ইরান ও সৌদি কি ইয়েমেন যুদ্ধের সমাপ্তি টানতে পারবে?

-

  • আহমাদ আব্দুল্লাহ
  • ০৩ মে ২০২১, ০৯:৩২

ইরান ও সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই দেশকে সাধারণভাবে প্রতিপক্ষ হিসেবেই দেখা হয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দুই দেশের সম্পর্ক অনেকটা দা-কুমড়োর মতো। কিন্তু সম্প্রতি এই দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের মধ্যে এটি ঐতিহাসিক একটি ঘটনা। একটি বৈঠক হওয়ার কারণে সব বরফ গলে যাবে, এমনটা এখনই বলা যাচ্ছে না। বরং দুই দেশের হিসাবে আরও বেশ কিছু বিষয় আছে, যার সমাধান ছাড়া কোনো ফলাফল হয়তো আসবে না।

ইরান ও সৌদি আরবের কর্মকর্তাদের মধ্যে সরাসরি সংলাপে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা নিরসনের এক ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। বিগত কয়েক বছর একটানা হুমকি, আক্রমণ, পাল্টাআক্রমণ ও প্রক্সিযুদ্ধের কারণে গোটা মধ্যপ্রাচ্য ছিলো অশান্ত। এর ফলে আর্থিক কর্মকাণ্ড মন্থর হয়ে পড়েছে। খেসারত হিসেবে জ্বালানি তেলের দামে ধস নেমেছে।

দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচিত এ বৈঠকটি চলতি মাসের ৯ তারিখে ইরাকে অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৬ সালে রিয়াদে প্রখ্যাত শিয়া আলেম শেখ নিমার আল নিমরকে ফাঁসি দেওয়ার পর ইরানজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। এ ঘটনার পরই সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যায়। ২০১৬ সালের সে ঘটনার প্রায় ৫ বছর পর এসে দুই দেশের কর্মকর্তারা এই প্রথম সরাসরি এ ধরনের বৈঠকে অংশ নিলেন।

তেহরান শুধু সৌদি আরব নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে সমঝোতা সংলাপ শুরুর অপেক্ষায় রয়েছে। অন্যদিকে, সৌদি আরব এখন চলমান ইয়েমেনের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে।

এখনো পর্যন্ত ইরান বা সৌদি আরব- কোনো দেশের সরকারের তরফ থেকে বৈঠক নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য জানানো হয়নি। বৈঠকের খবরটি প্রথম প্রকাশ করে ফাইনান্সিয়াল টাইমস। যতটুকু ইংগিত পাওয়া গেছে এ বৈঠকে সৌদি আরবের পক্ষে রাষ্ট্রের অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তার পাশাপাশি দেশটির গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান খালিদ বিন আলি আল হুমাইদান উপস্থিত ছিলেন। তিনি আবারও ইরানের প্রতিনিধির সাথে ফলোআপ বৈঠকেও মিলিত হবেন বলেও খবরে বলা হয়েছে। ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তফা আল কাদিমি, গত মাসে এক রাষ্ট্রীয় সফরে সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। ইরান ও সৌদি আরবের এই সংলাপে তার গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা আছে।

দুই দেশের শীর্ষ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের এ সংলাপে আলোচনার মূল বিষয় ছিল ইয়েমেন সংঘাত। ইয়েমেন একটানা কয়েক বছরের যুদ্ধের কারণে সৌদি আরব অনেকটা বিপর্যন্ত। জাতিসংঘের মুল্যায়নে দেশটিতে ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো মানবাধিকার বিপর্যয়ও দেখা দিয়েছে। অসংখ্য শিশু সেখানে অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে। ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদেরকে ইরান সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে, ইয়েমেনের ক্ষমতাসীন সরকারকে সমর্থন করছে সৌদি আরব।

অনেক বছর যুদ্ধ চলার পরও হুথিদের পরাজয়ের কোনো লক্ষন নেই। ইয়েমেনের অধিকাংশ অঞ্চলে হুথিদেরই নিয়ন্ত্রন রয়েছে। সৌদি সমর্থিত প্রশাসনের চেয়ে বরং হুথি বিদ্রোহীরাই সকল হিসেবে এগিয়েও রয়েছে।

হুথিদের কর্মকান্ড শুধু ইয়েমেন জুড়েই সীমাবদ্ধ নয়। বিগত কয়েক বছরে হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের তেল স্থাপনাগুলোতে নিয়মিতভাবে হামলা পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে হুথিদের আক্রমনটি মারাত্মক ছিল। সেই আক্রমনের পর সৌদি আরবের অর্ধেক তেল সরবরাহ কমে গিয়েছিলো।

হুথিদের বিরুদ্ধে সফলতা পাচ্ছে না, এটাই সৌদি আরবের জন্য একমাত্র উদ্বেগজনক বিষয় নয়। সৌদি আরবের জন্য নতুন করে সংকটের কারণ হয়েছে নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি। বাইডেন আগাগোড়াই সৌদি আরবের আভ্যন্তরীন মানবাধিকার পরিস্থিতির তীব্র সমালোচক।

ইয়েমেনের যুদ্ধেও সৌদি আরব যেভাবে মারনাস্ত্র ব্যবহার করেছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকলেও বাইডেন এরই মাঝে বেশ কয়েকবার বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ইয়েমেনের যুদ্ধে সৌদি আরবের হামলার বড়ো দুর্বলতা হলো, বিদ্রোহীদের দমনের জন্য এসব হামলা চালানো হলেও বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের ঘটনা বেশি । ২০১৫ সালে সৌদি আরব ইয়েমেনে এই যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত ১ লাখের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে।

অপরদিকে হুথি আক্রমনগুলো ক্রমশই নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাচ্ছে। আরো কয়েক বছরও যদি এভাবেই যুদ্ধ চলে তারপরও সৌদি আরবের বিজয়ী হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সৌদি নেতৃত্ব উপলব্ধি করছে যে, বাইডেন প্রশাসনও অহেতুক ইয়েমেন যুদ্ধকে টেনে নিয়ে যাওয়ার এই দৃষ্টিভঙ্গি পছন্দ করছে না। তার অবিলম্বে ইয়েমেন যুদ্ধের সমাপ্তি দেখতে চায়। চারদিক থেকে চাপ থাকলেও সৌদি আরব হুট করে যুদ্ধ থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। তারা কিছু বিষয়ের সমাধান দেখতে চায়। আর এরই অংশ হিসেবে হুথি ও ইরানকে সমঝোতার টেবিলে নিয়ে আসতে চাইছে।

সৌদি আরব ও ইরান আলোচনার পেছনে অন্য কারনও আছে। ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি, যা জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশন নামে পরিচিত। এই চুক্তিটি ২০১৫ সালে ইরান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানী, রাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে সাক্ষরিত হয়েছিল। এ চুক্তির পর ইরানকে অবরোধ থেকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। আর ইরানও এই শর্তে রাজি হয়েছিল যে তারা তাদের পারমাণবিক কার্যক্রমের রাশ টেনে ধরবে। ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে বেড়িয়ে গেলেও বাইডেন তাতে ফিরে আসবেন। সৌদি-ইরান সর্ম্পকের এর প্রভাব পড়ছে।

নির্বাচনী প্রচারনার সময় বাইডেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন , তিনি বিজয়ী হলে ইরানের সাথে সাক্ষরিত চুক্তিকে আবারও বলবৎ করবেন। ইসরাইলের তীব্র আপত্তির মুখেও বাইডেন এ চুক্তিকে পুনরায় কীভাবে নবায়ন করা যায় তা নিয়ে নানামুখী তৎপরতা শুরু করেছেন। এর অংশ হিসেবে গত মাসে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কর্মকর্তারা একটি অনানুষ্ঠানিক বৈঠকেও মিলিত হয়েছিলেন। সে বৈঠকে পারমাণবিক চুক্তি কার্যক্রমটি পুনরায় শুরুর বিষয়ে দুই দেশের কর্মকর্তারা বেশ কিছু প্রস্তাব নিয়েও আলোচনা করেন।

অন্যদিকে, ২০১৫ সালের পর থেকে ইরানের সাথে সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যখন ইরানের ওপর অবরোধ আরোপ করেন, তখন সৌদি আরবও পরোক্ষভাবে ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে সমর্থনই করেছিল। কিন্তু এবার ইয়েমেনকে ঘিরে ইরানের সাথে সমঝোতার উদ্যোগ নেয়ায় সৌদি আরব আগের কৌশলেও পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।

সৌদি আরব এবং গালফ কোপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসিভুক্ত দেশগুলো এবার আরো ব্যাপক পরিসরে ইরানের চুক্তিটি সম্পাদন করানোর চেষ্টা করছে। তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকদের প্রতি আহবান জানিয়েছে যাতে শুধুমাত্র পারমাণবিক প্রকল্পকে ঘিরেই এ চুক্তিটি না করা হয়। তেহরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রকল্পকেও যেন নিয়ন্ত্রনে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেয়া হয়।

ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প নিয়ে অনেক বেশি আলোচনা হলেও কার্যত ইরানের ব্যালিস্টিক মিসাইল প্রকল্পটি আশপাশের সবগুলো দেশের ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে। এ কারণে এবারের চুক্তির ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও কিছু কৌশল বের করতে চাইছে যাতে সৌদি আরব ও উপসাগরীয় অন্যান্য দেশগুলোকে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্পের বিষয়ে স্বস্তিতে থাকে।

যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে ইরানের ওপরও কিছুটা চাপ সৃষ্টি করেছে। মার্কিন নীতি নির্ধারকরা ইরানকে এরই মধ্যে জানিয়ে দিয়েছেন যে, ইয়েমেনসহ অন্যান্য প্রতিবেশি দেশে ইরান যদি আগের মতো করেই হস্তক্ষেপ অব্যাহত রাখে তাহলে পারমাণবিক চুক্তি সংক্রান্ত সংলাপ নিয়ে এগুনো যাবে না। এ বাস্তবতায় অনেকেই মনে করছেন যে, ইরান তার জাতীয় স্বার্থে ইয়েমেনের হুথিদেরকে যুদ্ধ শেষ করার আহবান জানাবে। তবে তাতে কাজ কতটা হবে তাই এখন দেখার বিষয়।

মধ্যপ্রাচ্যের অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, হুথিরা যে পুরোপুরি ইরানের নিয়ন্ত্রনেই আছে বা ইরানের হুকুম পাওয়া মাত্রই তা পালন করবে এমনটা নাও হতে পারে। তাছাড়া হুথিদের মধ্যেও এই কয়েক বছরে নানা উপদল তৈরি হয়েছে। হুথিরা এখন অনেকক্ষেত্রেই স্বয়ং সম্পুর্ন ও আত্মনির্ভরশীল। এমনও হতে পারে, ইরান যদি ইয়েমেন থেকে নিজেদেরকে শতভাগও গুটিয়ে নেয়, তারপরও হুথিরা তাদের সৌদিবিরোধী যুদ্ধ আগের মতোই চালিয়ে যাবে।