হারের পর হার, উদ্বিগ্ন বিজেপি

-

  • ফারজানা তানিয়া
  • ২১ এপ্রিল ২০২১, ১০:০৮

ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সময় ভালো যাচ্ছে না। একের পর এক পরাজয় গুনতে হচ্ছে তাদের। অতিসম্প্রতি চার-চারটি বড় পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছে দলটি। যে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী চেতনা নিয়ে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মনে ঝড় তুলেছিলেন মোদি ও অমিত শাহরা, সে চেতনা কি ধীরে ধীরে অসার প্রমাণিত হচ্ছে? বিশ্লেষকরা গুজরাত দাঙ্গা থেকে শুরু দিল্লি দাঙ্গা পর্যন্ত বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদকে নৈতিকতার মানদণ্ডে দাঁড় করিয়েছেন। তারা দেখেছেন, ধর্মীয় উন্মাদনা কোনোকালেই স্থায়ী জনসমর্থন পায়নি। ভারতও সেই পথে হাঁটতে যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে পাঞ্জাব, আসাম, ত্রিপুরা ও হিমাচলে জনগণের সেই দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। রাজ্যগুলোর বিভিন্ন নির্বাচনে হেরেছে কিংবা হারতে যাচ্ছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রাণপণ চেষ্টায়ও সেখানে বিজেপির ইমেজ ধরে রাখা যায়নি।

পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে চষে বেড়াচ্ছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, প্রভাবশালী বিজেপি নেতা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডা। সেখানেও নির্বাচনের আগে প্রকাশিত জনমত জরিপে তৃণমূল কংগ্রেসের জয়ের সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে। চতুর্মুখী কৌশল, অর্থ, ক্ষমতা এবং কেন্দ্রীয় শক্তি কাজে লাগানোর পরও পশ্চিমবঙ্গে যদি বিজেপি পরাজিত হয়, দলটির হিন্দুত্ববাদী চেতনা আরও জোরেশোরে প্রশ্নবিদ্ধ হবে।

সম্প্রতি ত্রিপুরার উপজাতি পরিষদের নির্বাচনে বড় ব্যবধানে হেরেছে বিজেপি। নির্বাচনে প্রাক্তন কংগ্রেস প্রধানের হাতে তৈরি দল টিপ্রা’র কাছে পরাস্ত হয় নরেন্দ্র মোদিদের দল। মোট ২৮টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে মাত্র ৯টি আসন। টিপ্রা পেয়েছে ১৮ আসন।

গত বছর কংগ্রেস প্রধানের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ত্রিপুরা রাজ পরিবারের প্রদ্যোৎমাণিক্য দেব গঠন করেছিলেন ‘ত্রিপুরা ইন্ডিজেনাস প্রোগ্রেসিভ রিজিওনাল অ্যালায়েন্স’। সেই দলের হয়েই উপজাতি পরিষদের ভোটের লড়াইয়ে নেমেছিলেন তিনি। গত ৬ এপ্রিল ২০টি বিধানসভা কেন্দ্র এলাকায় ছড়িয়ে থাকা পরিষদগুলির ভোট গৃহীত হয়।

এই পরিষদে রয়েছে মোট ৩০টি আসন। তার মধ্যে ২৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। বাকি ২ জনকে মনোনীত করেন রাজ্যপাল। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ভিত্তিতে এগুলিতে বড় ব্যবধানে এগিয়ে ছিল বিজেপি ও আইপিএফটি জোট। কিন্তু এবারের নির্বাচনে সেই ফল একেবারে পাল্টে গেল।

আসাম থেকে যে খবর আসছে, তাতে মনে হচ্ছে, রাজ্যটি আর বিজেপির হাতে থাকছে না। রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির এনডিএ জোটের পরাজয়ের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কংগ্রেস এবং বদরুদ্দিন আজমলের অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের ইউপিএ জোট জয় পেতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।

রাজ্যটিতে তিন দফার ভোটগ্রহণ ৬ এপ্রিল সম্পন্ন হয়েছে। ভোট গণনা হবে ২ মে, সেদিনই ফল। পরাজয়ের মুখে বিজেপি তাদের স্বভাবসুলভ বেপরোয়া ‘হর্স ট্রেডিং’ শুরু করবে, এ আশঙ্কায় কংগ্রেস এবং অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের প্রার্থীদের জয়পুরের একটি হোটেলে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

কংগ্রেস বলেছে, নির্বাচনের পর বিজেপি যাতে কংগ্রেস বিধায়কদের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করতে না পারে, সেজন্য তাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

ভারতে ভোটগ্রহণের পর বুথফেরত সমীক্ষা নিষিদ্ধ। তবে স্বাধীন সূত্রে যে আভাস পাওয়া যাচ্ছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ১২৬ আসনের বিধানসভায় ইউপিএ জোট ৭০ আসনে জিততে পারে। অন্যদিকে, এনডিএ জোট পেতে পারে ৫০ আসন। দল দুটির শীর্ষ নেতাদের শরীরী ভাষায়ও অনেকটা স্পষ্ট, সেখানে আর থাকছে না বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কথা বলা হলেও জনমত জরিপে এগিয়ে রয়েছেন মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেস।

২৭ মার্চ ভোটগ্রহণ শুরুর আগে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির হাইভোল্টেজ প্রচারণার পরেও গত ১৫ দিনে জনপ্রিয়তা বেড়েছে তৃণমূলের। টাইমস নাও-এ প্রকাশিত এক জনমত জরিপে দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪ বিধানসভা আসনের ১৬০টিতে তৃণমূল জয় পেতে পারে।

সি-ভোটারের ওই জরিপের ১৫ দিন আগে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল যে, তৃণমূল ১৫৪টি ও বিজেপি ১০৭টি আসনে জয় পেতে পারে। কিন্তু সর্বশেষ জরিপে দেখা গেছে, তৃণমূল ১৬০টি ও বিজেপি ১১২টি আসন পেতে পারে।

বিজেপির প্রচারণার কৌশল ‘এক্সট্রিমলি পজিটিভ’। নিশ্চিত পরাজয়কে সামনে রেখেও তারা ‘নিশ্চিত জয়ের’ কথা শোনান। কর্মীদের চাঙ্গা রাখা এবং প্রতিদ্বন্দ্বীদের মনোবল ভাঙার জন্য তারা দৃঢ়ভাবে এ পলিসি প্রয়োগ করেন। পশ্চিমবঙ্গেও সেটা করছেন বিজেপি নেতারা। অথচ, সেখানে প্রচারণা নিয়ে দলটিকে মাঝেমধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। বেশ কিছু স্থানে তাদের জনসমর্থনের অভাব দেখা গেছে। উপস্থিতি কম থাকায় সম্প্রতি একদিনে বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জেপি নাড্ডার দুটি জনসভা বাতিল করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে বিজেপির অনেক জনসভায় বিপুল চেয়ার খালি থাকার ছবি দেখা গেছে।

পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হবে ২ মে।

এদিকে, ভারতের হিমাচল রাজ্যে নিজেদের হারানো জমি পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে কংগ্রেস। সদ্যসমাপ্ত পুরসভা নির্বাচনের ফলাফল দেখার পর এমনটাই মনে করছেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। কারণ, এবারের নির্বাচনে চারটি পুরসভার মধ্যে দুটি দখল করে ফেলেছে কংগ্রেস। বাকি দুটির মধ্যে একটি পেয়েছে বিজেপি। অপরটিতে কোনো দলই ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে পারেনি।

গত ৭ এপ্রিল পুরসভা নির্বাচনের প্রথম দফায় চারটি মিউনিসিপ্যালিটিতে ভোটগ্রহণ হয়। চারটির মধ্যে পালামপুর এবং সোলানে ম্যাজিক ফিগার পেয়ে যায় কংগ্রেস। অন্যদিকে, মাণ্ডি পুরসভা বিজেপির দখলে গেলেও, ধরমশালায় কোনো দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি।

সম্প্রতি পাঞ্জাবের পুরসভা ভোটেও আশাতীত সাফল্য পেয়েছে কংগ্রেস, অন্যদিকে ধরাশায়ী হয়েছে বিজেপি। নির্বাচনে বিজেপিকে অনেকটা ধুয়েমুছে সাফ করে দিয়েছে কংগ্রেস। আটটি মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মধ্যে সব কটিতেই জয়ী হয়েছে কংগ্রেস।

রাজ্যের আট মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ৪০০ ওয়ার্ডের মধ্যে কংগ্রেস জয়ী হয়েছে ৩১৭টিতে। শিরোমণি আকালি দলের সংগ্রহে ৩৩ আসন। বিজেপির ২০, স্বতন্ত্র ২১ এবং আম আদমি পার্টি ১৮ আসনে জয়লাভ করেছে।

অন্যদিকে রাজ্যের মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিল ও নগর পঞ্চায়েতে ১ হাজার ১১৫ ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। শিরোমণি আকালি দল পেয়েছে ২৫১ আসন। আম আদমি পার্টি ৫১ এবং ২৯ আসনে বিজেপি জয়ী হয়েছে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন ৩৫২ আসনে।

পুরসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের এ জয়কে আইসবার্গের চূড়ার সঙ্গে তুলনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিং। অমরিন্দর বলেছেন, ‘পুরসভা নির্বাচনে শিরোমণি আকালি দল এবং বিজেপি যে ঝটকা পেয়েছে, তা আইসবার্গের চূড়ামাত্র। তাদের পাঞ্জাবের রাজনৈতিক আঙিনা থেকে মুছে ফেলা হবে এবং ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক মানচিত্র থেকেও তারা নিশ্চিহ্ন হবে।’

তিনি বলেন, ‘এই ফলাফল বলে দিচ্ছে, আর এক বছর পর বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল কী হতে চলেছে। এ দলগুলোকে পাঞ্জাবের বাইরে রাখার জন্য এটি একটি শক্তিশালী বার্তা। এরা রাজ্যবাসীর সঙ্গে যে ছলনা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তা রাজ্যবাসী ভুলবে না।’ শিরোমণি আকালি দলের ভাটিন্ডা কেন্দ্রে ৫৩ বছর পর জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। কৃষি আইন নিয়ে মতবিরোধের জেরে সম্প্রতি দীর্ঘদিনের বন্ধু বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেছে আকালি দল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষি আইন প্রত্যাহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে আন্দোলন চলছে, এবং সে আন্দোলন দমনে সরকার যেভাবে শক্তি ব্যবহার করেছে, তাতে সারাদেশের কৃষকদের মধ্যে বিজেপির বিরুদ্ধে একটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। ভারত কৃষিনির্ভর দেশ, সেই দেশে কৃষি আইন নিয়ে সরকারের গোঁড়া অবস্থান দলকে জনপ্রিয়তার তলানিতে নিয়ে যেতে পারে। যেমনটা পাঞ্জাবে দেখা গেছে, তা ধীরে ধীরে পুরো দেশে দৃশ্যমান হতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

এ পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি নেতারা উদ্বিগ্ন। পাঞ্জাবের ভোটের ফল দেখিয়ে নেতারা বলেছেন, দ্রুত মীমাংসা না হলে অনেক রাজ্যে বিজেপির প্রচার করাও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

সম্প্রতি বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার ওপর তৈরি এক বৈশি^ক প্রতিবেদনে ‘ফ্রিডম হাউস’ বলেছে, ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন নাগরিক অধিকার কমেছে। দেশটিতে গণতান্ত্রিক অধিকার এখন আর ‘মুক্ত’ নয়। সেখানে গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার ব্যাপকভাবে কমেছে। প্রতিবেদনে নাগরিকপঞ্জির নামে মুসলমানদের কোণঠাসা করার প্রসঙ্গ এসেছে।

এ-ই কদিন আগে আসামে ছয় শতাধিক মাদরাসা বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়ে মুসলিম সম্প্রদায়ের রোষানলে পড়ে বিজেপি সরকার। কাশ্মিরের জনতাত্ত্বিক কাঠামো পরিবর্তনের চেষ্টায় মরিয়া বিজেপি। বাবরি মসজিদ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে হত্যা, এসব ইস্যুতে বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ দেশটির মুসলিমরা। এ নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং ওআইসির মতো সংস্থাগুলো।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতের অর্থনীতি বলতে গেলে থমকে আছে। গত এক বছরে দারিদ্র্যের শিকার হয়েছেন প্রায় ৩ কোটি ২০ লাখ মধ্যবিত্ত। বেকারত্ব, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো সূচকের উন্নতি নেই। ২০২০-২১ অর্থবছরের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রান্তিকে জিডিপি তলিয়ে যায় যথাক্রমে ২৩.৯ শতাংশ এবং ৭.৫ শতাংশে। এরপর এ সংখ্যা কিছুটা স্বস্তি আনলেও সার্বিক অর্থে অর্থনীতি গতিশীল হওয়ার লক্ষণ নেই। যে হারে করোনার প্রকোপ বাড়ছে, তাতে অর্থনীতি কোন খাদে গিয়ে পড়ে, কারও জানা নেই। এ পরিস্থিতিতে বিজেপি সরকারকে অর্থনীতিতে মনোযোগ দেওয়ার পাশাপাশি উগ্র ডানপন্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় উন্মাদনাকে পুঁজি করে ভোট বাড়ানোর চেয়ে সামাজিক সুরক্ষা সূচকগুলোতে বেশি যত্নশীল হতে হবে। অন্যথা, পাঞ্জাব, ত্রিপুরা, হিমাচল, আসাম- এভাবে হারের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকবে নরেন্দ্র মোদি, অমিত শাহ, জেপি নাড্ডাদের।