ইসরাইলি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি মোসাদের সাইবার অ্যাটাকের কারণে ইরানের নাতাঞ্জে পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা বিস্ফোরণ ঘটেছিল এবং এরই ফলশ্রুতিতে গোটা স্থাপনাটির বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে দীর্ঘ সময় অন্ধকারেও ডুবেছিল। এ হামলার কারণে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রমটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ধারণা করা হচ্ছে, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ইরানের হয়তো ৯ মাস সময় লেগে যেতে পারে। অপরদিকে ইরান এর প্রতিক্রিয়ায় ৬০ শতাংশ হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। যাতে দ্রত দেশটি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পর্যায়ে যেতে পারে। এছাড়া এ অঞ্চলে ইরান-ইসরাইল প্রক্সিযুদ্ধ আরও সম্প্রসারিত হতে পারে।
ইরান এ হামলার জন্য প্রকাশ্য ইসরাইলকে দায়ী করেছে। ইসরাইলের এ কার্যক্রমকে ইরান পারমাণবিক সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভেদ জারিফ অভিযোগ করেছেন, ইরান যখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আস্থা অর্জন করে অবরোধ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে, ইসরাইল তখন ইরানের এ সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ঘৃণ্য সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছে। আমরা ইসরাইলকে কখনও সফল হতে দেব না। ইসরাইলের এ অন্যায্য কার্যক্রমের জন্য ইরান সময়মতো প্রতিশোধ গ্রহণ করবে।
ইরানের সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, সাইবার অ্যাটাকে ইরানের বিদ্যুৎ সরবরাহের মূল গ্রিডকে টার্গেট করা হয়েছিল। নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, সাইবার এ্যাটাকের কারণেই পারমাণবিক স্থাপনায় প্রথমে বিস্ফোরণ ঘটে এর পরপরই গোটা এলাকা ব্ল্যাকআউট শুরু হয়। জেরুজালেম পোস্ট এক প্রতিবেদনে নিশ্চিত করেছে, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এ অপারেশনটি পরিচালনা করেছিল।
পত্রিকাটি জানায় মোসাদের ঘাটি থেকে আক্রমণ পরিচালনা শুরু হওয়ার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পটি হামলার শিকার হয়। ইসরাইলের কান পাবলিক রেডিও গোয়েন্দা সংস্থার বরাত দিয়ে নিশ্চিত করেছে যে, মোসাদের একজন স্পাই এজেন্ট এই সাইবার এ্যাটাকটি পরিচালনা করেছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনজামিন নেতানিয়াহু নিজেও সরাসরি এই হামলার দায় স্বীকার না করে বরং একটু ঘুরিয়ে বলেছেন, আমরা বারবার বলে আসছি, আজ এ মুহুর্তে যে পরিস্থিতি আছে, যেকোনো সময় তা পালটে যেতে পারে।
ইরানের নাতানজ পারমাণবিক স্থাপনাটি এবারই প্রথম হামলার শিকার হলো তা নয়। এর আগে পশ্চিমা দেশগুলো মিলে স্ট্রাকসনেট নামক একটি কম্পিউটার কীট বা জীবাণু আবিস্কার করে যা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর সফটওয়ারে হামলা চালিয়ে পারমাণবিক কাঠামোগুলোকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। এই জীবাণুকে ব্যবহার করে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প সম্পর্কে অনেক গোপন তথ্যও ফাঁস করে দেয়া হয়।
২০১৫ সালে ইরানকে পারমাণবিক প্রকল্প চুক্তিতে আসতে বাধ্য করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো গোপনে ইরানের পারমাণবিক প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্থ করার পথে অগ্রসর হয়েছিল। এই চুক্তিতে ট্রাম্প আমলে নিষ্ক্রিক্রয় হয়ে যাওয়ার পর ইরানের পারমাণবিক কাঠামোগুলোতে আবার নতুন করে হামলার মাত্রা শুরু হয়। শুধু সাইবার হামলা করেই আক্রমণকারীরা ক্ষান্ত হয়নি। বরং ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের সাথে যারাই যুক্ত ছিল তাদের সবাইকেই পর্যায়ক্রমে হত্যা করা হয়। গত বছর ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রমের মূল মাস্টারমাইন্ড মোহসেন ফাখরিজাদেহকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের সাথেও ইসরাইলের সরাসরি সম্পর্ক পরবর্তীতে প্রমাণিত হয়।
এরপর গত বছরের জুলাই মাসে নাতানজ প্রকল্প কাঠামোতে আগুন লেগে গেলে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম দুই মাসের জন্য বিলম্বিত হয়। এবারের হামলার ফলে যে ক্ষতি হলো তা কাটিয়ে উঠে এ সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পটি স্বাভাবিক অবস্থায় আসতে হয়তো আরো ৯ মাস সময় লেগে যাবে।
এবারের আক্রমণটি খুবই স্পর্শকাতর সময়ে করা হয়। বেশ কয়েক মাস সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম বন্ধ থাকার পর অবশেষে এই হামলার মাত্র একদিন আগে ইরান তার উন্নত প্রযুক্তির আইআর-সিক্স এবং আইআর-ফাইভ নামক দুটো সেন্ট্রিফিউজে ইউরেনিয়াম হেকসাফ্লোরাইড প্রবেশ করানো শুরু করে। অন্যদিকে, ঠিক একই সময়ে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন প্রথমবারের মতো ইসরাইলে রাষ্ট্রীয় সফল শুরু করেন। ধারনা করা হচ্ছিলো যে, এই সফরে ইরানের সাথে নতুন করে পারমাণবিক চুক্তি সাক্ষর নিয়েও অস্টিন ইসরাইলের সাথে আলাপ করতেন। এরকম একটি সময়ে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
নাতানজ পারমাণবিক প্রকল্পটি ইরানের ইসফাহান প্রদেশের মরুভূমিতে অবস্থিত একটি পারমাণবিক স্থাপনা। নাতানজকে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের মূল কাঠামো হিসেবে গন্য করা হয়। আন্তর্জাতিক আনবিক শক্তি সংস্থা নিয়মিতভাবেই এ প্রকল্প তত্বাবধান করে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অস্টিনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক শেষে ইসরাইলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেনি গান্তজ যৌথ সম্মেলনে বলেন, ‘যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরাইলের নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে অবধি ইরানকে যেকোনো সহযোগিতা করতে ইসরাইল প্রস্তুত।’ অন্যদিকে অস্টিন বলেন এই অঞ্চলে প্রতিরক্ষা খাতে ইসরাইলকে শক্তিশালী পর্যায়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র বদ্ধপরিকর।’ নেতানিয়াহু অবশ্য হামলার কথা স্বীকার করেননি আবার অস্বীকারও করেননি। বরং কথা পরিস্কার না করে তিনি একটু ধোঁয়াশা রেখে বলেন, “ইরান এবং এর প্রক্সির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করাটি সহজ কোনো বিষয় নয়। তবে, এটুকু বলতে পারি, ইরান এখন যে অবস্থায় আছে সে অবস্থায় থাকবে না।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন নেতানিয়াহু ইরানের সাথে হঠাৎ জটিলতা তৈরির পথে গেছেন কারণ নিজ দেশেও তিনি বেশ বড়ো আকারের সংকটে পড়েছেন। জনগনের দৃষ্টিকে ভিন্নদিকে প্রবাহিত করার জন্য তিনি এই কৌশলটি অবলম্বন করেছেন। আগে থেকেই তিনি জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশন বা ইরানের পারমাণবিক চুক্তিকে প্রত্যাখান করেছিলেন। এই চুক্তির বিষয়ে ইসরাইলের কট্টর অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে নেতানিয়াহু বলেন, যে চুক্তি আমাদেরকে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথ পরিস্কার করবে, আমরা কখনোই তা মানতে পারি না।
ইসরাইলের এই কট্টর অবস্থানের কারণে ইরানের সাথে সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তির দর কষাকষি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেও বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেছে। বাইডেন নিজেও নির্বাচনী প্রচারনার সময় ইরানের পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু ইরানের ওপর সাম্প্রতিক হামলা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র যেহেতু এক্ষেত্রে ইসরাইলকে সামাল দিতে পারছে না, তাই ইরানের সাথে চুক্তি নবায়নের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র আদৌ আন্তরিক কিনা সেই প্রশ্নও সামনে চলে এসেছে। তবে, চুক্তির অন্যান্য শরীক রাষ্ট্র বিশেষ করে বৃটেন, চীন, ফ্রান্স, জার্মানী এবং রাশিয়া- ইরানের সাথে চুক্তি নবায়নের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
ইরান বলছে, যে ব্যক্তির কারণে নাতানজে পারমাণবিক প্রকল্পে স্যাবোটেজ অপারেশনটি পরিচালনা হয়েছে এবং কাজ ব্যহত হয়েছে তারা তাকে সনাক্ত করতে পেরেছে।
অন্যদিকে ইসরাইলী সেনা প্রধান লেফটেনেন্ট জেনারেল আভিভ কোচাভি সম্প্রতি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলী সেনা ও গুপ্তচরেরা যেসব অভিযান পরিচালনা করে তার কোনোটাই শত্রুপক্ষের কাছে অজানা নয়। আমরাও চাই তারা আমাদের দেখুক, আমাদের কার্যক্রমগুলো পর্যবেক্ষন করুক। আমাদের সক্ষমতাগুলো অনুধাবন করুক এবং আমাদের সাথে খেলতে আসার বিষয়ে অনেক বেশি সতর্কতা অবলম্বন করুক।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন নাতাঞ্জ পারমাণবিক প্রকল্পে সাইবার হামলার জন্য ইরান নানা ভাবে চেষ্টা করে যাবে। এ ক্ষেত্রে ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে প্রক্সিযুদ্ধ আরো সম্প্রসারিত হবে। ইতোমধ্যে পারস্য উপসাগরে দুদেশের পন্যবাহী জাহাজে নাশকতামুলক হামলা বেড়েছে। ইসরাইলে জাহাজে যেমন হামলা হচ্ছে তেমনি ইরানের জাহাজে হামলা হচ্ছে। অপরদিকে ইরান চুক্তির ব্যাপারে শীতল মনোভাব দেখিয়ে ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর নানা ভাবে চাপপ্রয়োগের চেষ্টা করে যাবে।
ইতোমধ্যে ইরান বলছে এই হামলার পর জবাব দিতে নাতাঞ্জ পারমাণবিক প্রকল্পে শতকরা ৬০ মাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। নাতাঞ্জ পরমাণু সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় নতুন সেন্ট্রিফিউজের দুটি সাইকেলে এই তৎপরতা চালানো হবে। এর মাধ্যমে ইরান পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখানো শুরু করেছে।
আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা আইএইএ’তে নিযুক্ত ইরানের স্থায়ী প্রতিনিধি কাজেম গরিবাবাদি নিজের অফিসিয়াল টুইটার পেজে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, আইএইএ-কে যে চিঠি দেওয়া হয়েছে তাতে বলা হয়েছে, নয়া আইআর-৪ ও আইআর-৬ সেন্টিফিউজের দুটি সাইকেলে শতকরা ৬০ ভাগ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করা হবে।
তিনি বলেন, এরইমধ্যে সমৃদ্ধকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে এবং আগামী সপ্তাহ নাগাদ ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম এখান থেকে বের করা যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এর ফলে ইরানে উৎপাদিত রেডিওমেডিসিনের গুণগত মান ও পরিমাণ অনেক বাড়ানো সম্ভব হবে।
ইরানের এ উদ্যোগে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স। হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র জেন সাকি এ ঘটনাকে ‘উসকানিমূলক’ আখ্যায়িত করার পাশাপাশি বলেছেন, জো বাইডেন প্রশাসনে এখনও ইরানের সঙ্গে পরমাণু আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী।
ইরানের এক ধাপে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধরণের মাত্রা তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপারে মার্কিন সরকার উদ্বিগ্ন বলেও জানান সাকি। ফরাসি প্রেসিডেন্টের প্রাসাদ এক বিবৃতিতে বলেছে, ইরান ৬০ শতাংশ হারে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার নিন্দা জানায় প্যারিস।
অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, আগামী দিনে ইরানকে ঘিরে মধ্যপ্রাচ্যে পরিস্থিতি আরো জটিল রুপ নিতে পারে। কারন ইরান আগের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অবরোধের পরও দেশটি ভালো ভাবে টিকে আছে। এখন দেশটিতে চীন ও রাশিয়ার বিনোয়োগ দেশটির অর্থনীতি ধীরে ধীরে চাঙ্গা হবে। ফলে ইরান আরো বেশি মাত্রায় দরকষাকষির চেষ্টা করবে।