ইসরায়েল-আমিরাত-সাইপ্রাস জোট, নেই সৌদি-মিশর


  • মোতালেব জামালী
  • ৩০ এপ্রিল ২০২১, ১৬:৩৮

উপসাগরীয় অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এ অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে নতুন নতুন জোট গঠনের নানা উদ্যোগ এখন ভালোভাবেই চোখে পড়ছে। দুই দেশ বা একাধিক দেশের মধ্যে এসব জোট গড়ে উঠছে। তুরস্ক ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আবার চলতি মাসে বাগদাদে সৌদি আরব ও ইরানের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের মধ্যে বৈঠক হয়েছে। এসব উদ্যোগকে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে পরিবর্তনের ফল হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ খলিফা বিন জায়েদের উপদেষ্টা আনোয়ার গারগাস সম্প্রতি বলেছেন, গত বছর আগস্ট মাসে স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তির ফলেই মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতির নতুন এক চেহারা দেখা যাচ্ছে। ইসরায়েলকে চারটি আরব দেশের স্বীকৃতি প্রদান ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদারে স্বাক্ষরিত আব্রাহাম চুক্তিকে তিনি ‘বিকল্প কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গি’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তবে তার এ দাবির কতটুকু যথার্থতা আছে, তা নিয়ে অবশ্য বিতর্ক আছে। ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে সম্পর্কের যে পরিবর্তন ঘটেছে, তার ফলে উপসাগরীয় অঞ্চলের রাজনীতিতে নতুন জোট গঠনের প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে বলে অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন। পূর্ব ভূমধ্যসাগর, পশ্চিম এশিয়া ও পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলের চারটি দেশ- গ্রীস, সাইপ্রাস, ইসরায়েল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মধ্যে নতুন জোট দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

এ ধরনের জোট গঠনের প্রবণতা উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়ে পুরনো মার্কিন কৌশল থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আগের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্র উপসাগরীয় অঞ্চলকে মিত্র ও শত্রু এই দুই ভাগে বিভক্ত করে রেখেছিলো। মিত্র দেশগুলোকে ইরানের বিরুদ্ধে দাড় করিয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থ হাসিল করতো। কিন্তু নতুন নীতির ফলাফল কি হতে পারে তা এখনও নিশ্চিত নয়।

উপসাগরীয় অঞ্চলে নতুন জোট গঠনের যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রতিটি জোটেরই আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। গত জানুয়ারিতে সৌদি আরব ও তার উপসাগরীয় মিত্ররা কাতারের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করে দেশটির সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে। বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহনের পর মধ্যপ্রাচ্যের ব্যাপারে নতুন কি নীতি গ্রহন করেন তা নিয়ে উদ্বেগের কারণেই আগেভাগে কাতারের সাথে সমঝোতা করে ফেলে সৌদি আরব।

ট্রাম্প প্রশাসনের সময় সৌদি আরবের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের সুসম্পর্ক ছিল। কিন্তু জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহনের পর সেই সম্পর্কে ভাটা পড়ে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কিছু বিতর্কিত কর্মকান্ডে বাইডেন প্রশাসন ক্ষুব্ধ। বিশেষ করে বেশ কিছু ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস সদস্য যুবরাজকে মোটেই ভালো চোখে দেখেন না। এ কারণেই সৌদি আরব চাইছে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে। সে চেষ্টা কতটুকু সফল হবে তা বলার সময় এখনো হয়নি।

সৌদি আরব ও কাতারের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ফলে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদ বা জিসিসি দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বেড়ে গেছে তা নয়। তবে এর মাধ্যমে কূটনীতি জোরদার হয়েছে, কমে গেছে হুমকি-পাল্টা হুমকির ঘটনা।

সৌদি নেতৃত্বাধীন অবরোধের বিরুদ্ধে কাতারকে শক্ত পায়ে দাড়িয়ে থাকার সাহস যুগিয়েছে তুরস্ক। বর্তমানে সৌদি-কাতার সম্পর্ক একটি ইতিবাচক সম্ভাবনার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এটা তুরস্কের জন্যও একটি ভাল খবর। এর ফলে আগামীতে দোহা-আঙ্কারা জোটের সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত না করেও রিয়াদ ও আঙ্কারার মধ্যে একটি শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে উঠার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।

তুরস্কের সহায়তায় কাতার সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের অবরোধকে শক্তভাবে প্রতিরোধ করার ফলে পরোক্ষভাবে তুরস্কের আঞ্চলিক প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে। তুরস্ক বর্তমানে একটি প্রভাবশালী আঞ্চলিক শক্তি। কাতারে তুরস্ক-কাতারের যৌথ সামরিক ঘাটি ও সেখানে তুরস্কের সেনা সদস্যদের উপস্থিতি নিঃসন্দেহে কাতারের মনোবল বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

অনেক পশ্চিমা বিশ্লেষক মনে করেছিলেন, কাতার-সৌদি সমঝোতার ফলে ইরান ‘ক্ষতিগ্রস্ত’ হবে। তারা উপসাগরীয় দেশগুলোর বাস্তবতা খাটো করে দেখেছিলেন। সাড়ে তিন বছর আগে কাতারের সাথে জিসিসি জোটের যে বিরোধ সৃষ্টি হয় তা থেকে যথেষ্ট লাভবান হয়েছে ইরান। এই সংকট ইরান ও কাতারের অংশিদারিত্বকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যায়। বর্তমানে ইরান-কাতার সম্পর্ক উপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর কূটনীতির ক্ষেত্রে একটি নতুন উদাহরণ তৈরি করেছে।

ভিয়েনায় ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা ভালোভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনায় ফিরে আসা এবং ইরানের উপর অবরোধ প্রত্যাহার করার যে কথাবার্তা হচ্ছে তা সৌদি আরবকে ইরানের ব্যাপারে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে। সম্ভবত: এ কারণেই গত ৯ এপ্রিল বাগদাদে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর কুদস ফোর্সের প্রধান জেনারেল ইসমাইল কানীর সাথে সৌদি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান খালিদ বিন আলী আল হুমাইদান এক গোপন বৈঠক করেছেন।

সৌদি আরব ও ইরানের দুই দেশের শীর্ষ কর্মকর্তার এই বৈঠক আরো আগেই হতে পারত। গত বছর জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্র বাগদাদ বিমান বন্দরে হামলা চালিয়ে ইরানী জেনারেল কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করার কারণে তা পিছিয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্র এখন ইরানের ব্যপারে ইতিবাচক মনোভাব দেখানোর কারণে সম্ভবত সৌদি আরবও ইরানের সাথে বৈঠকে আগ্রহী হয়েছে।

সৌদি আরব-ইরান উত্তেজনা কমার ফলে দুই দেশের মধ্যে যে রাতারাতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে তা আশা করা যায় না। কেননা দুই দেশের মধ্যে মৌলিক কিছু বিরোধের ক্ষেত্র রয়েছে। যা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাড়াবে। তবে দুই দেশের মধ্যে বৈরিতার অবসান ঘটলে তা উপসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আগামী এক বছরে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কোন দিকে মোড় নেয় তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। যদি ইরানের উপর যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধ প্রত্যাহার করা হয় এবং ইরান আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মিশে যায়। তাহলে পশ্চিম এশিয়ার ভূরাজনীতির চিত্র আমূল পরিবর্তণ হয়ে যেতে পারে। তখন ইরানের ইচ্ছা –অনিচ্ছার উপর আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা অনেক খানি নির্ভর করবে।

ইরানকে কোনঠাসা করার জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০২০ সালে উপসাগরীয় অঞ্চলের কয়েকটি দেশের সাথে যে আব্রাহাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তার কার্যকারিতাও কমে যাবে। এটাই সম্ভবত: ইসরায়েলের ‘লুক ওয়েস্ট’ নীতির আংশিক ব্যাখ্যা। এর অংশ হিসাবেই সংযুক্ত আরব আমিরাত এখন ইসরায়েল, গ্রীস ও সাইপ্রাসকে নিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোট গঠন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। সাইপ্রাসের ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ পাফোসে এই চার দেশের মন্ত্রীরা বৈঠক করেছেন।

সাইপ্রাসের পররাষ্ট্র মন্ত্রী নিকোস ক্রিষ্টোডোলিডেস এই বৈঠককে এই অঞ্চলের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, তাদের অভিন্ন লক্ষ্য হচ্ছে বৃহত্তর পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য ও উপসাগরীয় অঞ্চলকে শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্থিতিশীলতার অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা। কোন কোন প্রতিবেশি এই অঞ্চলে বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ও সংকট সৃষ্টির যে চেষ্টা করে চলেছে তা এই চার দেশ সম্মিলিতভাবে ব্যর্থ করে দেবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি নাম উল্লেখ না করলেও তুরস্ককে টার্গেট করেই একথা বলেছেন।

ইসরায়েল ও গ্রীস ইতোমধ্যে বৃহত্তম প্রতিরক্ষা চুক্তির কথা ঘোষণা করেছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গান্টজ বলেছেন, এই চুক্তি দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অংশিদারিত্বকে আরো জোরদার করবে। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর সক্ষমতাকে অনেক গুন বাড়িয়ে দেবে। শুধু ইসরায়েল নয়, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথেও গ্রীসের প্রতিরক্ষা সহযোগিতা চুক্তি রয়েছে।

গ্রীস তার সামরিক শক্তি বাড়াতে ফ্রান্সের রাফালে ও যুক্তরাষ্ট্রেরএফ-৩৫ ষ্টিলথ যুদ্ধবিমানসহ অন্তত ৪০টি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান কেনার পরিকল্পনা নিয়েছে। অন্যদিকে বাইডেন প্রশাসন আরব আমিরাতের কাছে ৫০টি এফ-৩৫ স্টিলথ যুদ্ধবিমান বিক্রির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে বলে খবর এসেছে।

তুরস্কের আঞ্চলিক পরাশক্তি হবার ইচ্ছাকে প্রতিহত করতেই ইসরায়েল, গ্রীস ও আরব আমিরাত যে তাদের সমরাস্ত্রের ভান্ডার সমৃদ্ধ করছে তা সহজেই অনুমান করা যায়। চার দেশীয় জোটের আরেক সদস্য সাইপ্রাসও বসে নেই, তারাও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যুদ্ধবিমান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করছে। লক্ষ্য করার বিষয় হচ্ছে সৌদি আরব ও মিসরকে এই জোটে নেয়া হয়নি। কেননা এই দেশ দুটি তুরস্কের সাথে তাদের সম্পর্ককে জোরদার করছে।

ইসরায়েল ধারণা করছে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক যে ভাবে স্বাভাবিক হওয়ার দিকে যাচ্ছে তা ঠেকানোর ক্ষমতা তাদের নেই। ভবিষ্যতে উপসাগরীয় অঞ্চলে কোন ধরণের নিরাপত্তা জোট হলে তাতে ইরানকেও অন্তর্ভূক্ত করা হতে পারে। ইসরায়েল এটাও বুঝে গেছে যে, ইরান জুজুর ভয় দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে আর তাদের দিকে ধরে রাখা যাবেনা। বাইডেন প্রশাসন ইরানের ব্যাপারে আর তাদের কোন কথা যে শুনবেনা তা ইসরায়েল ভালো করেই বুঝে গেছে। এ কারণেই ইহুদি দেশটি এখন ভিন্ন পথে হাটতে শুরু করেছে। গঠন করছে নতুন আঞ্চলিক জোট।