পুতিন-এরদোয়ান বন্ধুত্ব কি বৈরিতায় রূপ নিচ্ছে

-

  • মোতালেব জামালী
  • ২৫ এপ্রিল ২০২১, ১১:২৯

গ্রীষ্মের কোনো এক দিনে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের একসাথে আইসক্রিম খাওয়ার দৃশ্য দেখলে যে কারোরই মনে হতে পারে যে, তারা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ২০১৯ সালের জুলাই মাসে রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্ক এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার চালান গ্রহণ করার এক মাস পর মস্কোর বাইরে একটি বিমান প্রদর্শনীতে দুজনকে এভাবে আইসক্রিম খেতে দেখা যায়। রাশিয়ার কাছ থেকে তুরস্কের এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনায় যুক্তরাষ্ট্র ক্ষুব্ধ হয়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে মাখামাখিকে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা মোটেই ভালো চোখে দেখছে না। কিন্তু দুই স্ট্রংম্যান প্রেসিডেন্টের মধ্যে আসলেই কি আন্তরিক সম্পর্ক রয়েছে? নাকি লোকদেখানো আন্তরিকতাপূর্ণ সম্পর্কের আড়ালে পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস ও সন্দেহের মাত্রাই বেশি?

বাস্তবে পুতিন ও এরদোয়ানের মধ্যে সম্পর্কটা বেশ জটিল। ভূরাজনীতির জটিল রসায়নে নিজেদের স্বার্থের কারণে কখনো তারা পরস্পরের কাছে আসেন আবার কখনো তাদের মধ্যে তৈরি হয় বৈরিতা। সিরিয়া, লিবিয়া ও নাগারনো -কারাবাখের যুদ্ধে পুতিন ও এরদোয়ান নিজ নিজ স্বার্থের কথা মাথায় রেখে ভিন্ন ভিন্ন পক্ষকে সমর্থন করেছেন। সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সমর্থন দিয়েছেন পুতিন, আর প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান সমর্থন দিয়েছেন বাশার বিরোধীদের। লিবিয়ায় পুতিন সমর্থন দিয়েছেন দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারকে, এরদোয়ান সমর্থন দিয়েছেন জাতিসংঘ সমর্থিত জিএনএ সরকারকে। নাগারনো-করাবাখ নিয়ে যুদ্ধে রাশিয়া সমর্থন দিয়েছে আর্মেনিয়াকে, অন্যদিকে তুরস্ক সমর্থন দিয়েছে আজারবাইজানকে।

আবার কখনো তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যেই সরাসরি সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। চার বছরেরও কম সময় আগে তুরস্ক সিরিয়া সীমান্তে রাশিয়ার একটি যুদ্ধ বিমান ভূপাতিত করলে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। পরে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে সরাসরি কথা বলে এই উত্তেজনা হ্রাসের পদক্ষেপ নেন। আবার যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের নিষেধাজ্ঞার হুমকি অগ্রাহ্য করে তুরস্ক তার প্রয়োজনে ঠিকই রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কিনেছে ।

এভাবেই বন্ধুত্ব ও বৈরিতার মিশেলে সামনে এগিয়েছে দুই প্রেসিডেন্টের সম্পর্ক ও দুই দেশের সম্পর্ক। কিন্তু ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তের ডনবাস এলাকাকে ঘিরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। কেননা এখানে রাশিয়া কোনো পক্ষকে সমর্থন দিচ্ছে না, বরং দেশটি নিজেই যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন হাজার হাজার সৈন্য, ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো করছেন। রাশিয়ার মোকাবেলায় ইউক্রেন তুরস্কের শরণাপন্ন হয়েছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পুতিন ও এরদোগানের মধ্যে বেশ কিছু ক্ষেত্রে মিল রয়েছে। যা তাদের মধ্যে সম্পর্কের ভিত্তিকে মজবুত করেছে। তারা দু’জনেই পশ্চিমা উদারনৈতিক গনতন্ত্রকে হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেন। দু’জনেই অনকটা কর্তৃত্ব পরায়ণ শাসনের দিকে ঝুকেছেন। দুই নেতাই এতিহাসিক ও ধর্মীয় চেতনাকে তাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছেন। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের এক যৌথ গবেষণা পত্রে গবেষক আনা মিকুলস্কা ও রবার্ট হ্যামিলটন পুতিন ও এরদোয়ানের সম্পর্ককে ‘বর্তমানের ইউরেশিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলোর একটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যা কয়েক মাসের মধ্যে খুব দ্রুতই বন্ধুত্ব ও সংঘাতের মধ্যে উঠানামা করে।

এরদোয়ান ও পুতিনের সম্পর্ককে যে জিনিসটি সুপার গ্লু’র মতো আটকে রেখেছে সেটি হচ্ছে অর্থনীতি। বিশেষ করে জ¦ালানি সহযোগিতা। তুরস্কের জ¦ালানি সম্পদের অভাব রাশিয়ার সাথে সম্পর্ককে টিকিয়ে রেখেছে। যদিও এই সম্পর্ক রাশিয়ার পক্ষেই গেছে। লাভবান হচ্ছে রাশিয়া। ২০১৯ সালে রাশিয়া ২৩ দশমিক ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডরারের গ্যাস রপ্তানী করেছে তুরস্কে। অন্যদিকে তুরস্ক রাশিয়ায় ৪ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানী করেছে। যার মধ্যে রয়েছে কৃষি পণ্য, মেশিনারী, টেক্সটাইল পণ্য ও যানবাহন।

তুরস্ক অবশ্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে জ¦ালানির উৎসকে বহুমুখি করার চেষ্টা করছে। রাশিয়ার গ্যাস ইউরোপে নিতে তুরস্কের মধ্য দিয়ে একটি পাইপলাইন নির্মান প্রকল্পে সহযোগিতা করছে। তুরস্ক বর্তমানে ইউরোপে গ্যস সরবরাহের ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে কাজ করছে। শুধু রাশিয়ার নয়, আজারবাইজানের গ্যাসও তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যাচ্ছে। এটা কৌশলগত ভাবে তুরস্ককে কিছুটা হলেও সহযোগিতা করছে।

এছাড়াও তুরস্ক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করেছে এবং প্রচুর পরিমানে এলএনজি আমদানি করছে। এ পদক্ষেপ রাশিয়ার বিপরীতে তুরস্কের অবস্থানকে অনেকটাই সংহত করেছে। ফলে গ্যাস রপ্তানীর একটি বড় বাজার কিংবা ইউরোপে গ্যাস রপ্তানীর ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে তুরস্ককে কখনোই হারাতে চাইবেনা রাশিয়া। তুরস্কও সেটা বোঝে এবং এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তারা লাভবান হওয়ার চেষ্টা করছে।

ইউক্রেন রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। ডোনবাস এলাকাটিও রাশিয়ার সীমান্ত সংলগ্ন। ডোনেটস্ক বেসিনকে সংক্ষেপে ডোনবাস বলা হয়ে থকে। দোনেটস নদী এই এলাকার ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ডোনবাস দক্ষিন-পূর্ব ইউরোপে অবস্থিত। এলাকাটি রাশিয়ার ঠিক উঠানের মতো। ডোনবাসে কয়লার বিশাল মজুদ রয়েছে। এছাড়া এটি একটি শিল্প এলাকা। কয়লা ক্ষেত্রগুলো ইউক্রেনের দক্ষিন-পূর্বাঞ্চজলে অবস্থিত। এটি আবার রাশিয়ার দক্ষিন-পশ্চিমাঞ্চলীয় সীমান্ত সংলগ্ন। কয়লা খনি ও শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা হওয়ার কারণেই প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন ডোনবাসকে ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করে নিজেদের দখলে নিতে চান বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যদি ইউক্রেনের আহবানে সাড়া দিয়ে সেখানে যুদ্ধ করতে যান তাহলে তাকে সরাসরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হবে। এটি তুরস্কের পক্ষে কতটুকু সম্ভব হবে সেটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একইসঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে উত্তেজনা পুতিন ও এরদোয়ানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র হয়ে উঠতে পারে। তবে ইউক্রেন-রাশিয়া উত্তেজনায় নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছে তুরস্ক। অন্যদিকে রাশিয়া হয়ে উঠছে ভয়ানক আগ্রাসী।

ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিডল ইষ্ট ইন্সটিউিটের গবেষখ গোনুল তুল মনে করেন , ‘ইউক্রেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বিষয়। ইউক্রনের সাথে তুরস্কের প্রতিরক্ষা অংশিদারিত্ব রয়েছে গত ৫-৬ বছর ধরে। যা ইউক্রেনের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যদিকে রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তের ডোনবাস এলাকাকে বৃহত্তর রাশিয়ার অংশ মনে করে। এলাকাটি রাশিয়ার সীমান্তে অবস্থিত। প্রেসিডেন্ট পুতিন এখানে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠায় যা কিছু করা প্রয়োজন তার সবই করবেন। গত কয়েক সপ্তাহে পুতিন ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছেন ও ট্যাঙ্কসহ ভারী যুদ্ধাস্ত্র মোতায়েন করেছেন।

রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ভাবে ক্রিমিয়া এখনো ইউক্রেনের অংশ হিসেবেই স্বীকৃত। ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়া ইউক্রেনের পূর্ব সীমান্তের ডোনবাস এলাকার বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সমর্থন দিয়ে ঐ এলাকাটিকেও ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করে আসছেন। রাশিয়ার সার্বিক সমর্থনে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ডানবাসকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। সম্প্রতি রাশিয়া এই সীমান্তে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যাপক সেনা সমাবেশ ঘটিয়েছেন।

এ কারণেই এ মাসের শুরুর দিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদাইমির জেলেনস্কি তুরস্কে গিয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। পরে তারা এক যৌথ বিবৃতিতে ক্রিমিয়া ও ডোনবাসকে দখলমুক্ত করার আহবান জানান। এরদোয়ান টেলিফোনে প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে ডোনবাস পরস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার একদিন পর জেলেনস্কির সাথে তার এই বৈঠক হয়।

পুতিনের সাথে কথা বলার পরই তুরস্ক ঘোষণা করে যে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি যুদ্ধ জাহাজ বসফরাস প্রণালী অতিক্রম করে কৃষ্ণ সাগরে যাবে। তুরস্কের এই ঘোষণা রাশিয়াকে ক্ষুব্ধ করে। এ দিনই রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ এক বিবৃতিতে ইউক্রেনকে সামরিক সরঞ্জামে সজ্জিত করার বিরুদ্ধে তুরস্ককে সতর্ক করে দেন। তুরস্ক ২০১৯ সালে ইউক্রেনের কাছে বেশ কিছু বায়েরকতার ড্রোন বিক্রি করেছে। যেগুলো সাম্প্রতিক সময়ে রাশিয়ার নির্মিত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অত্যন্ত কার্যকর প্রমানিত হয়েছে।

ক্রিমিয়ার তাতারদের সাথে তুরস্কের ঐতিহাসিক ও জাতিগত মৈত্রীর সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণেই ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর তুরস্ক এর নিন্দা জানিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তুরস্ক তাতে যুক্ত হয়নি। তবে ইউক্রেনের সাথে তুরস্কের সামরিক সহযোগিতার সম্পর্কের কারণেই রাশিয়া সম্প্রতি আঙ্কারায় রুশ যাত্রীবাহী বিমানের চলাচল স্থগিত করে দেয়।

যদিও রাশিয়া এটিকে কোভিড-১৯ মহামারিকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকরা রাশিয়ার এ পদক্ষেপকে তুরস্কের বিরুদ্ধে মস্কোর একটি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবেই দেখছেন। কারণ রাশিয়া থেকে প্রতি বছর অন্তত ৫ লাখ পর্যটক তুরস্ক ভ্রমন করে থাকেন। রুশ বিমানের ফ্লাইট বন্ধ করার কারণে এসব পর্যটক তুরস্কে যেতে পারবে না। এতে তুরস্কের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, দ্বিপক্ষীয় এই সম্পর্কের আলোকেই প্রেসিডেন্ট পুতিন ও প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান ইউক্রেন সংকট মোকাবেলার চেষ্টা করবেন যাতে তাদের সম্পর্কটা চরম বৈরিতায় রূপ না নেয়।