প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের সম্পর্ক কেমন হবে বা কেমন হওয়া উচিত, তা নিয়ে ভারতের বিশ্লেষকরাই নানা মতামত প্রকাশ করছেন। কিছু বিশ্লেষকের মতে, বিশ্বের বৃহৎ দুটি গণতান্ত্রিক দেশ হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে ‘বিশ্বাসের ঘাটতি’ অনেক আগে থেকেই চলে আসছে। এ কারণে দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কখনও গড়ে ওঠেনি। এরপরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অনেকটাই সামনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময় দুই দেশের সম্পর্ক নানা ধরনের টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে চলছে। ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে নয়, বরং ভারতের উচিত হবে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সাথে সুসম্পর্ক তৈরি করা।
ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে ভারতকে খুব সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে । দুই দেশের সম্পর্ক নিয়ে এরইমধ্যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে। ভারতে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে করোনার ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল জরুরি ভিত্তিতে ভারতকে দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের উচিত ছিল। কিন্তু বাইডেন প্রশাসন তা করেনি। বরং তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগেছে যে, ভারতকে এসব মালামাল দেওয়া উচিত হবে কিনা। এজন্য দীর্ঘ সময় চলে গেছে। এ সময়ের মধ্যে ভারতে করোনা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে। লাশের স্তূপ জমছে। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে ভ্যাকসিন উৎপাদনের প্রয়োজনীয় মালামাল দিতে সম্মত হয়েছে। বাইডেন প্রশাসনের এই বিলম্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্বাভাবিক নয় বলে মনে করেন এসব বিশ্লেষক।
দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক আরেকটি ঘটনার ঘটনার কথা তারা সামনে টেনে আনছেন। যা ভারতের জন্য অত্যন্ত অবমাননাকর। গত ৭ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের গাইডেড মিসাইলবাহী ডেষ্ট্রয়ার ইউএসএস জন পল জোনস ভারত মহাসাগরে ভারতের এক্সক্লুসিভ ইকোনোমিক জোনে প্রবেশ করে। এ নিয়ে ভারতকে আগে থেকে কোন কিছই জানানো হয়নি। এটা ভারতের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের চরম অবজ্ঞার বহি:প্রকাশ বলে মনে করছেন এসব বিশ্লেষক। এ ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর সপ্তম নৌবহরের কমান্ডারের পক্ষ থেকে যে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছে তা নিয়েও ভারত ক্ষুদ্ধ।
মার্কিন কমান্ডারের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ভারতের লাক্ষাদ্বীপ থেকে ১৩০ নটিক্যাল মাইল পশ্চিমে ইউএসএস জন পল জোনস অভিযান পরিচালনা করেছে। ভারতের অতিরিক্ত সমুদ্রসীমার দাবি চ্যালেঞ্জ করতে এবং আন্তর্জাতিক আইন মেনে ‘ফ্রিডম অব নেভিগেশন অপারেশন’ অনুযায়ী নিজেদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেই যুদ্ধ জাহাজটি ওই এলাকায় প্রবেশ করে। এ ব্যাপারে ভারতকে আগে থেকে কোন কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই বলে মার্কিন কমান্ডারের বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক আইন মেনে নিজেদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠায় এই অঞ্চলে অতীতেও অভিযান পরিচালনা করেছে । ভবিষ্যতেও করবে। এজন্য ভারতের অনুমতি গ্রহণের বা তাদেরকে আগে থেকে অবহিত করার কোনো প্রয়োজন নেই।
এর আগে ‘ফ্রিডম হাউস’ নামে যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার পর্যবেক্ষণকারি একটি সংস্থা তাদের মূল্যায়নে একটি গণতান্ত্রিক মুক্ত দেশ হিসেবে ভারতের আগের অবস্থান থেকে অবনমণ ঘটিয়ে ‘আংশিক মুক্ত’ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে। নরেন্দ্র মোদি সরকার বিরোধীদের ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর দমন অভিযান চালানোর কারণে ফ্রিডম হাউস দেশটির এই অবণমন ঘটায়।
বাইডেন প্রশাসনের আরেকটি পদক্ষেপও ভারতের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র সব সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে। প্রত্যাহারের আগে ও পরে দেশটিতে স্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে আফগান সরকার ও তালেবানসহ আফগানিস্তানের সব পক্ষকে নিয়ে একটি অন্তবর্তী সরকার গঠনের চেষ্টা করছে। এজন্য বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কসহ কয়েকটি দেশকে নিয়ে একটি সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এতে ভারতকে রাখার আগ্রহ দেখায়নি যুক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানের কাছের দেশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের এই সিদ্ধান্তকে ভারতের জন্য অবমাননাকর বিষয় হিসাবে দেখছে দিল্লি।
ভারতের জন্য আরো বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের একটি আইন নিয়ে। কাউন্টারিং আমেরিকা এডভারসারিজ থ্রো স্যাঙ্কশনস অ্যাক্ট নামের এই আইনে যুক্তরাষ্ট্র শত্রু বা প্রতিপক্ষ দেশকে মোকাবেলার জন্য তাদের উপর অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র এখনও ভারতের নাম বৈরি দেশের এই তালিকা থেকে বাদ দেয়নি। ফলে ভবিষ্যতে বাইডেন প্রশাসন যে কোন সময় যে কোন ইস্যুতে ভারতের উপর অবরোধ বা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার সম্ভনা জিইয়ে রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্র যে ভারতকে নি:শর্তভাবে সমর্থন দিয়ে যাবেনা এসব ঘটনা তারই প্রমান।
ভূকৌশলগত বাস্তবতায় নিরাপত্তা ইস্যুতে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্র বিন্দুতে রয়েছে। অর্থনীতির ভরকেন্দ্র আটলান্টিক থেকে এশিয়াতে সরে এসেছে। চীনের ভূরাজনৈতিক অবস্থান, দেশটির ব্যাপক অর্থনৈতিক শক্তি এবং প্রাধান্য বিস্তারের সর্বাত্মক চেষ্টা বিশ্বে নানা ধরনের সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এ পরিস্থিতিতে একদিকে সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভারতের সংঘাত, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও সম্পর্কে টানাপড়েন ভারতের জন্য এক নতুন সংকট তৈরি করেছে।
ভারতের বিশ্লেষকরা মনে করেন, চীনের মোকাবেলায় এশিয়ার এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিশ্বস্ত অংশীদার দরকার। আর সেক্ষেত্রে ভারতই হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের অপরিহার্য পছন্দ। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের সাথে সম্পর্ককে ইতিবাচক ভাবেই সামনে এগিয়ে নিতে হবে। তৈরি করতে হবে সম্পর্কের নতুন অধ্যায়। চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিযোগিতায় ভারতের সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কার্যকর প্রমানিত হতে পারে বলেও ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করেন।
বাস্তবতা হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল বাইডেন প্রশাসন তা অব্যাহত রাখবে কিনা তা নিয়েই ইতোমধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে আসছেন বাইডেন। গত এক দশকে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্টের সামরিক সম্পর্কও অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিল। এই সময়ে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি বিক্রির পরিমান ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌছে। সমরাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির এই ধারা যুক্তরাষ্ট্র হয়তো অব্যাহত রাখতে পারে। কিন্তু বেশ কিছু ক্ষেত্রে ট্রাম্পের নীতি থেকে বাইডেনের নীতি আলাদা হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
ট্রাম্পের আমলে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব অনেক বেড়ে গিয়েছিল। এ কারণে ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও জোরালো হয়। জো বাইডেন নির্বাচিত হওয়ার পর এ ধারা অব্যাহত থাকবে বলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও প্রেসিডেন্ট বাইডেন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে জো বাইডেন চীনের ব্যাপারে অতোটা কট্টর নীতি অবলম্বন করবেন না বলেই মনে করা হচ্ছে। তিনি চীনের ব্যাপারে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণের আভাস দিয়েছেন। বাইডেন চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়, প্রতিযোগিতার সম্পর্ক অনুসরণ করতে চান। চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের এই বহুমুখি নীতি ভারতের জন্য অনেক জটিল ভূরাজনৈতিক পথ তৈরি করবে। ফলে ভারতও চীনের সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ নীতি অনুসরণ করতেবাধ্য হবে।
পাকিস্তানের সাথে বাইডেন প্রশাসন কেমন সম্পর্ক তৈরি করে তার উপরও যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সহযোগিতার সম্পর্ক উঠানামা করতে পারে। আফগানিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি বিষফোড়া হয়ে দাড়িয়েছে। পাকিস্তান আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কিছুটা সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করবে এই আশায় বাইডেন প্রশাসন পাকিস্তানের সাথে উষ্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে পারে। ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদ উষ্ণ সম্পর্ককে ভারত কোন ভাবেই ভাল চোখে দেখবেনা। ফলে ভারত নিজেদের নিরাপত্তা অংশিদার হিসেবে যুক্তরাষ্টের উপর পূর্ণ আস্তা রাখতে পারবেনা বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের অনেক আগে থেকেই মূল্যবোধকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলে আসছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে পদদলিত করার নানা উদাহরণ তৈর করে আসছেন। তার এসব কর্মকান্ড যুক্তরাষ্ট্র-ভারত সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া, সাংবাদিকদের গ্রেফতার, বিক্ষোভকারি ও বিরোধীদের দমনে পুলিশের ব্যাপক সহিংস আচরণ নাগরিক অধিকার খর্ব করার উদাহরণ।
ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট থাকার সময় ভারতের এসব বিষয় নিয়ে কোন কথা বলেননি। কিন্তু জো বাইডেন এসব বিষয়ে চুপ করে থাকার মানুষ নন। তিনি এ নিয়ে কথা বলবেন। এমনকি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অংশিদার হওয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও তিনি প্রশ্ন তুলে ফেরতে পারেন।
যুক্তরাষ্ট্র-ভারত প্রতিরক্ষা সহযোগিতার ক্ষেত্রে রাশিয়াকে কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে রাশিয়ার সাথে ভারতের সম্পর্ক সেই স্নায়ু যুদ্ধের সময় থেকে। যুক্তরাষ্ট্র আশঙ্কা করছে ভারতের সাথে তাদের সম্পর্ককে রাশিয়া জটিল করে তুলতে পারে। গত জানুয়ারিতে ভারত ইঙ্গিত দিয়েছিল যে, রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ক্রয়ের ক্ষেত্রে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা মোকাবেলা করতেও প্রস্তুত রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, ভারত যদি রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কিনে তাহলে দিল্লির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারেন বাইডেন।