ভারত থেকে পালাচ্ছেন ধনীরা


  • মেহেদী হাসান
  • ২৭ এপ্রিল ২০২১, ১০:৫৬

করোনা থেকে রক্ষা পেতে ধনী আর সুপার ধনীরা পালাচ্ছেন ভারত থেকে। প্রাইভেট জেটে করে ধনী ব্যক্তিরা দেশত্যাগ করছেন। বিভিন্ন রুটে কমার্শিয়াল ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রাইভেট জেট কোম্পানীগুলোর চাহিদা বেড়েছে। অনেকে গ্রুপ করে প্রাইভেট জেট ভাড়া করে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন।

ভারতের অধিকাংশ ধনী আর সুপার ধনীরা গন্তব্য হিসাবে বেছে নিয়েছেন দুবাই। অনেকে থাইল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে যেতে চাইলেও পাচ্ছেন না ফ্লাইট। করোনা সুনামী আকারে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্রিটেনে ভারতীয়দের প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। ভারতের নাম উঠেছে লাল তালিকায়।

লন্ডন টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, ভারত থেকে লন্ডনে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা ভোর চারটায় বলবত হওয়ার আগেই কমপক্ষে আটটি প্রাইভেট জেটে করে ভারতের অনেক সুপার ধনী লন্ডনে অবতরণ করেছেন।

ব্রিটেনে প্রবেশের সময়সীমা শেষ হওয়ার আগে ভিস্তা জেট বম্বারডিয়ার গ্লোবাল ৬০০০ ছিল অবতরন করা সর্বশেষ বিলাসবহুর বিমান। যেটি ২২ এপ্রিল রাত সোয়া তিনটায় মুম্বাই এয়ারপোর্টে অবতরণ করে। ভারতের সুপার ধনীদের তুলে নেয়ার জন্য বিমানটি ২২ এপ্রিল দুবাই থেকে ভারতের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাত্র ৪৪ মিনিট আগে বিমানটি মুম্বাই পৌছায়।

এয়ার চার্টার সার্ভিস ইন্ডিয়ার একজন মুখপাত্র সংবাদ সংস্থা এএফপিকে বলেন, প্রাইভেট জেটের জন্য মানুষ পাগলের মত ঝাপিয়ে পড়েছে। দুবাইতে ১২টি ফ্লাইট ছিল এবং সব টিকিট মুহুর্তে শেষ হয়ে যায়।

এনথ্রাল এভিয়েশেনের আরেকজন মুখপাত্র বলেন, আরো প্লেন নামানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। আমরা ৩৮ হাজার ডলার দিয়ে ১৩ সিটের একটি বিমান সংগ্রহ করেছি মুম্বাই থেকে দুবাই যাওয়ার জন্য। আর ৩১ হাজার ডলার দিয়ে ৬ সিটের আরেকটি বিমান ভাড়া করেছি একই রুটের জন্য।

বিমানে সিট পাওয়ার জন্য অনেকে গ্রুপ করে আবেদন করছেন। অনেকে থাইল্যান্ডে ফ্লাইট পরিচালনার অনুরোধ করছেন। তবে অধিকাংশ অনুরোধ করছেন দুবাই যাওয়ার জন্য।

এশিয়া টাইমসের খবরে বলা হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩৩ লাখের মত ভারতীয় রয়েছে। এদের অধিকাংশের বসবাস দুবাইতে। ভারতীয়দের দেশ ত্যাগের হিড়িকে ১০ গুন বেড়েছে প্লেন ভাড়া। ২৩ এবং ২৪ এপ্রিল মুম্বাই টু দুবাই যাত্রীবাহী বিমানে ওয়ানওয়ে ভাড়া ছিল ১ হাজার ডলার। স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এটি ১০ গুন বেশি। নিউ দিল্লি টু দুবাই টিকিটের মূল্য বেড়েছে ৫ গুন বেশি। যুক্তরাষ্ট্র গামী বিমানে অনেক সিট রয়েছে তবে তারও দাম আগের তুলনায় দ্বিগুন। কেন এভাবে অনেক সুপার ধনীরা পালাচ্ছে ভারত থেকে?

ধনীদের এভাবে দেশ ছাড়ার কারন হচ্ছে, করোনা সুনামিতে আক্রন্ত ভারত এখন এক কল্পনাতীত ভয়ঙ্কর স্থানে পরিণত হয়েছে। ধনী ব্যক্তিরা ভাবছেন, ভারতে এখন অসুস্থ হলে জীবনের কোনো নিরাপত্তা নেই। হাসপাতালে কোনো বেড নেই। অক্সিজেন নেই। জীবন রক্ষাকারী জরুরি ঔষধ নেই। নেই পর্যাপ্ত ডাক্তার এবং নার্স। বিভিন্ন হাসপাতালে একের পর অক্সিজেনের অভাবে করোনা রোগী মারা যাবার নারকীয় দৃশ্য ভাসছে তাদের চোখের সামনে।

সুপার ধনীদের দেশ ত্যাগ নিয়ে ২৫ এপ্রিল এশিয়া টাইমসের একটি খবরের শিরোনাম করে ‘ইন্ডিয়াস সুপার রিচ ফ্লি আনইমাজিনেবল হরর।’

মুম্বাইয়ের বাইরে ৭০ কিলোমিটার দূরে একটি হাসপাতালে আগুন লেগে মারা যায় কমপক্ষে ১৪ জন করোনা রোগী। একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন ওই সময় সেখানে কোনো ডাক্তার ছিল না। শুধু দুইজন নার্স দেখতে পেয়েছেন তিনি।

এরপর মহারাষ্ট্রের একটি হাসপাতালে অক্সিজেন লিকেজ দুর্ঘটনায় ২৪ জন করোনা রোগী মারা গেছে। এরপর আরো একটি হাসপাতালে অক্সিজেন সঙ্কটে করোনা রোগী মারা যাবার খবর বের হয়।

২৪ এপ্রিল ভারতে সরকারি হিসেবে করোনা পজিটিভ সনাক্ত হয়েছে সাড়ে তিন লাখ। আর মারা গেছে ২ হাজার সাত শয়ের বেশি। বাস্তবে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর এ সংখ্যা আরো অনেক বেশি। বিবিসিসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের সরেজমিন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন শ্মশানে দিন রাত ২৪ ঘন্টা জ্বলছে চিতার আগুন । আকাশ ছেয়ে আছে কমলা রংয়ের ধোয়ায়। আরো বিভিন্ন ঘটনায় প্রমানিত যে, ভারতে করোনায় মৃত্যুর সঠিক সংখ্যা সরকারি হিসেবের চেয়ে অনেক বেশি।

করোনা সুনামির কারনে ভারতে ভেঙ্গে পড়েছে স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। অক্সিজেনের অভাবে বিভিন্ন হাসপাতালে ছটফট করতে করতে রোগী মারা যাওয়ার খবর বের হয়েছে। হাসপাতালের দরজা থেকে ফেরত দেয়া হচ্ছে মরনাপন্ন রোগী। এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে করতে মারা যাচ্ছে অনেক করোনা রোগী। এমনকি শ্মশানে লাশ সৎকারেও পড়েছে লম্বা সিরিয়াল।

ভারতের হাসপাতালগুলোতে বর্তমানে প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৫ দশমিক ৩টি বেড রয়েছে । চীনে এ হার ৪৩। ভারতে প্রতি ১ লাখ মানুষের জন্য ২ দশমিক ৩টি ক্রিটিকাল কেয়ার বেড রয়েছে। এশিয়া টাইমসের খবরে বলা হয়েছে, গোটা ভারতে মাত্র ৪৮ হাজার ভেন্টিলেটর রয়েছে যেখানে চীনের শুধু উহান প্রদেশে রয়েছে ৭০ হাজার ভেন্টিলেটর। অনেকের মতে ভারতের এ দুরবস্থার কারন স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারিকরণ।

২০২০ সালে যখন ইউরোপ এবং আমেরিকায় ভয়াবহ আকারে করোনা ছড়িয়ে পড়ে তখনো পশ্চিমা বিশ্বের সুপার ধনিরা এভাবে বিভিন্ন দ্বীপ ও ইয়টে গোপন আশ্রয় নিয়েছিলো। অনেক সুপার ধনী কিনে নেয় নির্জন দ্বীপ আর সাগর তীরে ভিলা। অনেকে কিনে নেয় মাটির তলায় বিলাসবহুল গোপন বাঙ্কার। আবার অনেকে আশ্রয় নেয় সুপার ইয়টে।

ভারতের করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ রুপ নেয়ার পর ব্রিটেন ছাড়া কানাডাও ভ্রমন নিষেধাজ্ঞার লাল তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত থেকে আসা যে কোনো বৃটিশ নাগরিকের জন্য সরকার অনুমোদিত হোটেলে ১০ দিন কোয়ারিন্টনে থাকতে হবে। ২৩ এপ্রিলের আগে ১০ দিন পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করেছে এমন ব্যক্তিদের ব্রিটেনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

২২ এপ্রিল থেকে কানাডায় ভারত এবং পাকিস্তানী যাত্রীবাহী এবং প্রাইভেট জেট প্রবেশ ৩০ দিনের জন্য নিষিদ্ধ করে। ২৫ এপ্রিল থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে ভারতে সমস্ত ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দেয়া হয়। এমনকি ইরানও ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের এয়ার চার্টার সার্ভিসের ২০২০ সালের তথ্য অনুসারে ৪ থেকে ৬ সিটের একটি প্রাইভেট বিমানে ১ ঘন্টার ভাড়া কমপক্ষে ৪ হাজার ডলার। বিমান বিলাসবহুল হলে ভাড়া আরো বেশি । ৬ থেকে ৯ সিটের একটি প্রাইভেট জেটের এক ঘন্টার ভাড়া সাড়ে ৫ হাজার ডলার থেকে ৯ হাজার ডলার। ১৬ থেকে ১৯ সিটের প্রাইভেট জেটের ভাড়া ১১ থেকে ২০ হাজার ডলার। বিলাসবহুল বিমান হলে এ ভাড়া ৪০ হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু এভাবে বিপুল অর্থব্যয় করে ভারতের ধনী ব্যক্তিরা দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন।

দেশী এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে ভারতে করোনা সুনামী রুপ ধারন করায় দায়ী করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে।

ভারতসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিদিন তুলে ধরা হচ্ছে কিভাবে ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গ। সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে ঘুরছে ভারতে মাসব্যাপী কুম্ভ মেলা, গঙ্গা স্নানের গিজ গিজ করা মানুষের দৃশ্য।

এর সাথে রয়েছে বিভিন্ন রাজ্যে ভোট আর খেলার মাঠে জনতার ভিড়। রয়েছে বিবাহ এবং বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে হাটে বাজারে শপিং মলে মানুষের গাদাগাদির দৃশ্য। আর এসবই ঘটেছে সরকারের নীতির কারনে।

এছাড়া সরকার অনুমতি দিয়েছে মাসব্যাপী কুম্ভ মেলা আর গঙ্গা স্নানের। সরকার অনুমতি দিয়েছে ভোটের। খোদ প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী প্রচারনায় একের পর এক জনসভা করে গেছেন। সরকার অনুমতি দিয়েছে খেলার মাঠে প্রবেশের। এভাবে সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যায় এবং করোনা ভাইরাস গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে ঝড়ো গতিতে।