আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তিন বুড়োর লড়াই

-

  • ইলিয়াস হোসেন
  • ০৪ মে ২০২১, ১৭:০৮

বিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় নজিরবিহীন তৎপরতা শুরু করেছেন তিনটি সুপারপাওয়ার দেশের তিন প্রবীণ প্রেসিডেন্ট। তারা হলেন- যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তবে যুদ্ধটা কিন্তু ত্রিমুখী নয়, দ্বিমুখী। এর একদিকে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যদিকে চীন ও রাশিয়ার জোট। বার্তা সংস্থা এপি ও নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে একবিংশ শতাব্দীর মোড় ঘোরানো এই লড়াইয়ের গতিধারা।

সাংবিধানিকভাবে আজীবনের জন্য প্রেসিডেন্ট নন চীনের প্রেসিডেন্ট জিনপিং এবং রাশিয়ার নেতা পুতিন। কিন্তু বাস্তবে তারা কবে ক্ষমতা ছাড়বেন তা কেউ বলতে পারে না। ধারণা করা হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে বিশ্বমঞ্চে হাজির থাকবেন এই দুই নেতা।

এই দুই সুপারপাওয়ার একজোট হয়ে চলতি শতাব্দীর ভূরাজনীতির গতিধারা নির্ধারণ করতে চান। বাস্তবতা হচ্ছে প্রতিবছরই তাদের ক্ষমতা বেড়েই চলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করেই তারা এগিয়ে যেতে চান। যুক্তরাষ্ট্রে কোনো প্রেসিডেন্ট সর্বোচ্চ আট বছর ক্ষমতায় থাকতে পারেন। ফলে দেশটির বিদেশ নীতি যে কোনো সময় বদলে যেতে পারে। বিপরীতে পুতিন ও জিনপিং দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছেন।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট সম্প্রতি যে আইনে সই করেছেন তাতে তিনি ২০৩৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে পারবেন। তার বয়স এখন ৬৮ বছর। দুই দশকের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছেন তিনি। সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্টালিনের পর পুতিনই দেশটির সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী শাসক। ভিন্নমত দমন করেই টিকে আছেন তিনি। অবশ্য তিনি জনগণের বিশাল অংশের কাছে জনপ্রিয়।

অন্যদিকে চীনের প্রেসিডেন্ট জিনপিংয়ের বয়স এখন ৬৭ বছর। ২০১২ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন তিনি। দেশটিতে নিবর্তনমূলক নানা ব্যবস্থা আগে থেকেই ছিল। জিনপিং তাকে আরও কঠোর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। মাও সেতুংয়ের মাধ্যমে চীনে কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত সাত দশকের মধ্যে জিনপিংই দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতায় পরিণত হয়েছেন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও চীন এখন একটি একটি বড় শক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিপক্ষ। অর্থনৈতিক ও সামরিক দিকে থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে রয়েছে চীন।

জিনপিংও কঠোরহস্তে দেশ শাসন করছেন। ভিন্নমত দমন তো আছেই, হংকংয়ের স্বায়ত্বশাসন তিনি কেড়ে নিয়েছেন। জিনজিয়াংয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চলছে গণহত্যা। তাইওয়ানের স্বাধীনতাকেও হুমকিতে ফেলেছেন জিনপিং। নিজ দলের ভিন্নমতাবলম্বীদের দমনে তিনি দুর্নীতি দমন অভিযানকে ব্যবহার করছেন।

জিনপিংয়ের ক্ষমতার মেয়াদের সীমা তুলে দেওয়া হয়েছে। এবং তার দৃশ্যত কোনো উত্তরসূরী নেই। ফলে তিনি বহুদিন চীন শাসন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে। নিজ দলের প্রতিপক্ষকে তিনি দুর্নীতির অভিযোগে জেলে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

এদিকে পুতিন তার প্রধান সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনিকে কারাবন্দি করে রেখেছেন। তাকে আড়াই বছরের জেল দেওয়া হয়েছে। ফলে জিনপিং এবং পুতিন অনেকটা নির্বিঘ্নেই দেশ চালাতে পারবেন বলে মনে করা হচ্ছে। অবশ্য অভ্যন্তরীণভাবে তাদেরকে নানা সমস্যা মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

পাশ্চাত্যকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে জিনপিং ও পুতিন দেশবাসীর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে উসকে দেওয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। ২০১৪ সালে পুতিন ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া দখল করলে তান জনসমর্থন ৯০ শতাংশে পৌঁছায়। এরপর অবশ্য অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সেটা কমেছে।

পুতিন ও জিনপিংয়ের এই দীর্ঘস্থায়ী শাসনের প্রভাব শুধু তাদেও নিজ দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে না। এতে ভূরাজনীতির ভারসাম্য নানাভাবেই বদলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের নির্বাচনে নাক গলানোর অভিযোগে রয়েছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। এসব দেশের সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক স্নায়ুযুদ্ধের পর সবচেয়ে খারাপ যাচ্ছে। এ অবস্থায় পুতিন চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরো গভীর করে তুলছেন। অপরদিকে জিনজিয়াং, হংকং এবং দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে পাশ্চাত্যের সঙ্গে চীনের সম্পর্কও তলানিতে ঠেকেছে।

৭৮ বছর বয়সী জো বাইডেন পুতিন ও জিনপিং উভয় নেতার বিরুদ্ধেই কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তিনি নজিরবিহীনভাবে পুতিনকে খুনী বলে মন্তব্য করেছেন। বেইজিংকে কোণঠাসা করতেও নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রভাবশালী সংস্থা ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে চীনই এখন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ এবং দেশটির জাতীয় নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বৃহত্তম হুমকি। বস্তুত বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির প্রধান স্তম্ভ হবে চীনের উত্থান ঠেকানো।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাইডেনের নীতি চীন ও রাশিয়ার ঐক্য আরও সুদৃঢ় করতে পারে। ইতিমধ্যেই মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে এক ধরনের সমঝোতায় পৌঁছেছে বেইজিং ও মস্কো। যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তার সুযোগে দুই দেশ মধ্যপ্রাচ্যে বড় খেলোয়াড় হতে চায়। আগে রাশিয়া এক্ষেত্রে কিছুটা এগিয়ে থাকলেও পিছিয়ে ছিল চীন। কিন্তু সাম্প্রতিক দিনগুলোতে চীন মধ্যপ্রাচ্য-কেন্দ্রিক তৎপরতা কয়েকগুণ জোরদার করেছে। ইরানের সঙ্গে চীনের ৪০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চুক্তি এবং তুরস্কের সঙ্গে বোঝাপড়া এরই অংশ।

পুতিন ও জিনপিং ব্যক্তিগত পর্যায়েও দৃঢ় বন্ধুত্ব গড়ে তুলেছেন। কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হলেও এক সময় চীন ও রাশিয়ার মধ্যে বৈরিতা ছিল। এখন পাশ্চাত্যের প্রভাব খর্ব করতে দুই দেশই একজোট।

সামরিক দিক থেকেও দুই দেশ সহযোগিতার বন্ধনকে দৃঢ় করে চলেছে। দুই দেশ এর আগে সামরিক জোট গঠনের সম্ভাবনা নাকচ করে দিলেও এখন সেটা সম্ভব বলেই মনে করা হচ্ছে। পুতিন ইতোমধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন, এ ধরনের জোটের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চীন ও রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি যৌথ মহড়ায় অংশ নিয়েছে। পুতিনই জানিয়েছেন যে চীনকে সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সামরিক সহায়তা দিয়েছে রাশিয়া।

প্রেসিডেন্ট বাইডেন চীনের মোকাবিলায় চাচ্ছেন গণতান্ত্রিক দেশগুলোর ঐক্য। বিপরীতে চীনও নিজস্ব বলয় গড়ার চেষ্টা জোরদার করেছে। যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে জোট গড়তে চায়। কিন্তু এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে চায় চীন। যুক্তরাষ্ট্র যত চীনকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে বেইজিং ততই বিশ্বনেতা হওয়ার জন্য আরও মরিয়া হয়ে উঠছে।

ফলে বিশ্ব এখন আবার দুটি আদর্শিক ধারায় বিভক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বন্ধুরাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। পুতিনকে খুনি বলার পর জিনপিংকেও পরোক্ষভাবে স্বৈরশাসক বলে নিন্দা করেছেন বাইডেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, একবিংশ শতাব্দীতে গণতান্ত্রিক ও স্বৈরতান্ত্রিক দেশগুলোর লড়াই হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনার জবাবে চীন এখন জাতিসংঘের মত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। এতে চীন অনেকাংশে সফলও হয়েছে। জিনজিয়াংয়ে মুসলিম গণহত্যা নিয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে চীনের পদক্ষেপের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে ৮০টি দেশ। এর মধ্যে প্রভাবশালী অনেক মুসলিম দেশও রয়েছে। এমনকি সৌদি আরবও বিভিন্ন সময় চীনের পক্ষ নিয়েছে ।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক খাতে সম্পর্ক দৃঢ় করেছে চীন ও রাশিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের বিপরীতে দুই দেশের মৈত্রির বন্ধন এতোটাই গভীর হয়েছে যে কিছুদিন আগে তারা ঘোষণা দিয়েছে যে চাঁদে তারা যৌথভাবে গবেষণা স্টেশন করবে। এতে বোঝা যাচ্ছে, মহাকাশ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চায় চীন।

চীন ও রাশিয়া প্রায় অভিন্ন ভাষায় যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র মানবাধিকারের প্রসঙ্গ তুললেই চীন ও রাশিয়ার কর্মকর্তারা খোটা দেন যে ইরাক, আফগানিস্তান ও লিবিয়ায় সাম্প্রতিক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার চেতনা কোথায় ছিল? যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদ সংকটেরও সমালোচনা করে থাকে চীন।

তবে চীনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য পেয়েছেন বাইডেন। জিনজিয়াংয়ে চীনের গণহত্যার বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন একযোগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে এবং বেইজিংয়ের আচরণের নিন্দা জানিয়েছে। বিপরীতে চীনও এসব দেশ ও জোটের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

চীনের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারত, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও তাইওয়ানের প্রচণ্ড বিরোধ রয়েছে। ভারতের সঙ্গে স্থলসীমান্ত এবং অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে এই বিরোধ। একে কাজে লাগিয়ে চীনকে কোণঠাসা করতে চায় ওয়াশিংটন। বাইডেন চীনের বিরুদ্ধে জাপানকেও ব্যবহার করতে চান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈশ্বিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তিন প্রবীণ রাষ্ট্রনেতার এই তৎপরতায় বিশ্বে আবারও শীতল যুদ্ধ দেখা যেতে পারে। এতে বাড়তে পারে সঙ্ঘাত ও উত্তেজনা।