‘ভারতে করোনায় মৃত্যু সরকারি হিসাবের ৩০ গুণ বেশি’


  • মেহেদী হাসান
  • ০৪ মে ২০২১, ১৬:৫১

ভারতের কোভিড পরিস্থিতি নিয়ে খ্যাতিমান লেখিকা অরুন্ধতী রায় একটি নিবন্ধ লিখেছেন ব্রিটেনের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায়। তার এই লেখা নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে তুমুল আলোচনা। যেখানে ভারতের করোনা পরিস্থিতির করুণ ও হৃদয়বিদারক চিত্র ফুটে উঠেছে, তিনি তুলে ধরেছেন সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতার নানা দিক। তিনি বলেছেন, ভারতে করোনায় মৃত্যুর প্রকৃত সংখ্যা সরকারি হিসেবের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি হবে।

অরুন্ধতী রায় ভারতের বর্তমান করোনা দুর্যোগের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার সরকারের তীব্র সমালোচনা করেছেন। মোদি সরকারকে একটি ব্যর্থ সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করে করোনায় অগণিত মানুষের জন্য অরুন্ধতী সরকারের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছেন।

অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, যে বিশৃঙ্খলা, অসম্মান আর মানসিক আঘাতের শিকার জনগণ হচ্ছে, তা কোনো ঘটনার বিবরণ দিয়ে বোঝানো সম্ভব নয়। ছোট ছোট শহরের শ্মশান এবং কবরস্থানে লাশ পোড়ানো এবং দাফনের যে পরিসংখ্যান, সে অনুসারে করোনায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা সরকারি হিসেবের চেয়ে ৩০ গুণ বেশি।

তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, রাজধানী দিল্লি যদি ভেঙ্গে পড়ে তাহলে বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশের গ্রামের অবস্থা কী? তিনি লিখেছেন, ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশে একটি নির্বাচনী জনসভায় বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি। উত্তর প্রদেশে তখন বিরোধী দলের সরকার। মোদি অভিযোগ করেন রাজ্য সরকার মুসলানদের মন জয় করার জন্য হিন্দুদের শ্মশানের তুলনায় মুসলমানদের কবরস্থানে বেশি অর্থ খরচ করছেন। উপস্থিত বিপুল জনতাকে আলোড়িত করতে মোদি বলেন, কোনো গ্রামে যদি একটি কবরস্থান তৈরি করা হয় তাহলে সেখানে একটি শ্মশানও তৈরি করতে হবে। মন্ত্রমুগ্ধ জনতা শ্মশান শ্মশান বলে ধ্বনি তোলে।

ভারতের শ্মশানের গণচিতার অগ্নি শিখার ভূতুড়ে ছবি এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছে। এটি দেখে মোদি নিশ্চয়ই এখন অনেক খুশী।

ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে করোনা যখন চরম পর্যায়ে তখন চলতি বছর জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বক্তব্য রাখেন ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামে। তাদের প্রতি সহানভূতি জানিয়ে মোদি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। তার দীর্ঘ বক্তব্য জুড়ে ছিল কেবল ভারতের স্বাস্থ্য অবকাঠামো আর কোভিড-১৯ এর প্রস্তুতি নিয়ে গর্ব।

ওয়ার্ল্ড ইকনোমিক ফোরামে মোদি বলেন, বন্ধুরা, এই আশঙ্কার সময় আমি ১৩০ কোটি ভারতীয়দের পক্ষ থেকে আত্মবিশ্বাস, ইতিবাচকতা এবং আশার বাণী নিয়ে এসেছি। বলা হয়েছিল করোনায় বিশ্বের মধ্যে ভারত হবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত দেশ। বলা হয়েছিল, এখানে করোনা সুনামী হবে। কেউ কেউ বলেছিল ৭০ থেকে ৮০ কোটি ভারতীয় করোনায় আক্রান্ত হবে। আবার অনেকে বলেছিল ২০ লাখ মারা যাবে এখানে।

মোদি বলেছিলেন, বন্ধুরা, ভারতের সফলতা অন্য দেশের সাথে বিচার করা ঠিক হবে না। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার ১৮ ভাগ বাস করে ভারতে। সেই ভারত করোনাকে কার্যকরভাবে ঠেকিয়ে দিয়ে মানবতাকে একটি বড় বিপর্যয় থেকে রক্ষা করেছে।

অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, এখন যা সামনে এসেছে তা হলো মোদি করোনা ঠেকাতে পারেননি। বিশ্ব এখন ভারতকে এমনভাবে দেখছে , আমরা যেন তেজস্ক্রিয়। আমাদের জন্য অন্য দেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। যাতে আমাদের ভাইরাস এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে। একই সাথে আমাদের সিলমোহর করা হচ্ছে বিজ্ঞান বিরোধী চিন্তা, ঘৃণা, মুর্খতাসহ সব ধরনের অসুস্থতা। যা প্রধানমন্ত্রী , তার দল এবং তাদের ব্র্যান্ড ধারণ করে।

অরুন্ধতী লিখেছেন, গত বছর যখন করোনার প্রথম ঢেউ আসে এবং পরে তা অনেকটা কমে যায় তখন সরকার এবং তার তল্পিবাহক গোষ্ঠী উদ্বাহু নৃত্য শুরু করে। তারা বিজয় উল্লাস করে কারণ তখনো করোনায় মৃতদেহে ভরে যায়নি ড্রেনগুলো। হাসপাতালগুলো পৌছায়নি ধারণ ক্ষমতার বাইরে। আর চিতা আর দাফনের জন্য শ্মশান এবং কবরস্থানেরও সঙ্কট দেখা দেয়নি।

অরুন্ধতী রায় বলছেন, এরকমটি যে হতে পারে তা আগেই বলা হয়েছিল। তিনি প্রশ্ন করেন কোথায় গেল কোভিড ঠেকানোর অবকাঠামো আর জনসচেতনতা যা নিয়ে মোদি গর্ব করেছিলেন?

হাসপাতালে বেড নেই। অনেক পরিচিত ফোন করে জানিয়েছেন ওয়ার্ডে স্টাফ নেই। সেখানে জীবিতদের চেয়ে মৃত বা মৃতপ্রায় রোগীদের সংখ্যা বেশি। মানুষ মারা যাচ্ছে হাসপাতালের করিডোরে, রাস্তায় এবং বাড়িতে। শ্মশানে কাঠ নেই। বন বিভাগ বিশেষ অনুমতি দিয়েছে শহরের গাছ কাটার। পার্ক আর গাড়ি রাখার জায়গা পরিণত করা হয়ছে শ্মশানে।

মনে হচ্ছে অদৃশ্য এক ইউএফও এসেছে আমাদের আকাশে। আমাদের ফুসফুস থেকে বাতাস শুষে নিচ্ছে। এ এমন এক আকাশ অভিযান যা আমরা আগে কখনও জানতাম না।

মুক্তবাজার পৌঁছে গিয়েছে তার তলানিতে। হাসপাতালের মরচুয়ারিতে ব্যাগভর্তি ঠাসা লাশের স্তূপে প্রিয়জনের চেহারা শেষবারের মতো দেখার জন্য আছে ঘুষের ব্যবস্থা। আর যে সব পুরোহিত রাজি হন শেষ প্রার্থনায়, তাদের জন্য আছে অতিরিক্ত পেমেন্ট। নিষ্ঠুর ডাক্তারদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো পরিবার দ্বারস্থ হচ্ছেন অনলাইন চিকিৎসা পরামর্শে। আর প্রাইভেট হাসপাতালের চিকিৎসার খরচ মেটাতে অনেককে বিক্রি করতে হচ্ছে জমি, বাড়ি সব কিছু।

অরুন্ধতী রায় গার্ডিয়ানের নিবন্ধে লিখেছেন, অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে রোগী মারা যাচ্ছে। যোগী আদিত্যনাথের সারথী উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী অজয় মোহন ঘোষণা দিয়েছেন তার রাজ্যে হাসপাতালে কোনো অক্সিজেন সঙ্কট নেই। কেউ গুজব ছড়ালে জামিন অযোগ্য জাতীয় নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হবে। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে। উত্তর প্রদেশে বসবাস মানে অভিযোগ ছাড়া আপনি মরে যান, তাহলে আপনি আপনার জন্য ভাল করবেন।

অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, অভিযোগকারীদের প্রতি হুমকি শুধু উত্তর প্রদেশে সীমাবদ্ধ নয়। ফ্যাসিবাদী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ বা আরএসএসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ভারত বিরোধী গোষ্ঠী সঙ্কটকে ব্যবহার করবে অবিশ্বাস আর নেতিবাচক উসকানির কাজে। তিনি গণমাধ্যমকে আহবান জানিয়েছেন, ইতিবাচক ভূমিকা পালনের জন্য। টুইটার তাদের সাহায্য করছে সরকার বিরোধীদের একাউন্ট নিষ্ক্রিয় করে। মোদিসহ তার কেবিনেটের কয়েকজন সদস্য আরএসএসের সদস্য।

অরুন্ধতী রায় লিখেছেন, রাজধানী দিল্লি যদি ভেঙ্গে পড়ে তাহলে বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশের গ্রামের অবস্থা কী? ২০২০ সালে মোদির দেশব্যাপী লকডাউনের কারনে কোটি কোটি শ্রমিক শহর থেকে ভাইরাস নিয়ে তাদের পরিবারের কাছে ফিরেছে।

বিশ্বের সবচেয়ে কঠিনতম লকডাউন ছিল সেটি যা মাত্র ৪ ঘন্টা সময় হাতে রেখে ঘোষণা করা হয়েছিল। অনেকে কোনো খদ্য নিরাপত্তা, আর্থিক সহায়তা, আয় রোজগার ছাড়া পরিবহনের অভাবে আটকে পড়েছিল বিভিন্ন শহরে। তারা এখনো বহন করছে সেই মানসিক আঘাত।

গত বছর ভারতে করোনার মধ্যে তাবলীগ জামায়াতের একটি কর্মসূচীর বিরুদ্ধে ভারতীয় গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহল ব্যাপক প্রতিক্রিয়া এবং প্রচারনা চালায়। তাদেরকে করোনা জিহাদী আখ্যায়িত করা হয়। কিন্তু এবছর রাষ্ট্রীয় মদদে মাসব্যাপী কুম্ভ মেলা আর গঙ্গাস্নানের মাধ্যমে করোনা ছড়ানোকে করোনা জিহাদী বলে আখ্যায়িত করেনি মিডিয়া। তাদেরকে মানবাতাবিরোধী অপারাধীও বলেনি মিডিয়া।

অরুন্ধতী রায় লিখেছেন পশ্চিমবঙ্গ একটি ছোট রাজ্য এবং একদিনে এখানে ভোট হতে পারত। অতীতে এটি হয়েছে। কিন্তু যেহেতু এটি বিজেপির জন্য নতুন রাজ্য তাই তারা মাসব্যাপী ভোটের আয়োজন করেছে। যাতে এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় বিজেপির ক্যাডার বাহিনী পাঠানোর জন্য । ১৭ এপ্রিল একদিনে যখন ভারতে ২ লাখের বেশি করোনায় আক্রান্ত তখনো বিজেপির তারকারা মাস্ক খুলে মাস্কখোলা জনতার উদ্দেশে ভাষন দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নিজেও মাস্ক খুলে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। আর ভোট শেষে এখন পশ্চিম বঙ্গে আসছে করেনার নতুন ধরন বেঙ্গল স্ট্রেন।

যারা এখনো বলে ভারতে সিস্টেম ভেঙ্গে পড়েনি তাদের উদ্দেশে অরুন্ধতী রায় লিখেছেন আসলে সিস্টেম তেমন ছিলই না। সামান্য যা মেডিকেল অবকাঠামো ছিল তা কংগ্রেস এবং বর্তমান সরকার মিলে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে ভারত জিডিপির ১ দশমিক দুই পাঁচ ভাগ খরচ করে এবং এটি বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর সমান। আর মারাত্মক এই দরিদ্র দেশের করুন চিত্র হলো শহরের ৭৮ ভাগ এবং গ্রামের ৭১ ভাগ হেলথ কেয়ার সিস্টেম প্রাইভেট খাতে। এ তথ্য ২০১৬ সালের ল্যনসেটের স্টাডি রিপোর্টের। ভারতে এভাবে স্বাস্থ্য খাতকে বেসরকারিকরণ একটি অপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন অরুন্ধতী রায়।

তিনি লিখেছেন, সিস্টেম ভেঙ্গে পড়েনি। সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ব্যর্থ কথাটাও সঠিক নয়। কারন আমরা যা দেখছি তা অপরাধমূলক অবহেলা নয়, বরং রীতিমত মানবতাবিরোধী অপরাধ।

ভাইরাস বিশেষজ্ঞদের মতে, ভারতে দৈনিক আক্রান্তের সংখ্যা ৫ লাখের বেশি হবে। আসছে মাস গুলোতে অনেক মৃত্যুর ঘটনা ঘটবে। অরুন্ধতী রায় লিখেছেন আমরা বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি প্রতিদিন প্রত্যেকের সাথে কথা বলার। আমরা কথা বলি তাদের সাথে যাদের ভালোবাসা প্রকাশ পায় অশ্রুতে। আমরা জানি না আমাদের সাথে তাদের আর দেখা হবে কি না। আমরা জানি না সামনে কি ভয়বহতা আর অপমান অপেক্ষা করছে।

অরুন্ধতী রায় তার নিবন্ধের শেষে লিখেছেন, এ সরকার সমস্যা থেকে আমাদের বের করে আনতে অক্ষম। কারণ এ সরকারে সমস্ত সিদ্ধান্ত নেন একজন বিপজ্জনক ব্যক্তি। তিনি খুব বেশি মেধাবীও নয়।