিরোধী বিক্ষোভকারিদেরকে মিয়ানমার সীমান্তের ভেতরে থেকে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে।

জান্তাবিরোধী বিক্ষোভকারীরা নিজেদের শহরে অবস্থান করেই সরকারকে পাল্টা আঘাত করার কৌশল বেছে নিয়েছেন। সামরিক স্থাপনায় হামলা তারই ইঙ্গিত বহন করে। এটা আসলে শহুরে গেরিলা যুদ্ধেরই কৌশল। এখানে গণতন্ত্রপন্থি শহুরে বিক্ষোভকারি ও রাজ্যভিত্তিক জাতিগত সশস্ত্র বিদ্রোহীদের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপিত হয়েছে। তাতমাদো নামে পরিচিত সেনাবাহিনী এই বিক্ষোভ মোকাবেলা করতে কতটুকু সক্ষম হয় তা দেখার বিষয়। সাগাইং অঞ্চল এবং রচিন রাজ্যে ইতিমধ্যে স্থানীয় প্রতিরোধ যোদ্ধা বাহিনীর উদ্ভব ঘটেছে। মন রাজ্য এবং মান্দালয় অঞ্চলেও একই ধরনের বাহিনী তৈরির প্রস্তুতি চলছে।

প্রতিরোধ যোদ্ধা বাহিনী হান্টিং রাইফেল ও নিজেদের তৈরি বিস্ফোরক দিয়ে হামলা চালাচ্ছে। এতে সেনাবাহিনী ও পুলিশের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতিও হচ্ছে। নিকটবর্তী চিন রাজ্যে গঠিত চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স নামের একটি বাহিনী সেখানে জান্তা সরকারের ১৫ জন সৈন্যকে হত্যা করেছে। এছাড়া ইয়াঙ্গুন, মান্দালয় ও মোনেওয়া এলাকায় প্রতিরোধ যোদ্ধারা পুলিশের ব্যারাকে বোমা ও মলোটভ ককটেল হামলা করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গড়ে উঠা এসব প্রতিরোধ যোদ্ধাদের মোকাবেলার পাশাপাশি জান্তা সরকারকে বিভিন্ন রাজ্যে আগে থেকে গড়ে উঠা সশস্ত্র বিদ্রোহী বাহিনীকেও মোকাবেলা করতে হচ্ছে।

কাচিন বিদ্রোহীরা সম্প্রতি চীন সীমান্তে কৌশলগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ আলাভূম পর্বতের কাছে সেনাবাহিনীর একটি চৌকি দখল করে নেয়। এর পর থেকে সেখানে দু’পক্ষের মধ্যে ৫০ বারেরও বেশি সঙ্ঘর্ষ হয়েছে। জান্তা সরকার বিমান হামলা চালিয়েও কেআইএ গেরিলাদের সেখান থেকে সরাতে পারেনি। বরং গেরিলারা কাচিন রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলসহ নিকটবর্তী অন্যান্য এলাকাতেও হামলা চালিয়ে যাচ্ছে।

কেএনএলএ এবং কেআইএ প্রকাশ্যেই বর্তমান জান্তা সরকারবিরোধী বিক্ষোভ কর্মসূচীর সাথে সংহতি জানিয়েছে। অবশ্য গেরিলা গ্রুপগুলো এখনো নীরব রয়েছে। রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শান স্টেট রেস্টোরেশন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ইয়াভদ শার্ক বলেছেন, জান্তা সরকার যদি বিক্ষোভকারিদেরকে হত্যা করা অব্যাহত রাখে তাহলে তার বাহিনী চুপ করে বসে থাকবেনা। যদিও তাদের কোন তৎপরতা এখনো চোখে পড়েনি।

মিয়ানমারের সবচেয়ে শক্তিশালী গেরিলা গ্রুপ হচ্ছে ইউনাইটেড ওয়া ষ্টেট আর্মি যাদের ২০ হাজার থেকে ৩০ হাজার যোদ্ধা রয়েছে। কিন্তু সন্দেহজনকভাবে গ্রুপটি সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখলের পর থেকেই চুপ রয়েছে। এই গ্রুপটির সাথে চীনের নিরাপত্তা বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। চীন চাইছে না এই গ্রুপটি জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে চলমান আন্দোলনে যোগ দিক। এ কারণে বিক্ষোভকারিরা ইয়াঙ্গুনে বেশ কয়েকটি চীনা কারখানা আগুন দিয়ে জ¦ালিয়ে দিয়েছে।

মিয়ানমারের প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা মিন কো নাইং সম্প্রতি রেডিও ফ্রি এশিয়াকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, জান্তা বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদেরকে দেশের দক্ষিন-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জাতিগত গেরিলা বাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গিয়ে সেখানে মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলতে হবে। সেখানে অবস্থান করে তাদেরকে গেরিলাদের সাথে মিলে সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। যারা এখনো শহরে অবস্থান করছেন তারা সেনাবাহিনী ও পুলিশের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন। এর মাধ্যমে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, মিয়ানমারে ইতিমধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। অদূর ভবিষ্যতেই তা আরও ব্যাপক আকার ধারণ করতে পারে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।